রহিম মিয়া সেই কবে সুনামগঞ্জ ছেড়ে ঢাকায় এসেছিল সেটা ভালো করে মনে করতে পারে না। তার স্ত্রী লাইলী এবং একমাত্র পুত্র সুমনকে গ্রামে রেখে ঢাকার মত বিশাল শহরে তার আগমন। যখন রহিমের পা প্রথম ঢাকার মাটি ছোঁয় তখন তার পা হতে মাথা পর্যন্ত কারেন্টের মত শিহরণ বয়ে গিয়েছিল!
যে ঢাকার কথা রহিম এতদিন লোকমুখে শুনেছে; যে ঢাকার বিশাল মাঠের মত রাস্তাঘাট টিভির পর্দায় দেখে শিশুর মত পুলকিত হয়েছে, সে ঢাকায় স্বয়ং উপস্থিত হতে পারাটা তার কাছে স্বর্গীয় সুখের চেয়ে কম ছিল না!
বলাই বাহুল্য যে জীবিকা রহিমকে চুম্বকের মত টেনে ঢাকায় নিয়ে গেল। আজ প্রায় বিশ বছর ধরে সে ঢাকায় বসবাস করছে। ঢাকায় অনেক ভালো কিছু করার স্বপ্নের বীজ বুকে থাকা সত্ত্বেও সে বীজ কখনও ফোটেনি। শুরুতে সে খুব হতাশাগ্রস্ত থাকতো ঠিকই তবে পরে যখন একটি ছোটখাটো হোটেলে সে ওয়েটারের কাজটি পেল, তখন থেকে তার হতাশা বোধ আকাশের মেঘের মত আসতে আসতে কেটে যেতে লাগল।
সময়ের সাথে সাথে রহিম খুব ভালো করেই বুঝে গেছে যে বেশী আশায় হৃদয় ভঙ্গ হবার সম্ভাবনা বেশী থাকে; কারণ আশার সাথে না পাওয়ার বেদনার যখন লড়াই হয়, সে লড়াইয়ে যদি বেদনা জয়ী হয় তবে মানবমনে পুড়ে যাওয়া শরীরের মত গভীর দগদগে ক্ষতচিহ্ন রেখে যায়।
যাইহোক, রহিম তার এই নগণ্য চাকরী নিয়ে উচ্ছসিত না হলেও মোটামুটি খুশী। হোটেলেই তার থাকা খাওয়া ফ্রী! মাস শেষে যে বেতন পায় তার থেকে কিছুটা নিজের হাতখরচের জন্য রেখে বাকীটা বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। ছুটি খুব একটা মিলে না দুই ঈদ ছাড়া।
এখন রহিমের বয়স ষাট। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। খুব ভালো করে দেখতে পারে না। হোটেলের মালিক খুবই দয়ালু বলে এখন পর্যন্ত তাকে কাজে রেখেছে; অন্য কেউ হলে কবে চাকরী থেকে ফুটবলের মত লাথি মেরে বের করে দিয়ে নতুন কাউকে রাখতো!
একদিন কিছু মাস্তান ধরণের দেখতে কমবয়সী ছেলেপেলে হোটেলে আসে। রহিম যথারীতি এগিয়ে গিয়ে জানতে চায় তারা কি ভাবে। ছেলেগুলো কিছু গরম সিঙ্গাড়া আর চায়ের অর্ডার দেয়। ঝড়ের মত গতিতে রহিম টেবিলে সিঙ্গাড়া দেয় এবং তারপর অন্যান্য কাষ্টমারদের কাছে চলে যায়।
তবে গুপ্তচরের মত রহিম দূর থেকে ঠিকই খেয়াল রাখছে ছেলেদের সিঙ্গাড়া খাওয়া শেষ হয়েছে কি না। কারণ তারপরই সে চা নিয়ে যাবে সেদিকে। যাইহোক, একপর্যায়ে রহিম চা দিয়ে আবার অন্যান্য টুকটাক কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়।
কয়েক সেকেণ্ড পর আকাশ কাঁপানো শব্দে কিছু গ্লাস ভাঙ্গার শব্দে হোটেলের সকলেই ভয়ার্ত হরিণের মত চেয়ে থাকে। রহিমও সামনে এসে দেখে যেসব ছেলেদেরকে সে একটু আগে চা দিয়ে গিয়েছিল ওরাই একযোগে সব চায়ের কাপ ভেঙ্গেছে!
ছেলেগুলো ঐসব কাপ ভেঙ্গেই ক্ষান্ত হয়নি। তাদের মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছে। অশালীনতার চরম পর্যায় যাকে বলে আর কি! এমতাবস্থায় রহিমের মুখটা ফেটে যাওয়া বেলুনের মত চুপসে গেছে! সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না কোথায় ভুল হয়েছে।
পুঁচকে ছেলেগুলোর এতটা বাড়াবাড়ি হোটেলে থাকা অন্যান্য মানুষগুলো চুপচাপ সহ্য করছে। যেন ফিলোমেলার মত তাদের সবার জিহ্বা কেটে নেওয়া হয়েছে! হঠাৎ সেই তরুণ ছেলেদের মধ্যে একজন রহিমকে দেখতে পেয়ে তার হাত ধরে সামনে টেনে আনে।
বৃদ্ধ রহিম তখন গাছের পাতার মত কাঁপছে! তার হৃদয় এমনভাবে ওঠানামা করছে যেন ঢোল বাজছে! রহিম অস্ফুটে কিছু বলার আগেই এক ছেলে বলে,
- তোরে কইছি ছা দিতে! তুই এইডা কি আনছস? এইডারে কি ছা কয়?
- ছা-এ কি চিনি কম অইছে?
- চুপ! একদম চুপ!
- বাবারা! আমার কি দোষ? আমিতো আর ছা বানাই নাই! আমার উফর রাগেন ক্যান?
হোটেলের ম্যানেজারও সাহস করে সামনে এসে কিছু বলছে না। সে অদূরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ এসব দেখছে! যেন সে কোনও সার্কাসে কসরত দেখছে!
বেয়াদব ছেলেগুলো বৃদ্ধ রহিমকে তুইতোকারি করেই ক্ষান্ত হয়নি। তার চোখের চশমা আছড়ে ভেঙ্গেছে! তাদের মধ্যে একজন যাবার আগে তার গালে একটা চড়ও মেরেছে! চড়ের তীব্রতা এতো বেশী ছিল যে রহিম তার ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেনি। সে মুহূর্তেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। হোটেলের দুএকজন এসে তাকে ধরে পাশের একটি চেয়ারে বসায়। রহিমের দুচোখ বেয়ে ঝরনার মত কান্না অঝোর ধারায় বইতে থাকে। সে শিশুর মত কাঁদছে তো কাঁদছেই।
রহিম জানে না তার কি দোষ? রহিম জানে না কেন এতগুলো মানুষের মধ্যে থেকে একজনও তাদের প্রতিবাদ করেনি। রহিম জানে না মানুষের বিবেক এভাবে মরে যায় কি করে?