[পার্কের বেঞ্চ। দুই বন্ধু নীরব ও বিশাল বসে কথা বলছে।]
নীরবঃ আজকাল মানুষের মনুষ্যত্ব বলে কিছুই নেইরে বন্ধু!
বিশালঃ হুম, তুই একদম আমার মনের কথাই বলেছিস। তা হঠাৎ করে এই কথা বলার কারণ কি?
নীরবঃ আজ এখানে আসার পথে চৌরাস্তার মোড়ে এক বৃদ্ধা মহিলাকে দেখলাম ভিক্ষা করতে।
বিশালঃ তো? ভিক্ষা করাতে আর নতুন কি দেখলি?
নীরবঃ আরে ভাই, আগে আমার পুরো কথাটা শোন, তারপর না হয় যা বলার বলিস।
বিশালঃ ঠিক আছে, বল।
নীরবঃ বৃদ্ধা মহিলার বয়স প্রায় ষাট বা তারও বেশি হতে পারে। দেখলাম তিনি দাঁড়িয়ে থাকা একটি কারের কাঁচে ধাক্কা দিয়ে বারবার বলছিলেন, “আল্লাহ্র ওয়াস্তে কিছু দেন, আফনাগো ভালা হইবো!” গাড়িতে থাকা একজন লোক দরজা খুলে বৃদ্ধাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন! পড়ে থাকা ইটের সাথে লেগে তার কপাল কিছুটা কেটে যায়।
বিশালঃ বলছিস কি? সত্যি নাকি?
নীরবঃ হ্যাঁ! প্রথমেতো আমি আমার চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না!
বিশালঃ ছি! ধিক্কার জানাই এমন মানুষ নামক অমানুষকে! মানুষ এতো নীচ হয় কি করে? ছি! তারপর তুই কি করলি? মহিলাকে কি সাহায্য করেছিস?
নীরবঃ না। আমি দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। অন্য একজন সামনে এসে মহিলাকে সাহায্য করলো।
বিশালঃ বাহ, চমৎকার! তুই নিজে স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা দেখার মতন সেখানে দর্শক হয়ে দাঁড়িয়েছিলি? তোর মানবতাবোধ এতো প্রবল হলে কেন এগিয়ে গিয়ে ঐ অমানুষ লোকটাকে শাসালি না? কেন একটুও প্রতিবাদ করলি না? কেন ঐ অসহায় বৃদ্ধাকে সহায়তা করলি না?
নীরবঃ ইয়ে, মানে, আসলে।
বিশালঃ শালা হিপোক্রিট! এসব ইয়ে, মানে, আসলে বলা বন্ধ কর! মুখে বলবি মানবতার কথা, আর কাজের বেলায় ঠনঠন!
নীরবঃ আরে ভাই, এতো রেগে যাচ্ছিস কেন?
বিশালঃ চুপ শালা! তোর সাথে আর কোনও কথাই বলবো না! [বিশাল বিরক্ত হয়ে রেগে চলে যায়।] বিশাল, এই বিশাল, আরে শোন, দাঁড়া!
[মাস্টার মশাই আশরাফুল ইসলাম হেঁটে আশার সময় খেয়াল করলেন যে বিশাল রেগে হেঁটে যাচ্ছে। আশরাফুলের সাথে তার ছেলে আখলাকও আছে।]
আশরাফুলঃ নীরব, নীরব।
নীরবঃ আসসালামু আলাইকুম, স্যার। কেমন আছেন?
আশরাফুলঃ ওয়ালাইকুম আসসালাম। এইতো আল্লাহ্র রহমতে ভালোই আছি। তোমার কি খবর? সবকিছু ভালোতো?
নীরবঃ জি স্যার, ভালো। আখলাক কেমন আছো?
আখলাকঃ ভালো আছি।
নীরবঃ তোমাকে অনেক দিন পর দেখছি মনে হচ্ছে।
আখলাকঃ হ্যাঁ, কয়েকদিনের জন্য নানা বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম।
নীরবঃ তোমার লেখাপড়া কেমন চলছে?
আখলাকঃ এইতো চলছে, প্রতিদিন অনলাইনে ক্লাস করছি।
আশরাফুলঃ আচ্ছা নীরব, তোমার বন্ধু বিশালকে বেশ রেগে হন্তদন্ত হয়ে যেতে দেখলাম!
নীরবঃ ও এমনই, কথায় কথায় রেগে যায়।
আশরাফুলঃ কি হয়েছে বলোতো?
নীরবঃ আজ এক বৃদ্ধা মহিলাকে এক লোক ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল। আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আমি কেন এগিয়ে গিয়ে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করলাম না, কেন বৃদ্ধাকে সাহায্য করলাম না, সেইজন্য বিশাল আমার উপর রাগ করে চলে গেলো।
আশরাফুলঃ দেখো নীরব, তোমার বন্ধুর রাগ কিন্তু অযৌক্তিক নয়। ওর জায়গায় আমি থাকলেও ঠিক একই কাজ করতাম। তোমার কি মনে হয় না যে এমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিছু বলা উচিত ছিল।
নীরবঃ স্যার, সেখানেতো আরও অনেক লোক দাঁড়িয়ে ছিল। কেউ কিছু বলছিল না, সবাই দাঁড়িয়ে দেখছিল।
আশরাফুলঃ সবাই গাছের মতন দাঁড়িয়ে ছিল? তাদের মধ্যে বিবেক বলে কি কিছুই ছিল না? তাছাড়া অন্যরা অন্যায় করলে কি তুমিও অন্যায় করবে?
নীরবঃ স্যার, এখানে আমার অন্যায়টা কোথায়?
আশরাফুলঃ অন্যায়ের প্রতিবাদ না করাটাও একপ্রকার অন্যায়। তুমি কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত বচন শোনোনি? “ অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে?”
নীরবঃ জি স্যার, শুনেছি।
আশরাফুলঃ এই কথার মানে কি জানো?
নীরবঃ জানি। যে নিজে অন্যায় করে, সেতো দোষী; পাশাপাশি সে যদি কোনও অন্যায় হতে দেখেও নীরবে সহ্য করে, যদি প্রতিবাদ না করে, সেও অন্যায়কারীর মতন সমানভাবে দোষী।
আশরাফুলঃ তুমি জানো ঠিকই কিন্তু শুধু জানলেই হবে না, যা জানো, সেটাকে কাজেও পরিণত করতে হবে, তবেইতো সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠবে, বুঝলে? একদিন তোমার সাথে রাস্তায় কেউ অন্যায় করলে, অন্যরা যদি মূর্তির মত দাঁড়িয়ে দেখে, তখন তোমার কেমন লাগবে একবার ভেবে দেখোতো? ভালো লাগবে?
নীরবঃ মোটেও না। আমার খুব খারাপ লাগবে। আমার মনে হবে আশেপাশে এতো মানুষ, তবুও কেউ অন্যায়কারীকে কিছু বলছে না, কেউ আমাকে সাহায্য করছে না। নিজেকে অনেক অসহায় মনে হবে।
আশরাফুলঃ প্রায় ঠিক একই মানসিক অবস্থা হয়েছিল সেই বৃদ্ধা মহিলার।
নীরবঃ জি স্যার, বুঝেছি। আসলেই আমার ভুল হয়েছে। এরপর থেকে আমি সচেষ্ট থাকবো। যখনই কোনও অন্যায় দেখবো, তখনই প্রতিবাদ করবো।
আশরাফুলঃ এখনই ঝড়ের মতন ছুটে গিয়ে তোমার বন্ধুর অভিমান ভাঙাও, যাও।
নীরবঃ জি স্যার, আসসালামু আলাইকুম। [নীরব দ্রুত হেঁটে যায়।]
আশরাফুলঃ ওয়ালাইকুম আসসালাম। [স্যার স্থান ত্যাগ করেন।]
[পুকুর পার]
বিশালঃ [বিরক্ত হয়ে পুকুরের পানিতে তাকিয়ে আছে]
নীরবঃ [পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে] ভূত!
বিশালঃ শালার, এখানেও শান্তি নেই! [উঠে যেতে চায়, নীরব তার হাত টেনে থামায়।]
নীরবঃ আরে বাপ! এতো রাগ করছিস কেন? আমি কি কোনও মার্ডার করেছি নাকি?
বিশালঃ তোর সাথে আমার কোনও কথা নেই! এখান থেকে যা, বিরক্ত করিস না।
নীরবঃ আচ্ছা দোস্ত সরি। আমার ভুল হয়েছে। এবারতো মাফ করে দে।
বিশালঃ শালা, এসব ন্যাকামো বাদ দে, বুঝলি! মুখে সরি বললেই কি হয়, মন থেকেও সরি অনুভব না করলে এটা ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই না!
নীরবঃ এখন আমার সরি বলাটাও তোর বিশ্বাস হচ্ছে না?
বিশালঃ না, হচ্ছে না কারণ তুই সবসময় মুখে বড় বড় কথা বলিস ঠিকই, কিন্তু কাজের বেলায় নেই।
নীরবঃ আচ্ছা, আমি কি করলে তুই খুশি হবি বলতো?
বিশালঃ শুনবি?
নীরবঃ হ্যাঁ, বল।
বিশালঃ তাহলে চল আমার সাথে।
নীরবঃ কোথায়?
বিশালঃ শালা চল না! তোকেতো আমি নরকে নিয়ে যাবো না, তাই না?
নীরবঃ আচ্ছা, চল।
[বিশাল ও নীরব হেঁটে সেই স্থানে যায় যেখানে বৃদ্ধাকে আহত করা হয়। তারা বৃদ্ধাকে এক কোণায় বসে থাকতে দেখে। বিশাল দোকান থেকে এক প্যাকেট বিস্কিট আর পাউরুটি কিনে একসাথে বৃদ্ধাকে দেয়। বৃদ্ধা আল্লাহ্র নাম নিয়ে হাসিমুখে তা গ্রহণ করে।]
[সমাপ্ত]