[১৯৭১ সাল। স্কুলমাঠের ঠিক মাঝখানে বস্তার মতন স্তূপ করে রাখা লাশ আর লাশ! এরা সবাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের বলী হতে হয়েছে লাখো নারী পুরুষদের। শান্তিপুর গ্রামের নিরীহ দিনমজুর আব্বাস মিয়া তার ২২ বছরের ধর্ষিতা কন্যা কৈতরি বেগমের লাশের সামনে বসে শিশুর মতন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন]
আব্বাসঃ কুত্তার বাইচ্চা পাকিস্তানীরা আমার ফুলের মতন নিষ্পাপ মাইয়াডারে মাইরা ফালাইলো। হে আল্লাহ্, তুমি জুলুমবাজগো উফরে ঠাডা ফালাও! তুমি তাগোরে উচিত শিক্ষা দেও আল্লাহ্!
[আব্বাস কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার স্ত্রী জইমুনা বেগম দৌড়ে এসে স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।]
জইমুনাঃ [আব্বাসের মাথা কোলে নিয়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলে] কৈতরির বাপ! ও কৈতরির বাপ! তোমার কি অইলো? চোখ মেইল্লা চাও! ও কৈতরির বাপ!
[আব্বাসের ১৫ বছর বয়সী ছেলে রতন মায়ের কাঁধ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে]
রতনঃ মা! ও মা! মাগো!
জইমুনাঃ [প্রচণ্ড রেগে গিয়ে রতনকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে বলে] কসনা কি?
রতনঃ [ভয়ে বেলুনের মতন চুপসে গিয়ে বলে] মা, আমার মনে অইতাছে আব্বা বেহুঁশ অইয়া গেছে!
জইমুনাঃ [রতনের হাত ধরে সজোরে ঝাঁকি দিয়ে বলে] দূর হ আমার চক্ষের সামনে থাইকা! যা।
[এমন ধমক খেয়ে রতন চোরের মতন দৌড় দিয়ে পালিয়ে যায়।]
[অনেকক্ষণ ধরেও আব্বাসের হুঁশ না ফেরার ফলে তার বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনরা তাকে ধরাধরি করে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যায়। এখন মঞ্চে আছে শোকাহত ও ক্রোধান্বিত জইমুনা, প্রতিবেশী কিছু মহিলা ও স্বজন]
জইমুনাঃ [ক্রোধে ফেটে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে বলে] আমি যুদ্ধে যামু! আমি পরতিশোধ নিমু। আমি হক্কল পাকিস্তানীগোরে শেষ কইরা ফালাইমু! কেউ আমারে একখান বন্দুক আইনা দেও!
[প্রতিবেশী আফরোজা বানু জইমুনাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে।]
আফরোজাঃ [মাটিতে বসে থাকা জইমুনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে] কান্দিস না রে বইন, কান্দিস না! বেশি বেশি কইরা আল্লাহ্রে ডাক, আল্লায় সব ঠিক কইরা দিবো!
জইমুনাঃ আমি কান্দুম না তো কি করুম বইন? আমার ফুলের লাহান মাইয়াডারে ঐ জানোয়ারের দল জন্তুর লাহান শেষ কইরা ফালাইলো! অহন আমি কি লইয়া বাঁচুম, আল্লাহ্!
আফরোজাঃ [জইমুনাকে ধরে ধীরে ধীরে তুলতে তুলতে বলে] চল জইমুনা, ঘরে চল। আর কান্দিস না! ধৈর্য ধর, আল্লাহ্ হক্কলতা ঠিক কইরা দিবো।
[আফরোজা জইমুনাকে ধরে ধীরে ধীরে মঞ্চের বাইরে নিয়ে যায়। মঞ্চে থাকা অন্যান্য মহিলা ও পুরুষরাও প্রস্থান করে।]
[হতাশাগ্রস্ত ও তীব্রভাবে ক্রোধান্বিত রতন বটগাছের নিচে বসে গাছের পাতা চিবাতে চিবাতে ফুঁসতে থাকে। কিছুই ভালো লাগে না তার। মনে হয় যেন সবকিছু ভেঙেচুড়ে চুরমার করে দেবে আজ! অকস্মাৎ বটগাছের শিকড়ের এক কোণায় কিছু একটার দিকে দৃষ্টি পড়ে তার। কাছে গিয়ে দেখে লাঠির মতন দেখতে কি যেন একটা পড়ে আছে। হাতে নিতেই দেখতে পায় সেটা একটা বন্দুক! সেটা হাতে পেয়ে রতনের সারা দেহে এক অদ্ভুত আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সে বন্দুকটি আকাশে উঁচিয়ে ধরে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বলে।]
রতনঃ আমি যুদ্ধে যামু! আমি যুদ্ধে যামু! আমি হক্কল পকিস্তানী শয়তানগুলারে শেষ কইরা ফালামু! ইয়া আল্লাহ্, তুমি আমারে শক্তি দেও! শক্তি দেও! শক্তি দেও!
[রতন ট্রিগারে চাপ দিতেই একটি গুলি আকাশপানে ছুটে যায়! গুলির শব্দ শুনে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া রতনের কয়েকজন বন্ধু বটগাছের নিচে ছুটে আসে। তাদেরকে দেখে রতনের উত্তেজনা যেন আরও শতগুণ বেড়ে যায়। রতন আকাশের দিকে আরেকটি গুলি ছুঁড়ে চিৎকার দিয়ে বলে।]
রতনঃ আমি যুদ্ধে যামু! আমি যুদ্ধে যামু!
রতনের বন্ধুরাঃ আমরাও যুদ্ধে যামু! যুদ্ধে যামু! যুদ্ধে যামু!
[রতনকে দৌড়ে চলে যেতে দেখে তার বন্ধুরাও তার পেছনে ছুটে যায়। সবাই মঞ্চ ত্যাগ করে।]
[সমাপ্ত]