[ম্যাডাম ক্লাসে প্রবেশ করতেই ছাত্রছাত্রীরা সবাই সমস্বরে ‘গুড মর্নিং মিস’ বলে উঠে। ম্যাডাম বই, ডাস্টার ও রোলকলের রেজিস্টার খাতা টেবিলে রেখে ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বলেন।]
ম্যাডামঃ আগামীকাল কতো তারিখ বলোতো?
ছাত্রছাত্রীঃ ১৬ই ডিসেম্বর মিস!
ম্যাডামঃ গুড, ঠিক বলেছো! ১৬ই ডিসেম্বর ঠিক কি কারণে বিশেষ একটি দিন সেটি কি কেউ বলতে পারবে?
[অনেকেই হাত তুলে ‘হ্যাঁ’ সূচক ইঙ্গিত দিচ্ছে। ম্যাডাম তাদের মধ্য থেকে একজনকে দাঁড়িয়ে উত্তরটি দিতে বলেন। মেয়েটির নাম জয়িতা।]
ম্যাডামঃ তুমি বলোতো জয়িতা!
জয়িতাঃ ম্যাডাম, ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত বিশেষ একটি দিন কারণ এই দিনটিতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তানীদের হাত থেকে বিজয় লাভ করে!
ম্যাডামঃ ভেরি গুড জয়িতা! তুমি একদম সঠিক উত্তরটি দিয়েছো।
জয়িতাঃ থ্যাংক ইউ সো মাচ ম্যাডাম!
ম্যাডামঃ মোস্ট ওয়েলকাম!
জয়িতাঃ পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে কতোদিন যুদ্ধ করার পর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে সেই উত্তরটা কি কারো জানা আছে? দেখি, হাত তোলো?
[এই প্রশ্নের উত্তরে মাত্র দুইজন শিক্ষার্থী হাত তুলেছে।]
ম্যাডামঃ বিজয়া, তুমি বলতো উত্তরটা।
বিজয়াঃ ১০ মাস যুদ্ধ করার পর ম্যাডাম।
ম্যাডামঃ উহু, একটুর জন্য হয়নি!
বিজয়াঃ তাহলে কতো মাস মিস?
ম্যাডামঃ উত্তরটা হবে ৯ মাস।
রিদানঃ মুক্তিযুদ্ধ কেন এবং কাদের বিরুদ্ধে হয়েছিলো ম্যাডাম?
ম্যাডামঃ তুমি খুব সুন্দর প্রশ্ন করেছো রিদান। শোনো তাহলে, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা সমগ্র ভারতবর্ষকে দুই ভাগ করে ভারত এবং পাকিস্তান নামক দুটো রাষ্ট্রের সৃষ্টি করলো। সদ্য জন্ম নেয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রটি পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। শুরুতে সব ঠিকই ছিল কিন্তু যতোই সময় গড়িয়ে চললো, পাকিস্তানী সরকার পশ্চিম পাকিস্তানকে সব রকম সুযোগ সুবিধা দিচ্ছিল; সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি পুরোদমে পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে তোলা হচ্ছিলো। মোটকথা হচ্ছে এই যে পশ্চিম পাকিস্তানীরা সবরকম সুযোগসুবিধা ভোগ করছিলো, অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানীরা সবকিছু থেকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত হচ্ছিলো।
রিদানঃ মুক্তিযুদ্ধ ঠিক কবে শুরু হয়েছিলো ম্যাডাম?
ম্যাডামঃ ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের উপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক ভয়ংকর গণহত্যা শুরু করে।
বিজয়াঃ তাহলে কেন ২৬ মার্চ ১৯৭১-কে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস বলা হয়? পাশাপাশি অনুগ্রহ করে এই ‘অপারেশন সার্চলাইট’ সম্পর্কে যদি একটু বিস্তারিত বলতেন?
ম্যাডামঃ হ্যাঁ, তোমার দুটি প্রশ্নের উত্তর আমি একসাথেই দিচ্ছি। শোনো, ‘অপারেশন সার্চলাইট’ হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদের করা অত্যন্ত নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড যার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানী নিস্পাপ ও নিরস্ত্র আমজনতা, ছাত্রছাত্রী, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এবং সশস্ত্র বাহিনীর লোকদেরকে অন্যায়ভাবে ও নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিলো! ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করলো। এমনটা ধারণা করা হয় যে তিনি গ্রেপ্তার হবার একটু আগে ২৫শে মার্চ রাত ১২টার পর (অর্থাৎ, ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে) বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন যা চট্টগ্রামে অবস্থিত তত্কালীন ই.পি.আর এর ট্রান্সমিটারে করে প্রচার করার জন্য পাঠানো হয়েছিলো।
রিদানঃ ঘোষণাটি ঠিক কি ছিলো?
ম্যাডামঃ ঘোষণাটির বাংলা অনুবাদ হলো এমন- “এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উত্খাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।” পরে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৭শে মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন।
বিজয়াঃ মেজর জিয়াউর রহমান যে ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেছিলেন সেটি কেমন ছিলো?
ম্যাডামঃ ইংরেজিতে পাঠ করা সেই ঘোষণাপত্রটির অনুবাদ হলো এমনঃ “আমি, মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির প্রাদেশিক কমাণ্ডার-ইন-চিফ, শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি আরো ঘোষণা করছি যে, আমরা শেখ মুজিবর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও আইনসিদ্ধ সরকার গঠন করেছি যা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের সরকার জোট-নিরপেক্ষ নীতি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর। এ রাষ্ট্র সকল জাতির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং বিশ্বশান্তির জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আমি সকল দেশের সরকারকে তাদের নিজ নিজ দেশে বাংলাদেশের নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। শেখ মুজিবর রহমানের সরকার একটি সার্বভৌম ও আইনসম্মত সরকার এৰং বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাবার দাবিদার।”
রিদানঃ কি নাটকীয় ঘটনাগুলো!
বিজয়াঃ হুম, আমারতো ভেবেই গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে!
ম্যাডামঃ পশ্চিম পাকিস্তানীরা যাচ্ছেতাই করছিলো। নীতি-নৈতিকতার কোনও বালাই ছিল না তাদের মধ্যে। তারা ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল অন্যায়ভাবে বাতিল করে দিয়েছিলো যেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন!
সোহানঃ মুক্তিযুদ্ধে মোট কতোজন শহীদ হয়েছিলো?
ম্যাডামঃ ৩০ লক্ষ জন শহীদ হয়েছিলো!
বিজয়াঃ শুনেছি অসংখ্য নারীরাও নাকি তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছিলো।
ম্যাডামঃ তুমি ঠিকই শুনেছো। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় ২,০০,০০০ নারী ধর্ষিত হয়েছিলো এবং তাদের গর্ভে অনেক যুদ্ধশিশু জন্ম নিয়েছিলো । পাকিস্তানি সৈন্যরা বহুসংখ্যক মেয়েকে ঢাকা সেনানিবাসের ভেতরে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো, যাদের মধ্যে বেশীরভাগই ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ও সাধারণ পরিবারের মেয়ে।
বিজয়াঃ কি বীভৎস!
রিদানঃ ম্যাডাম, আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে এতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানিয়ে আলোকিত করার জন্য।
সোহানঃ আসলেই আজকে অনেক কিছু জানতে ও বুঝতে পেরেছি!
ম্যাডামঃ [ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে বলেন] আজ তাহলে এ পর্যন্তই। কাল দেখা হবে। সবাই ভালো থেকো।
[ম্যাডাম ক্লাস ত্যাগ করতে যাচ্ছেন এমন সময় ক্লাসের সকল ছাত্রছাত্রীরা দাঁড়িয়ে সমস্বরে ‘থ্যাংক ইউ সো মাচ’ বলে উঠে।]
ম্যাডামঃ [একটু দাঁড়িয়ে, মুচকি হেসে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে বলেন] ইউ অল আর মোস্ট ওয়েলকাম!
[ম্যাডাম ক্লাসরুমের বাইরে চলে যান অর্থাৎ মঞ্চ ত্যাগ করেন।]
[সমাপ্ত]