সাধুর সুপ্তশব্দ

আকাশে ঘন কালো মেঘ। চারপাশে আঁধার নেমে এসেছে।
সন্ধ্যা নামার আগেই রাত জেঁকে বসতে চাচ্ছে। ঝড় এলো বলে। 
পাহাড়ি এই এলাকায় ঘরবাড়িও বেশ ফাঁকায় ফাঁকায়।
রাতে হিম ঠান্ডা পড়ে। সন্ন্যাসী মনে মনে প্রমাদ গুনলেন। 
নিরাপদ একটা আশ্রয় খোঁজা দরকার।
বাঁকটা পার হতেই চোখে পড়ল একটা বাড়ি।

 সন্ন্যাসী দ্রুত পা চালালেন। বাড়িটা থেকে হালকা ঢালু হয়ে নেমে এসেছে রাস্তা। 
বাইরে থেকে বোঝা যায় না বাড়িটা এত সুন্দর। গোছানো, চমৎকার নকশার।
তিনি দরজায় কড়া নাড়লেন।
বাইরে ততক্ষণে ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করেছে।
বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা শুষ্ক মাটিতে পড়ছে সশব্দে।
দরজা খুললেন এক নারী। দীর্ঘাঙ্গী।
বয়স মধ্যভাগ পেরিয়েছে। ধারালো চেহারা।
চোখ দুটো গভীর, কাজলপরা।
আগতের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার ভালো করে দেখে নিলেন নারী।
তবে তিনি মুখে কোনো কথা বললেন না।
চোখ নাচিয়ে মুখে এমন একটা ভাব ফুটিয়ে তুললেন যাতে স্পষ্ট বোঝা গেল প্রশ্নটা : কী চান ?
একটু আশ্রয়।
এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাব মা।
সন্ন্যাসী বললেন বটে, তবে একটা সন্দেহও তার ভেতরে কাজ করল। ভদ্রমহিলা বাংলা বোঝেন তো?
দেখে তো অবাঙালিই মনে হচ্ছে।
কাম।
দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘাঙ্গী নারী বললেন।
সন্ন্যাসী ভেতরে ঢুকলেন। তারপর কিছুটা আপন মনেই বললেন, ‘এই ভাব অনেক দিন আগেই মন থেকে চলে গেছে মা।’
জবাবে কিছুই বললেন না নারী।
শুধু সন্ন্যাসীর মুখটা গভীর দৃষ্টিতে একবার দেখলেন তিনি।

দুই.
বিদ্যুৎ চলে গেছে। বৈদ্যুতিক লণ্ঠন জ্বলছে। সন্ন্যাসীর আহার পর্ব প্রায় শেষের দিকে। 
অন্নপূর্ণা নারী প্রতিটি পদ খুব যত্ন করে তুলে দিয়েছেন পাতে।
তিনি নিজেও নিরামিষ খান। 
তাই সন্ন্যাসীর জন্য বাড়তি রান্নার প্রয়োজন হয়নি।
সন্ন্যাসীর হাত ধোয়া শেষ হলে একটি পরিষ্কার তোয়ালে এগিয়ে দিলেন গৃহকর্ত্রী।
অতিথির হাত-মুখ মোছা শেষ হওয়ার পর তিনি খুব বিনীত ভাবে বললেন, একটা কথা বলার ছিল।
নির্দ্বিধায় বলো মা।
সন্ন্যাসী আপ্লুত গলায় বললেন।
আমি খুব ভালো বাংলা জানি না, তবে ভালোই বুঝতে পারি। 
আপনিও নিশ্চয়ই ইংরেজি কিছুটা হলেও জানেন ও বোঝেন।
ইংরেজিতে ‘কাম’ শব্দটার অর্থ আসুন বা এসো। আপনি তখন বলেছেন, কামভাব অনেক দিন আগেই আপনার মন থেকে চলে গেছে।
হয়ত গেছে।
কিন্তু মস্তিষ্কের ভেতরে রয়ে গেছে।
আমার তো মনে হয় মস্তিষ্কের গভীরে কোথাও সুপ্ত অবস্থায় রয়ে গেছে শব্দটা।
নইলে আপনার মুখ থেকে এমন কথা বের হতো না। আমি একজন নর্তকী। পুরুষদের খুব ভালো করেই চিনি।
মুখে কিছু না বললেও শুধু চোখ-মুখ দেখে বলে দিতে পারি একজন পুরুষের মাথার মধ্যে কী ঘুরপাক খাচ্ছে। 
দৃঢ় আত্মবিশ্বাসী গলায় কথাগুলো বললেন আশ্রয়দাত্রী।
এরপর সন্ন্যাসীর মাথা নিচু করে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। বাইরে প্রবল ঝড়বৃষ্টি।
না হলে তিনি এখান থেকে দৌড়ে পালাতেন।
লজ্জায় আর চোখ তুলতে পারলেন না তিনি।
 গ্লানিতে ভরা অবসন্ন গলায় সন্ন্যাসী বললেন, অসতর্ক এক মুহূর্তে মুখ থেকে শব্দটা বেরিয়ে গেছে মা।
মাথার ভেতরের এই সুপ্ত শব্দটা বের করে দেওয়ার বাকি সাধনাটুকু আমি অবশ্যই করব।
তুমি নিশ্চিত থাকো মা।
শিবু, সাধুবাবার শোবার ঘর তৈরি হলো? 
নারীটি গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ মা, তৈরি।
বয়োবৃদ্ধ গৃহকর্মী শিবু লণ্ঠন হাতে কাশতে কাশতে এগিয়ে এলো।
যান, বিশ্রাম নিন। সন্ন্যাসীকে আন্তরিক গলায় বললেন ঋজু এক নারী।

View thenurhossain's Full Portfolio