***
‘বদ পুলা, খাস না ক্যান? খাস না খালি কান্দস?’ বলেই তিন মাসের ছেলেকে বুক থেকে খাটের উপর শুইয়ে দিল নুপুর। রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে। ছেলেটা খাটের উপরে হাত পা ছুড়ে কাঁদছে। নুপুর কি করবে বুঝতে পারছে না। এদিকে বুকের ভেতর টনটন করছে। দুধ এসে চাপ দিচ্ছে কিন্তু বাচ্চাটাকে অনেক সাধাসাধি করেও খাওয়ানো গেল না। রাগে দুঃখে চোখে পানি এসে গেল নুপুরের। কাল রাত থেকেই বাচ্চাটা অনেক কাঁদছে। কিছুই খেতে চাইছে না। এদিকে স্তনে এমন ব্যথা শুরু হয়েছে যে সহ্য করাও মুশকিল হয়ে গেছে। অগত্যা উপায় না দেখে বাথরুমের দিছে ছুটে গেল। কিছু দুধ গেলে না ফেললে ব্যথা থেকে মুক্তি নেই। খাটের উপর থেকে বাচ্চাটা জোরে জোরে চিৎকার করেই যাচ্ছে। নুপুর কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল। বাথরুমে গিয়ে দুধ বের করতে গিয়েই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। বুকের ভেতর থেকে একটা চাপা কান্না ঠেলে বের হয়ে আসছে। কত বছর হয়ে গেল। তারপরেও স্মৃতিগুলো প্রতিনিয়ত ওকে কুরে কুরে খায়। মনে পড়ে গেল আজ তো সেই দিনই। নুপুর ভোলেনি।
তিন বছর হল নুপুরের বিয়ে হয়েছে। খুব সুখের সংসার ওদের। স্বামী সুরুজ আলী বৌ বলতে অজ্ঞান। অনেক ভালবাসে সে তার স্ত্রীকে। এই দুনিয়াতে আত্মীয় বলতে তেমন কেউ আর বেঁচে নাই তার। বাবা মা কে তো কবেই হারিয়েছে। নিঃসন্তান এক চাচার কাছে মানুষ হল। সেই চাচাও মারা গেলেন গত বছর। আত্মীয় বলতে আর কাউকে চেনেও না সুরুজ আলী। নুপুরকে বিয়ে করার পরে তার মনে হয়েছে যেন মহাসমূদ্রে সাঁতার কাটতে গিয়ে হাতে পাওয়া একমুঠো সম্বলের মত। ঘরে ঢুকে বৌকে না দেখলে সে অস্থির হয়ে যায়।
: কইগো কই গেলা? বলে দরজার কাছ থেকে ডাক দেয় নুপুরের স্বামী সুরুজ আলী।
-এইতো আমি। তুমি কখন আইলা? বলতে বলতে বাথরুম থেকে বের হয়ে আসে নুপুর।
: মাত্রই আইলাম। পুলা কান্দে ক্যান?
-আমারে জিগাও গ্যান। পুলারেই জিগাও।
: একি তোমার মুখ ফোলা ক্যান? তুমি কানতেছিলা নাকি?
-কই নাতো? বলতে গিয়ে নুপুরের মুখ ফর্সা মুখ লাল হয়ে যায়। স্বামীর কাছে সে কিছুই লুকাতে পারে না।
: কই আমি যে দেখতাছি। তোমার কি মন খারাপ? বলতে বলতে নিজের স্ত্রীকে নিজের বুকের কাছে টেনে নেয় সুরুজ আলী। ছেলে ততক্ষণে কান্না থামিয়েছে একটু।
-তুমি আমারে একদিন ঢাকা নিয়া যাইবা? বিষাদের সুরে বলে নুপুর।
: ক্যান নিমু না? কবে যাইবা? কবে যাইতে চাও?
-তোমার যেদিন কাম থাকবো না। ওইদিন যামু।
: আইচ্ছা ঠিক আছে। সামনের সপ্তায় ছুটি নিমু একদিন। তখন যাইও। যাইতে তো বেশি সময় লাগবো না।
-হ ঠিক আছে।
***
দশ বছর আগের কথা। নুপুর তখন ঢাকায় মনসুরাবাদ আবাসিক এলাকার কাছে এক টিনশেড কলোনীতে মামা-মামীর সাথে থাকত। গ্রামে অভাবের সংসার ছিল। মামা তাকে বাবা মায়ের কাছ থেকে নিয়ে আসে নিজের কাছে। মামা নিজেও যে খুব স্বচ্ছল ছিল তা না। কিন্তু তারপরেও নিজের বোন দুলাভাই এর অবদান ভুলতে পারে না। শত কষ্টের মাঝেও তাকে লেখা পড়া করিয়ে মানুষ করেছে। তাই কষ্ট করে হলেও ভাগ্নিকে নিজের কাছে রেখেছে। নুপুর ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। মামা অনেক চেষ্টা করে নুপুরকে মনসুরাবাদের কাছেই এক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরি জুটিয়ে দিয়েছে। হেঁটে যেতে লাগে ২০ মিনিট এর মত। হেঁটেই যাতায়াত করে। কত বয়স তখন ওর? ১৫ কি ১৬ হবে। ভাগ্নিকে নিয়ে মামা-মামীর সারাক্ষণ চিন্তা লেগেই থাকে। তাছাড়া নুপুর নজরকাড়া সুন্দরী। একবার দেখলে মুখ ফেরানো যায় না এমন। মামা-মামীর চিন্তা তো হবেই।
নুপুরের মামী তখন অন্তঃসত্ত্বা। বিয়ের প্রায় পাঁচ বছর পরে সে সন্তানের মা হতে চলেছে। মনসুরাবাদের মাছেই ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মী এক আপা’র সাথে তার অনেক খাতির। স্বাস্থ্যকর্মী রেহানা বেগম নিয়মিত এসে নুপুরের মামী শাহানাকে দেখে যায় আর বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে যায়। আজ বেশ কয়দিন যাবত প্রায় দুই তিন মাস নুপুরের ভাব ভঙ্গি দেখে শাহানা দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গেছে। মেয়েটার শরীর কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। চোখ কালো হয়ে গেছে। খেতে চায় না। মাঝে মাঝে বলে মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। শাহানা ভেবেছে রোদের মধ্যে হেঁটে যেতে গিয়ে মনে হয় এমন হয়েছে। কোন কিছু বুঝে উঠতে পারে না শাহানা। মেয়েটাও কেমন যেন মুখচোরা হয়েছে। মুখে সারাক্ষণ হাসি লাগিয়েই রাখে। কাউকে কিছুই বলতে চায় না। শাহানা কি করবে ভেবেই পায় না। মেয়েলি কোন সমস্যা কিনা তাও বুঝতে পারছে না। এইবার সে রেহানা আপাকে বলবে যেন নুপুরকেও দেখে যায় একটু। নুপুরের মামাকেও আগেভাগে কিছু বলতে সাহস হয় না শাহানার। এইদিকে নিজের শরীরের এই অবস্থা। দিশেহারা লাগে ওর।
একদিন শাহানাকে দেখার জন্য স্বাস্থ্যকর্মী রেহানা এলেন। অনেক্ষণ দেখে বললেন, চিন্তার কোন কারন নেই শাহানা। বাচ্চার অবস্থা ভালই। সব ঠিকঠাক আছে। পরবর্তী টিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন শাহানাকে।
-আপা একটা কথা কই?
: বল শাহানা।
-আপনি নুপুরকে একটু দেখবেন?
: কেন ওর কি হইছে?
শাহানা আস্তে আস্তে নুপুরের কথা সব রেহানা কে খুলে বলে। শুনে রেহানা’র কপালে দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে।
: কই নুপুর কোথায়?
-ঐতো পাশের ঘরেই আছে। শুয়ে আছে। মেয়েটা কেমন যেন রোগা হয়ে গেছে। কিছু খাইতেই চায় না। বলে শরীর ভাল লাগে না। কিছুই বুঝতেছিনা আপা। ‘কই চলতো ওকে দেখি’ বলে শাহানার কাছ থেকে উঠে নুপুরের ঘরে যায় রেহানা।
: কেমন আছ নুপুর?
-ভাল আছি খালা। আপনি কেমন আছেন? নুপুর রেহানাকে খালা বলে ডাকে।
: আমি ভাল। তোমার মামী বলল তোমার নাকি শরীর ভাল না।
-তেমন কিছু না খালা।
: কই আসো তো দেখি।
চোখ মুখ অনেক্ষণ ধরে ভাল করে দেখার পরে রেহানা বেগম জানতে চাইলেন, মাসিক হয় ঠিকমত?
মাথা নেড়ে নুপুর জানায়, না।
: শেষ কবে হয়েছে?
-মনে নাই আমার।
: মনে করার চেষ্টা কর নুপুর। এইবার রেহানার গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে নুপুর নিজেও ঘাবড়ে যায়।
-প্রায় তিনমাস আগে হইছিল।
শুনে রেহানার মুখ এইবার অন্ধকার হয়ে গেল।
: আগে জানাও নাই কেন? তোমার মামীকে কিছু বল নাই কেন? প্রায় ধমক দিলেন রেহানা।
-কেন খালা কি হইছে?
কিছু না বলে ব্যাগের ভেতর থেকে ছোট্ট একটা শিশি বের করে নুপুরের হাতে দিয়ে বললেন, যাও বাথরুমে গিয়ে এর মধ্যে পেশাব নিয়ে আসো। তোমার মনে হয় অসুখ করছে। পরীক্ষা করতে হবে। নুপুর শিশি নিয়ে উঠে গেল। এসে শিশিটা একটা কাগজে মুড়ে রেহানার হাতে দিল। রেহানা ব্যাগের মধ্যে ভরে উঠে দাঁড়ালেন।
-কি অসুখ হইছে খালা?
: পরীক্ষা না করে বলতে পারতেছি না। বলেই রেহানা উঠে চলে গেলেন। নুপুরকে বলে গেলেন, কখনো বেশী খারাপ লাগলে আমাকে খবর দিবে। আমি দেখে যাব। রেহানা যাবার পরে নুপুর আবার শুয়ে পড়ে।
দুইদিন পরে টিকা নিতে যায় শাহানা। রেহানা চিন্তিত মুখে শাহানাকে জিজ্ঞাসা করে, নুপুরের কি কারো সাথে সম্পর্ক আছে?
-আপা তেমন কিছু তো দেখি নাই
: ভালো করে ভেবে দেখে।
-কেন কি হইছে আপা? শাহানা ভয় পেয়ে যায়।
: কেমনে বলি তোমারে? আবার না বলেও পারতেছি না।
-কি হইছে আপা?
: নুপুরের পেটে বাচ্চা আসছে। বিশ্বাস না হলেও ঘটনা সত্যি। আমি পরীক্ষা করে দেখছি। কেমনে হইল এইসব?
শুনেই শব্দ করে কেঁদে ওঠে শাহানা। ‘হায় হায় এ কি সর্বনাশ হয়ে গেল’?
: শাহানা নিজেকে সামলাও। তোমার এই অবস্থায় এমন ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। আমাদের মেয়েদের কে অনেক কিছুই সামাল দিতে হয় যা পুরুষরা পারে না। তুমি শক্ত হও। ভেঙ্গে পড় না। তোমার স্বামীর সাথে খোলামেলা আলাপ কর এই সমস্যা নিয়ে। নুপুরের বয়স অল্প। না জানি কিভাবে এই ভুল করে বসল। ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে। কপালে চিন্তার রেখা ফুঁটিয়ে বললেন রেহানা, নুপুরের এখন প্রায় চার মাস চলে।
-কিছু করা যায় না আপা? বাচ্চা নষ্ট করে ফেলা যায় না? ওর মামা জানলে যে কি করব আমি বুঝতেই পারতাছি না।
: এখন আর ওসব চিন্তা করে লাভ নেই শাহানা। অনেক দেরী হয়ে গেছে। এখন আর বাচ্চা নষ্ট করা যাবে না। তাছাড়া নুপুরের বয়স অনেক কম। এখন বাচ্চা নষ্ট করলে হয়ত ও আর কোনদিন মা হতে পারবে না। মেয়েটার লাভের চেয়ে ক্ষতি অনেক বেশী হয়ে যাবে শাহানা।
-বুঝছি আপা। আমার নিজের পেটেও বাচ্চা আছে। আমি বুঝতাছি। বলে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে শাহানা।
: কোন পরামর্শ লাগলে আমি আছি।
***
নুপুরের মামা শাহাবুদ্দিন সব কথা শুনে শোকে বিমূঢ় হয়ে গেলেন। কি করবেন কিছুই ভেবে পেলেন না। ভাগ্নি’র এই সর্বনাশের কথা বোন দুলাভাই কেও জানাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। মনের কষ্টে নাওয়া খাওয়াও যেন ভুলে গেলেন। নিজের স্ত্রীর এমন কঠিন সময়েও সিদ্ধান্ত নিলেন যে এই এলাকা থেকে চলে যেতে হবে। নাহলে দুর্নামের হাত থেকে কিছুতেই বাঁচা যাবে না। নুপুর না বুঝে যে ভুল করে ফেলেছে তার মাশুল এখন সবাইকেই দিতে হবে। যেই আদরের ভাগ্নিকে কখনও বকা দেননি, স্ত্রীর কাছে এই ঘটনা শুনে দিগ্বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে নুপুরকে কয়েকটি চড় দেন। পাশের ঘরে জানাজানি হয়ে যেতে পারে বিধায়, শাহানা জোর করে স্বামীকে নিজের ঘরে নিয়ে আসেন। নুপুর অসহায় হয়ে মামার পায়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে সব ঘটনা খুলে বলে। গার্মেন্টসে যাবার পথে এক নির্মানরত বাড়ির সাইট ম্যানেজার দীপক পাল নামক এক লোকের খপ্পরে পড়ে নুপুরের আজ এই অবস্থা। যেখানে নরনারীর শারীরিক সম্পর্কের কোন কিছু নুপুরের জানা ছিল না, সেখানে সন্তান জন্মাবার ইতিবৃত্ত তার কাছে অজানা রহস্যের মতই ছিল। ছেলেটি তাকে প্রেমের ছলনা করে ফুসলিয়ে এই সর্বনাশ করেছে। পরদিন মামা দীপকের খোঁজে যায় কিন্তু কোথাও খুঁজে তার আর কোন হদিস পাওয়া গেল না।
নুপুর পড়ে গেল মহা সমূদ্রে। নিজের শরীরের মধ্যে অন্য একটা অস্তিত্ত্ব বেড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। সমাজের যার কোন স্বীকৃতি নেই। সমাজের কাছে যে শুধু একটা অবৈধ, জারজ শিশু মাত্র। এমন অবৈধ লালসার শিকার কুমারী মা আর আর সন্তানের কোন ঠাঁই আমাদের সমাজ দেয় না। নুপুর তার ছোট্ট জীবনের কয়দিনে এই বাস্তবতা বুঝে গেছে। সারাদিন মেয়েটার এখন কান্নাকাটি করে দিন যায়। মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। সারাক্ষণ মনে হয় আত্মহত্যা করে। মামী অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে নজরে নজরে রাখে।
এরই মধ্যে শাহাবুদ্দিন তার স্ত্রী আর ভাগ্নি কে নিয়ে মনসুরাবাদ এর বাসা ছেড়ে চলে গেল। এইবার উঠলো এক বস্তিতে। যেখানে সন্দেহ করার মত কেউ নেই। মেয়েটা অন্তত ক’টা দিন একটু স্বস্তিতে থাকুক। এদিকে শাহানার যে কোন সময় ব্যথা উঠতে পারে। শাহানার শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। চিন্তায় চিন্তায় শাহাবুদ্দিনের এমন অবস্থা হয়েছে যে স্বামী স্ত্রী কারোরই মনে কোন শান্তি নাই। এত কষ্টের মাঝেও শাহাবুদ্দিনের ঘরে আলো করে এল ফুটফুটে একটা মেয়ে। বাবা হবার প্রশান্তি তার মনে তেমন কোন রেখাপাত করতে পারলো না। নুপুরের মুখের দিকে তাকানো যায় না। চোখ গর্তে চলে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে শরীরে আর কিছু নেই। ঘরের থেকে বের হয় না। ঘরের বাইরের সব কিছুই তার কাছে নরকের মত মনে হয়। দিন গুনতে থাকে কবে এই নরক যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পাবে। দীপকের লালসার শিকার হয়ে নিজের পরিণতির অপেক্ষা করতে থাকে হতভাগী মেয়েটা।
***
-খালা! ও খালা!
: কেডা? বলতে বলতে প্রৌঢ়া এক মহিলা ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়।
-আমি খালা। শাহাবুদ্দিন।
: কি হইছে শাহাবুদ্দিন মিয়া?
-খালা একটু আমার ঘরে আসেন। নুপুরের ব্যথা উঠছে।
: কই তাই নাকি? কই চল দেখি।
নুপুর মরার মত পড়ে থাকে। শারীরিক যন্ত্রণা ওকে তেমন স্পর্শ করে না। প্রসব বেদনার মত ভয়াবহ কষ্টকেও নিজের মধ্যে হজম করে নেয়। নয় মাসের এই ধকল ছোট্ট এই মেয়েটাকে যেন অনেক পরিণত করে দিয়েছে। মনে মনে ভাবতে থাকে, কি করবে সে এই সন্তান দিয়ে? কিভাবে মানুষ করবে? কি পরিচয় থাকবে? ভাবতে ভাবতে চোখের কোনা দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। মামী পাশে বসে চোখ মুছিয়ে দেয়। একসময় নুপুরের কিশোরী শরীর বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসে একটি পুত্র সন্তান। নুপুর একটি বারের জন্য তার চিৎকার শুনতে পায় বেহুশ হবার আগে। মাত্র একটিবারের জন্যই।
নুপুরকে জানানো হয় যে তার একটি মরা ছেলে হয়েছে। নুপুর কোন উচ্চবাচ্য করে না। ঘটনা অন্তরালেই থেকে গেল। অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণা আর মানসিক চাপে নুপুরের মনে হল ও পাগল হয়ে যাবে। ভোরবেলা মামী একগ্লাস দুধ নিয়ে নুপুরের কাছে বসে। নুপুর উঠে বসে অনেক কষ্ট করে। জিজ্ঞাসা করে, মামী বাচ্চাটা কোথায়?
-তোমার মামা খালারে দিসে। উনি ফালাইয়া দিসে।
: ফালাইয়া দিসে? বলেই নুপুর মামীর বুকের উপরে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে।
-কান্দিস না নুপুর। তোর একসময় বিয়া হইব। তখন তোর আবার বাচ্চা হইব।
: আমি ওরে দেখুম মামী। আপনি আমারে লইয়া চলেন।
-তুই কি পাগল হইলি রে নুপুর?
: না মামী আপনি আমারে লইয়া চলেন। বাচ্চাটারে একবারের জন্যিও দেখলাম না।
-তোর মামা শুনলে রাগ করব নুপুর।
: করুক রাগ। আমার আর আছে কি? আমি একবারের জন্য দেখতে চাই। আপনি আমারে লইয়া চলেন। কই ফেলছে?
-গলির শেষ মাথার প্লটের ধারে নিয়া ফালাইছে।
: মামী বাচ্চা নাকি মরা হইসে? আমি কিন্তু একবার কান্নার শব্দ শুনছিলাম।
নুপুরের এই প্রশ্নের উত্তরে শাহানা নিশ্চুপ থাকে। বুক চিরে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে তার। নুপুর কে খাট থেকে উঠায়ে দাঁড় করায়। নুপুরের মাথা টলতে থাকে কিন্তু তবুও সে শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। সেও যে মা! তাকে তো দাঁড়াতেই হবে। শীতের সকাল। নুপুর গায়ে মামীর দেয়া শালটা জড়ায়ে নেয়।
গলির শেষ মাথার প্লটের ধারে খোলা যায়গায় নুপুর আর শাহানা এসে দাঁড়ায়। দেখে কয়েকজন মানুষের জটলা। শাহানা বলে, ‘আল্লা’র দোহাই লাগে। কাউরে বুঝতে দিস না যে বাচ্চাটার তোর। লোকে জানলে ঝামেলা করব’।
নুপুর মাথা কাৎ করে সায় জানায়। জটলার কাছে গিয়ে শুনতে পায় লোকে বলাবলি করছে-
-আহারে! বাচ্চাটারে লবণ খাওয়াইয়া মারছে।
-হ! হারামির পয়দা না হইলে এমন কইরা কেউ বাচ্চারে মারে?
-কে যে লাশটা দুধের কৌটায় কইরা রাইখা গেছে।
-আহারে! কেমন কইরা মারলো বাচ্চাটারে?
-দেখেন না? মুখ ভরতি লবণ? লবণ দিয়া মারছে।
-বাচ্চাডারে কি করুম?
-এইখানেই গর্ত কইরা মাটি চাপা দেই।
-হ এইটাই ঠিক হইব। কার না কার বাচ্চা কেডা জানে।
লবণ দিয়ে মারার কথা শুনে নুপুরের সারা শরীর শক্ত হয়ে যায়। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে শেষবারের মত এক ঝলক দেখে নেয় তার নাড়িছেড়া ধনকে। ঘাসের উপরে ফেলে রাখা এতটুকু একটা বাচ্চার লাশ। শীতে নীল হয়ে গেছে শরীর। পাশে বড় একটা দুধের কৌটা। এক ঝলক দেখেই নুপুর সরে আসে। ওখানেই দেখে এক লোক কোদাল নিয়ে এসে মাটি কোপাতে শুরু করে। এক মহিলা একটা ছেড়া শাড়ির টুকরা দিয়ে বাচ্চাটার শরীর মুড়ে দেয়। অল্পক্ষণের মধ্যেই বাচ্চাটাকে মাটি চাপা দেয়া হল। মানুষকে কবর দেয়ার মত নয়। মরা বিড়াল বা কুকুরকে আমরা যেভাবে মাটি চাপা দেই সেভাবে। নুপুরকে একরকম জোর করে ধরে শাহানা নিয়ে আসে। নুপুর এমন শক্ত দেখে শাহানা মনে মনে ভয় পেয়ে যায়। মেয়ে যদি কিছু করে বসে আবার? শাহানার বুক কাঁপতে থাকে।
-নুপুর চল বাসায় যাই।
: আপনি যান আমি আমি যামু না।
-যাবি না মানে?
: হ মামী। আমি আর শহরে থাকুম না। গেরামে মার কাছে চইলা যামু।
-যাবি পরে যাইস। তোর শইল ভালা না।
: না মামী। আমি অখনই যাব। আমার আর শইল। সব শেষ হইয়া গেছে। আমি তো এখন বাজারের নটী বেটি হইয়া গেছি।
-তুই এইগুলা কি কস নুপুর?
: ঠিকি কই মামী। আমার বালিশের নিচে কয়টা ট্যাকা আছে। আইনা দেন। আমি চইলা যাই। আমার এইখানে আর না থাকলেও চলব।
অগত্যা শাহানা উপায় না দেখে নুপুরের হাতে টাকা গুজে দিয়ে একটা রিক্সা ডেকে তাতে উঠিয়ে দেয়। শাহানা’র বাইরে থাকার উপায় নেই। মেয়ে কাঁদছে। মেয়েকে দুধ খাওয়াতে হবে। রিক্সায় উঠার আগে নুপুরকে জড়িয়ে ধরে শাহানা কাঁদে কিছুক্ষণ। নুপুর একটুও কাঁদে না। মামী শিখিয়ে দেয়, বেশী ব্যথা করলে দুধ গেলে ফেলে দিতে। কেউ যেন টের না পায়। নুপুর রিক্সায় উঠে বসে।
***
বিশাল একটা মাটির স্তুপের সামনে নুপুর আর তার স্বামী সুরুজ আলী দাঁড়ায়ে আছে। সুরুজের কোলে তার ছেলে ঘুমিয়ে। জমিটাতে বাড়ি বানানোর কাজ শুরু হয়েছে। নুপুর আতিপাতি করে খুঁজেও জায়গাটা দেখতে পায় না। সব জায়গার মাটি খুঁড়ে ফেলা হয়েছে।
-কি দেখতে আইলা? সুরুজ মিয়া প্রশ্ন করে।
: আমার পোলারে।
-সে তো আমার কোলে ঘুমায়।
সুরুজের কোল থেকে নুপুর বাচ্চাটাকে নিজের কোলে তুলে নেয়। বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘হ ঘুমাইতাছে। কেউ দুধ খাইয়া ঘুমায় আর কেউ লবণ খাইয়া ঘুমায়’। নুপুরের এই কথার কোন মানে সুরুজ মিয়া ধরতে পারে না। মাঝে মাঝে নিজের বৌকে তার অনেক রহস্যময় মনে হয়।