নীল দ্বি-মানুষ

***

 ‘এটা তো খুশির খবর পলিন! তুই মন খারাপ করে আছিস কেন? পুরোনো কথা মনে করে কি হবে এখন? যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এটা ভেবে খুশি হ যে তোর উপর থেকে বড় একটা বিপদ কেটে গেছে। তুই বেঁচে থাকবি এতেই আমরা খুশি। হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে ফেরার পথে ফ্লোরিডার হাইওয়ে ধরে গাড়ি চালাতে চালাতে পাশে বসে থাকা ছোট বোনের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললো কেনেথ। কিন্তু পলিনের কোন দিকেই মন নেই। চোখ মুখ শক্ত করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। দুই চোখ দিয়ে নেমে চলেছে পানির ধারা। ভাই এর কথাগুলো শুনেছে বলেও বোঝার উপায় নেই।

 

আমি ভেবে পাই না, তুই যে ইন্ডিয়া থেকে ট্রিটমেন্ট নিয়ে এলি, কই তারা তো তোর রোগ ধরতে পারলো না। উল্টো আরো সময় ধরে দিল বড়জোর দুই মাস। এটা কোন কথা হল? মানুষ এভাবে বলে কি করে? এদের বিরুদ্ধে কেস করে দেয়া উচিত। রাগত স্বরে আবার কথাগুলো বলে গেলো কেনেথ। এবারো বোনের কাছ থেকে উত্তরের প্রত্যাশা না রেখেই। ভাগ্যিস, তোর সাথে আমি যোগাযোগ করে তোকে আনার ব্যবস্থা করেছিলাম। তুইও যেন কেমন হয়ে গেলি পলিন। আমাকে এমন পর ভাবলি কি করে? তোর সব কথা জানার পর, আমি কি তোর সাথে যোগাযোগ রাখি নি? তুই তো আমাকে বলতে পারতি তোর কথা

 

দাদা, কি যেন বললি? কেস করা দরকার না? ঠিকি বলেছিস। খুন করলে তার বিচার হবার দরকার। আমি বিচার চাই দাদা। পলিন কথাগুলো কোনরকমে বলেই আবার হুহু করে কেঁদে উঠলো।

 

যা হবার হয়ে গেছে। তুই বেঁচে আছিস, থাকবি। আবার নতুন করে জীবন শুরু কর। নিজেকে নিয়ে ভাব। তুই আমার কাছে থেকে যা। আমি তোর জন্য এখানে কোন একটা কাজ দেখি। তুই না হয় আমাদের দোকানটাই দেখলি তোর বৌদির সাথে। থেকে যা না আমাদের এখানে। বোনের আর কোন সাড়াশব্দ বা দেখে অগত্যা এতটুকু বলেই চুপ হয়ে যেতে হল কেনেথের।

 

 

 

***

দুইবার কলিংবেল বাজার পরে জবা দরজা খুলে দিল। জবার ওড়না ধরে সিমি দাঁড়িয়ে মায়ের দিয়ে তাকিয়ে হাসলো। সিমির বয়স এখন সতের চলছে। মেয়েটা স্বাভাবিক নয়। জন্মের পরপরই বুঝতে পারেনি পলিন। বোঝার মত মনমানসিকতাও ছিল না তখন। ধর্মের দোহাই দিয়ে সৌমিত্রের পরিবার গ্রহন করলো না পলিনকে। সৌমিত্রের নির্লজ্জ কাপুরুষতা দেখে, পলিনও তাকে বলেনি যে সে অন্তঃসত্ত্বা। এগুলো সেই আঠারো বছর আগের কথা। সৌমিত্রের কথা এখন আর তেমন মনেও পড়ে না পলিনের। সিমিকে শুধুই নিজের অংশ বলে মনে হয়। মেয়েটা জন্ম থেকেই জড়মানসিকতার। কথা বলতে পারে না। হাটা শিখেছে সাড়ে তিন বছর বয়সে। সেই চার বছর বয়সে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে সিমির। তখন থেকেই নিয়মিত দুই বেলা ইন্সুলিন দিতে হয়ে। মাকে দেখলেই অদ্ভুত ভাবে হাসে।  মাঝে মাঝে নিজের মত করে কি যেন বলতে চায়। ইন্সুলিন এর সিরিঞ্জ হাতে দেখলে নিজেই হাত বাড়িয়ে দেয় সিমি। মায়ের হাতে ইন্সুলিন নিতে কোন আপত্তি করে না এখন। নিজে খেতে চায় না। পলিন মাঝে মাঝে খাইয়ে দেয়। পলিন অফিসে থাকলে জবা ছাড়া সিমিকে দেখে রাখার মত কেউ নেই। পলিন খুব একা।

 

দিদি, খাইবা না? কয়েকবার ডাকাডাকি করে সাড়া পেল না জবা। শোবার ঘরে গিয়ে দেখে ঘর অন্ধকার করে পলিন শুয়ে আছে। আবার ডাকতে পলিন বলল, সিমিকে খাইয়ে দিতে। জবা জানালো সিমির খাওয়া শেষ। ইন্সুলিন দিয়ে দিতে হবে। পলিন জবাকে বলল, তুই শুয়ে পড় জবা। আমি দিয়ে দিব একটু পরে

 

সিমি মেঝেতেই খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছে। পলিন সিমিকে ধরে খাটে উঠিয়ে দিল। মেয়ের কপালে একটা চুমু দিল। ইচ্ছা ছিল মেয়েটাকে একটু জড়িয়ে ধরে। কিন্তু সিমি জেগে যেতে পারে। ঘুম থেকে উঠে গেলে সিমি চিৎকার করতে পারে। জেগে থাকলে মাকে দেখলে একটা হাসি দিত আর হাত বাড়িয়ে দিত ইন্সুলিন নেবার জন্য। খাটে শোয়ানোর পরে সিমির ডান হাতটা ঝুলছিল। পলিন উঠিয়ে দিল। ঘুমন্ত মেয়েটার মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে দুই হাতে নিজের মুখ ঢেকে পলিন ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। টেবিলে রাখা সিরিঞ্জটা তুলে নিয়ে তরলটুকু ঘুমন্ত সিমির হাতে দিয়ে দিল পলিন। মেয়েটা একটু হাসলো ঘুমের মধ্যেই। মেয়ের কপালে আবার চুমু দিয়ে পলিন।

 

***

ফাদারের প্রার্থনা শেষ করার পরে কফিন ঢেকে দেয়া হল মাটি দিয়ে। জবা অঝোরে কাদছিল। পলিন যেন পাথর হয়ে গেছে একেবারে। সৌমিত্রর কথা মনে পড়ে গেল পলিনের। সৌমিত্র থাকলে কি করতো এখন?

 

সিমির মৃত্যুর খবর পেয়ে একরকম জোর করেই বোনকে নিজের কাছে নিয়ে যায় কেনেথ। বোনের চিকিৎসা করায়। কয়েক মাস চিকিৎসা করার পরে সুস্থ হতে থাকে পলিন। ভাল হয়ে যায় একসময়। বোনকে নিজের কাছে রেখে দিয়ে চায়। কিন্তু পলিন রিলিজ নেয়ার কিছুদিন পরেই দেশে ফিরে আসে। পলিন দেশে যাওয়ার পরে কেনেথ একটা চিঠি পায় বোনের কাছ থেকে-

 

দাদা,

আমার পাপের শাস্তি তোরা কেউ দিতে পারবি না। আমি আমার পাপের কথা তোদের কাউকে বলে বোঝাতে পারব না। আমার কোন ক্ষমা নেই। ঈশ্বর ক্ষমা করবেন কিনা তাও আমার জানা নেই। আমার শাস্তি আমি নিজেকেই দেব। একটা অনুরোধ দাদা, আমাকে খুঁজতে আসিস না কখনো। আমাকে খুঁজে পাবি না। আমার পাপের কথা বললে হয়ত তুইও আমাকে ক্ষমা করতে পারবি না।

 

ইতি,

পলিন।

 

***

বোনের অনুরোধ রাখেনি কেনেথ। অনেক খোঁজার পরেও পলিনের কোন খোঁজ মেলেনি। কেউ কিছুই বলতে পারে না। এই ঘটনার দুই বছর পরে কেনেথ হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়। পলিনকে মনে রাখার মত আর কেউ বাকী থাকে না। 

 

 

Author's Notes/Comments: 

2nd november 2014

View shawon1982's Full Portfolio