10 February 2014

 

কাল রাতে নাইমা আমার লেখাটা পড়েছে। এরপর ও আমার সাথে সহানুভুতির আচরণ করছে। সেটা ও সবসময়ই করে। মাঝে মাঝে রাগারাগি করে একটু আর কি। যথারীতি কাল রাতেও রাগ করেছে। কারণ হল আমি ওর নাম কেন ই দিয়ে লিখেছি। আমাকে ঈ দিয়ে লিখতে হবে। আমি বললাম, না আমি ঈ দিয়ে লিখবো না, আমি ই দিয়েই লিখবো। কারণ তুমি আমার কাছে ‘নাইমা’। নাঈমা নও। আর ও পাল্টা উত্তরে বলল, ই দিয়ে লিখলে সেটা নাকি অন্য কোন মেয়ে হবে। ও নিজে হবে না! দারুণ complex পরিস্থিতি মনে হচ্ছে! ‘নাইমা’ শব্দটার মধ্যে একটা কোমলতা আছে। আর ‘নাঈমা’ এর মধ্যে আছে একটা সুস্পষ্ট রুক্ষতা। আমি আমার নাইমা’কে কোমল ভাবেই দেখতে চাই। রুক্ষ ভাবে নয়।

 

আজ সকালে নাইমার সাথে অনেক রকম কথা হল। আমাকদের ক্যারিয়ার, কি করব না করব এইসব নিয়ে। আমাদের বর্তমানের পরিস্থিতি নিয়ে নাইমা বলল, আমরা যেই পরিস্থিতিতে আছি, তাতে না পারছি নিচে নামতে আর না পারছি উপরে উঠতে। আমাদের মত মধ্যবিত্তদের এটাই সবচাইতে বড় সমস্যা। না আমরা নিম্ন বিত্তদের মত আচরন করতে পারি আর না উচ্চবিত্তদের মত যা খুশি তাই করে বসতে পারি। এবার আমি আমার কিছু কথাবলি। আমাদের বিয়ের প্রায় ৫ বছর হতে চলল। এই ৫ বছরেও আমাদের একটা নিজের সংসার হল না। বাবা মায়ের সংসারে থাকছি। এখানে তো চাইলেই নিজেদের মত থাকা যায় না। নাইমা ছোটবেলা থেকেই যৌথ সংসারে থেকে অভ্যস্ত। ও নিজেকে যতটা মানিয়ে নিতে পারে আমি ততটা পারি না। সত্যি কথাবলতে দোষ নেই। আমি সবসময় আমাদের সিঙ্গাপুরের সেই ১ বছরের সংসার টাকে miss করি। মাহবুব ভাই এর ভাড়া বাসায় ছিলাম কিন্তু তাও সেটাকে নিজের সংসার বলেই মনে হত। অথচ এখন বাবা মায়ের সংসারে থেকেও নিজেকে সবসময় পর পর লাগে। সরাসরি হোক আর ইঙ্গিতে হোক, প্রতিনিয়তই আমাকে শুনোট হয় ‘আমি বেকার’। আব্বু মাঝে মাঝে আমাকে পরামর্শের মত করে শিখায়ে দেয়, মঞ্জু স্যার সহ অন্যান্য স্যারদের কাছে গিয়ে যেন আমি বল, ‘স্যার বেকারই তো বসে আছি! আমার তো নিজের সংসার(!) আছে। আমার তো প্রয়োজন আছে। তাই সম্ভব হলে আমাকে একটা tuition খুজে দেন। আমার প্রয়োজন যেন আমি পুরন করতে পারি’। অনেক ভাল পরামর্শ। অন্তত প্রথমদিকে শুনলে তাই মনে হয়। কিন্তু যে বেকার? তার কাছে কেমন লাগে? আমার কাছে কেমন লাগে? মনে হয় যেন, নিজেকে নীচে নামাতে নামাতে আর কত নিচে নামাবো? নিজেকে অন্যদের কাছে ফকিরের মত করে উপস্থাপন করে অনেকটা ভিক্ষার মত হাত বাড়িয়ে দেয়া! আমি তো এটা পারি না। আমার মন আমাকে এমন করতে কিছুতেই সায় দেয় না। নিজের প্রয়োজন নিয়ে কারো কাছে যখন বসে থেকে হাসিমুখে কথা বলতে হয়, তখন মুখের ঐ মেকি হাসিটুকু আনতে যে কি পরিমাণ কষ্ট হয় সেটা আমার মত বেকার না হলে বোঝা যাবে না। আমি বেকার তো তাই আমি এগুলা বুঝতে পারি।

 

নাইমা হয়ত কখনও ভাবে নাই, যে একজন PhD holder ব্যক্তিকে বিয়ে করে ওর জীবনে এই দুর্গতি হতে পারে। ও হয়ত ভেবেছিল ভাল লেখাপড়া আছে, ভাল চাকরি করবে, ভাল টাকা পয়সা হবে! কিন্তু নাইমা’র এই আশায় ত গুড়ে-বালি! কি ভেবেছিল আর কি হল? একজন PhD holder বেকার এর সাথে সংসার করা, এবং সেই বেকার লোকটার বাচ্চা পেটে ধরা- এটা যে কি পরিমাণ মানসিক দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে সেটা হয়ত আমি বুঝবো না; নাইমা ঠিকই হাড়ে হাড়ে বুঝে নিচ্ছে। শ্বশুর বাড়িতে না খেয়ে নেই; কিন্তু স্বামীর বেকারত্বের কষ্ট সে প্রতিনিয়ত টীর পাচ্ছে। বেকার স্বামী তার গর্ভবতী স্ত্রীর যন্ত্রনা লাঘবের জন্য কিছুই করতে পারছে না। উচ্চশিক্ষার এই বিড়ম্বনার কথা নাইমা তার সমগ্রা জীবনে হয়ত কখনও জানতো না। জানলে হয়ত আমাকে বিয়ে করতে রাজি হত না। সেটা হয়ত ওর জন্য ভালই হত। ওর জন্য সম্বন্ধের তো কোন অভাব ছিল না। থাকলে আমার ছিল।

 

জোহরের নামাজ পড়ে সারওয়ার স্যার এর কাছে ৩ টা CV এর Xerox copy জমে দিয়ে আসলাম। উনি আমার জন্য অনেক আন্তরিকতা দেখাচ্ছেন। গত সপ্তাহে আমাকে নিজেই নিয়ে গেলেন BUBT তে। এখনও আমার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমি টিউশনি করতে চাই শুনে উনি একটু মনোক্ষুণ্ন হলেন। বলেই বসলেন, ‘ছিঃ! এসব আপনার জন্য না! আপনি কেন এসব করবেন?’ উনি আমার জন্য ভালো চাকুরির চেষ্টা করছেন। আমি বললাম, (হাসিমুখে)- স্যার, বসেই তো থাকি! যদি আপনার কাছে কেউ সায়েন্স এর কোন সাব্জেক্ট পড়তে চায় তাহলে আমার কথা বলবেন’। সারওয়ার স্যার বললেন, আমাকে জানাবেন। আমাকে নিজের ভাতিজা পরিচয় দিতে উনি গর্ববোধ করেন- সেটাও আমাকে জানালেন।

 

ভোর রাত থেকে সিধান্ত নিয়ে রোজা রাখা শুরু করেছি। নিজের আত্মশুদ্ধি এবং মানসিক দৈন্যতা থেকে প্ররিত্রান পেতে চাই। পাপবোধ আর হতাশার গ্লানি থেকেও মুক্তি পেতে চাই। অনেকবার নিয়ত করে করেও আমি যে কাজে সফল হতে পারিনি, আজ থেকে আবার সেই হাফেজি পড়া শুরু করার নিয়ত করেছি। দেখি না চেষ্টা করে কি হয়। দেশে আসার পরে কেউ আমাকে হাফেজি পড়ার ব্যাপারে কোনরকম সহায়তা করলো না। সিঙ্গাপুর থেকে নানা রকম আশ্বাস বাণী শুনে ধোকায় পড়ে গিয়েছিলাম। আমার সেই ধোকা আর মোহ কেটে যাচ্ছে। দূর থেকে আশ্বাস দেয়া অনেক সহজ কিন্তু কাছে আসলে সেটা বাস্তুবায়ন করা এমনই অসম্ভব হয়ে যায় যেন- পরিচিত মানুষকেও আর চেনা যায় না। নিজের হতাশাগুলাকে ধামাচাপা দিতে এর চাইতে ভাল কি হতে পারে। মারা যাবার আগে অন্তত নিজেকে হাফেজ হিসাবে দেখতে চাই। সুপ্ত ইচ্ছাটাকে অদম্য ইচ্ছায় রুপান্তর করতে হবে। এখানে কেউ সহযোগী হবে না আমার। নাইমাকে শুধু দেখেছি এই ব্যাপারে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু টাকা পয়সার দৈন্যতা যখন সামনে এসে যায় তখন এই ভাল বাসনা গুলাও কল্পনার বিলাসিতা মনে হয়। আব্বু আম্মুর কাছ থেকে হাফেজি পড়ার ব্যাপারে কোনরকম কোন সমর্থন পেলাম না। কারণ আমি তো বেকার। তার উপরে এখন তো আমার বাচ্চা আসছে। এখন টাকা পয়সাই বড় জিনিস। হাফেজি পড়ে এসব আসবে কোথা থেকে?

View shawon1982's Full Portfolio