শেষ হয়ে গেলো বিশ্ব ইস্তেমা-২০১৪। কয়েকদিনব পরে লিখতে বসলাম। আমরা ছিলাম ইস্তেমা’র ২য় ভাগে। প্রথম ভাগ শুরু হয় ২৪-২৬ জানুয়ারী আর ২য় ভাগ শুরু হয় ৩১ জানুয়ারী-২রা ফেব্রুয়ারী। ইস্তেমাতে লোক আগে চলে আসে বলে বৃহস্পতিবার ফজরের নামাজের পর থেকে বয়ান শুরু হয়ে যায়। আমি আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম যে বুধবার রাতেই চলে যাব মুহিতদের সাথে ওদের মাসজিদের সাথীদের সাথে মিলে। যাই হোক, ইস্তেমা থেকে আসার পরেও দুই দিন পরে লিখতে বসলাম। এই কয়দিনে ঘটে যাওয়া কিছু কিছু ঘটনা আর স্মৃতি নিয়ে এখন লিখতে বসলাম। আমার আজকের লেখা শুরু হবে ইস্তেমাতে যাওয়ার কাহিনী নিয়ে।
আমার সাথে রাতে যাবার সিন্ধান্ত নিয়েছিল আব্দুল হক চাচা, মোশারফ ভাই আর ডাঃ আজমল ভাই। রাত ৮:৩০ এ আমরা সেনপাড়া মাসজিদে গেলাম। ওখানে যাবার কিছুক্ষণ করে একটা human-hauler নিয়ে আসে। ওখানে আমরা সবাই উঠে বসলাম। মুহিত সহ আরো দুই একটা ছেলে গেটের কাছে দাঁড়ালো। কারো মধ্যে উৎসাহের কোন কমতি ছিল না। ১০ নাম্বার গোলচক্করের কাছে যাবার পরে তোফায়েল সহ কয়েকজন বলল, নোবেল আসছে। ওর জন্য দাঁড়ানো হল। ও আসার পরে গাড়ি ছেড়ে দিল। আমরা মহা উৎসাহে দোয়া কালামের সাথে যেতে লাগলাম। গাড়ির ভিতরে বিস্কুট খাওয়া হল। দাওয়াতে-তাবলিগের সমস্ত সাথীদের স্বপ্ন থাকে বিশ্ব ইস্তেমাতে শরীক থাকার জন্য। কোন কষ্টই কষ্ট মনে হয় না। আমরা টঙ্গী স্টেশন রোড এ নেমে মাঠে চলে গেলাম। মুল রাস্তা থেকে বেশী দূরে ছিল না। আমরা ছিলাম টঙ্গী মাঠের ৫ নং টয়লেটের খুব কাছে ৭ নাম্বার রাস্তার ধারে। আর আমাদের খুঁটির নাম্বার ছিল ৫২১১, খেত্তা নং ৩। আর বায়তুল কারার অর্থাৎ আমাদের মাসজিদের জন্য নির্ধারিত ছিল ৩৪ ও ৩৫ নং খোপ। আমরা নির্দিষ্ট খোপে গিয়েই তেরপল বিছিয়ে দিলাম। সামিয়ানা টাঙ্গানোর দরকার ছিল না। প্রথম বার ইস্তেমাতে যারা ছিল, তারা রেখে গিয়েছিল কাকরাইলের মাশোয়ারার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। আমরা বেশী দেরী না করে শুয়ে পড়লাম। আমাদের দুই খোপে আমরা মাত্র ৪ জন রইলাম পাহারা দেবার জন্য। আর মুহিতরা ছিল অনেকেই। ঘুমাতে ঘুমাতে প্রায় ১২ টা বেজে গেল। ঠান্ডার প্রকোপ টের পাচ্ছিলাম তখন থেকেই। কম্বলটা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। প্রচন্ড মশার উৎপাতে ঘুমানোটা অনেকতাই অসম্ভব হয়ে গেলো। কিছুতেই ঘুম আসছিল না। মুখের উপরে গামছা দিয়ে দিলাম। কয়েকবার এপাশ ওপাশ করলাম। কোনভাবে ঘুম আসে না। ঠান্ডাও লাগতে লাগলো বেশ ভালো মতই। রাত ২ তার দিকে বেডিং এর উপরে উঠে বসে রইলাম। ভাবলাম কি করা যায়? বসে বসে প্রায় ২০-২৫ টার মত মশা মারলাম। যারা তখনো ময়দানে আসছিল, তাদের নানা রকম কথাবার্তা কানে আসছিল। এরপর আবার শুয়ে পড়লাম। এপাশ ওপাশ করতে করতে ৫ টা বেজে গেলো। উঠে পড়লাম ফজরের নামাজ পড়ার জন্য।
অযু করে এসে সিদ্ধান্ত নিলাম যে স্টেজ এর কাছে গিয়ে ওলামা হজরতদের দেখে দেখে উনাদের বয়ান শুনবো। আর তখনো মাঠের ভিতরে অনেক জায়গাই খালি ছিল। কাজেই ভয় ছিল মূল জামাতে নামাজ পড়া সম্ভব হবে না। তাই মুল জামাতে নামাজ পড়ার জন্য প্রায় আধা-ঘন্টা চেষ্টার পরে স্টেজের কাছে পৌঁছাতে পেরেছিলাম। আল্লহ পাকের দয়া। নামাজের পরে বয়েন করলেন পাকিস্তান থেকে আসা ভাই ফারুক সাহেব। উনার সাথে তররমা করলেন মাওলানা আব্দুল মতিন সাহেব। এই বয়ানে মাঠে আমাদের করনীয় কাজ এবং গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেন উনারা। বয়ান শেষ হবার পরে আবার ফিরে আসি আমাদের যায়গায়। কিন্তু আমি ঠিন পথে যাই নি। ফলে বেশ অনেকটা ঘুরে যেতে হল। ক্ষুধাও লেগে গেছিল কিছুটা। গিয়ে দেখি মুহিত আর তোফায়েল একটা প্লেটে খেতে বসেছে। আর সামান্য কিছু খাবারই বাকী ছিল। আমাকে মুহিত ডাক দিয়ে খেতে বলল। ওদের সাথে বসে খেয়ে নিলাম খিছুড়ি।
১১ টার দিকে আমাদের মাসজিদের সাথীরা চলে এলেন। আমরা জোহরের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। ডঃ নাজিম স্যার এর নেতৃত্বে আরো কয়েকজন সাথী খেদমতে নেমে গেলেন। আমার নিজের খেদমত করতে মন চাইলেও ইস্তেমার ময়দানে খেদমত করতে আমি খুব একটা ইচ্ছুক ছিলাম না। কারন হল, আমি ২০০৭ এর পরে এই প্রথম পূর্ণাঙ্গ কোন ইস্তেমাতে শরিক হবার সুযোগ পেলাম। আমি চাইছিলাম না কোন একটা বয়ান শোনা থেকে বঞ্চিত হই। আমি আমার এই দৈন্যতার জন্য আল্লহ পাক এর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। জোহরের নামাজের আগে আবার স্টেজ এর কাছে চলে গেলাম। রাতের ঘুম না হওয়া ক্লান্তি কাজ করছিল ভীষণভাবে কিন্তু সেদিকে মন দেয়ার মত মানসিকতা কাজ করছিল না। জোহরের নামাজের পরে বয়ান করলেন বাংলাদেশের মাওলানা ফারুক সাহেব। উনার বয়ানের একটা অংশে না হেসে পারি নাই। আমি সব বয়ানের উল্লেখযোগ্য অংশ লিখে রাখতে শুরু করলাম। মাওলানা ফারুক সাহেব বয়ানের শেষভাগের দিকে বললেন, ‘এক লোক আছে, যাকে বললাম, কিভাবে নামাজ পড়লেন? উনি বললেন, যেভাবে শিখছি শেইভাবে পড়ছি! আমি বললাম, কেন, হুজুরের তরীকায় পড়েন নাই? উনি বললেন, না! সেটা তো পারি না; যেভাবে শিখসি সেভাবেই পড়ছি। তখন বললাম, তাহলে হুজুরের তরীকায় নামাজ শিখেন। উনি বলেন, না আমার তো শেখার সময় নাই। আমি যেভাবে শিখছি সেভাবেই পড়ি...’। এই জাতীয় আর কিছু কথা বললেন। হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। আমার আশেপাশের লোকও হেসে দিল।
দুপুরের বয়ানের পরে মনে হল, আমি আর আপাতত আমাদের প্যান্ডেলে ফিরে যাবো না। যা হয় হোক। বাইরে থেকে কিছু খেয়ে নিয়ে আবার বয়েন শুনতে বসে যাব। কারন তখন প্রায় ৩:৩০ বেজে গেছে। বাইরে অনেক ঘুরার পরে রাস্তায় বের হয়ে হোটের খুজতে বের হলাম। ভালো হোটেল একটাও পেলাম না। শেষমেষ অনেক দূরে গিয়ে এক দোকানে বসে বনরুটি, সাগর কলা, 7up 1 liter আর এক কাপ লাল চা খেলাম। এরপরে আবার বয়ানের জন্য স্টেজ এর কাছে চলে এলাম। আসরের নামাজের পর বয়ান করলেন মাওলানা মাহবুব সাহেব (বাংলাদেশ) আর মাগরিবের পর বয়ান করলেম পাকিস্তানের আমির এবং তাবলীগ জামাতের সবচেয়ে পুরানো মুরব্বী আব্দুল ওয়াহাব সাহেব। উনি উনার বয়ানের শুরুতে সালাম দিলেন। তর্জমা করলেন মাওলানা নুরুর রহমান সাহেব। আব্দুল ওয়াহাব সাহেবকে ২০০৯ এ মালেশিয়া আর সিঙ্গাপুরে যেমন দেখেছিলাম ওমনই দেখলাম। এশার নামাজ পড়ে আমাদের জামাতের কাছে চলে এলাম। এরপর রাতের খাবার খেলাম। এটা ৩০ তারিখের ঘটনা।
পরের দিন ভোরে আর গেলাম না স্টেজ এ। মাওলানা জামশেদ সাহেবের বয়ান শুনলাম। মুহিত, ওর ভাই আরিফ সহ ওদের জামাতে আরো অনেক ছাত্র ছিল ওদের জামাতে। ওরা খুব কর্মঠ ছিল। ভীষণ ভালো লাগতো ওদের খেদমত আর ওদের প্রাণ চাঞ্চল্য দেখতে। আমি বেশীর ভাগ বয়ানে ওদের কাছে গিয়েই শুনতাম। মুহিত আর ইমরান আমার সাথে বায়না ধরলো স্টেজে গিয়ে বয়ান শুনবে। কথা দিলাম আসরের দিকে নিয়ে যাব। এদিকে জুম’আর নামাজের আগে আমরা খাওয়াস বয়ান শুনতে গেলাম। বয়ান করলেন মাওলানা আহমদ লাট সাহেব। বিকালে মুহিত আর ইমরানকে নিয়ে গেলাম স্টেজের কাছে। কিন্তু আসরের আগ দিয়ে ভীষণ ভীড় গয়ে গেলো। আসরের বয়ান করলেন দিল্লির মাওলানা জুবায়ের সাহেব। উনি বসলেন ইনার হুইল চেয়ারেই মেম্বরের পাশে। উনার সাথে তর্জমা করলেন বাংলাদেশের মাগলানা জুবায়ের সাহেব। উনি বসলেন, মেম্বরের উপরেই। দোয়া ও জিকিরের গুরুত্বের উপরে বয়ান হল। এরপর মাগরিবের নামাজের সময় হয়ে গেল ধুন্ধুমার ঘটনা। এত মানুষ জড়ো হয়ে গেলো যে, স্টেজের সামনে নামাজের কাতারে তিন ধারণের জায়গাও রইলো না। কোত্থেকে যেন একদল লোক জায়গা না পেয়ে আমাদের আর আমাদের সামনের কাতারের মাঝখানেই নিয়ম ভঙ্গ করে নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে গেলো। ওদের সাথে আমাদের কয়েকজনের কিছু কথা কাটাকাটি হল এই নিয়ে। কিন্তু ওরা শুনলো না। ওভাবেই দুই কাতারের মাঝখানে নামাজ পড়ে নিল। মাগরিবের পরে বয়ান করলেন মাওলানা সাদ সাহেব আর উনার সাথে তর্জমা করলেন, মাওলানা জুবায়ের সাহেব। এত মানুষের ভিড় ছিল যে, সামান্য নড়ে বসারও সুযোগ ছিল না। কোমরে খুব ব্যথা হয়ে গেলো। মুহিত বয়ানের মাঝখানেই কয়েক দফা ঘুমালো আমার পিঠে একটু একটু মাথা দিয়ে। সারাদিন খেদমতের কাজ করে বেচারা একেবারেই ক্লান্ত ছিল। বয়ানের পরে আমরা আমাদের জায়গায় ফেরত চলে এলাম।
পরের দিন ছিল ১লা ফেব্রুয়ারী। সাদ এর জন্মদিনও ছিল। কিন্তু নানাবিধ ব্যস্ততার কারণে ওকে আর শুভেচ্ছা জানানো হয় নাই। ফজরে বয়ান করলেন আব্দুল ওয়াহাব সাহেব। জোহরের বয়ান করলেম মাওলানা ইসমাইল সাহেব। উনার সাথে তর্জমা করলেন মাওলানা মাহবুব সাহেব। দুপুরের বয়ানে মানুষ এত খাবার নিয়ে ব্যস্ত থাকে যে কেউ বয়ানে মন দেয় না। মানুষ এত বেশী কথা বলতে থাকে যে, বয়ান শোনা মুশকিল হয়ে পড়ে।
আসরের পরে বিয়ের বয়ান ও খুতবা পড়লেন দিল্লির মাওলানা জুবায়ের সাহেব। তর্জমা করলেন বাংলাদেশের মাওলানা জুবায়ের সাহেব। অল্প সময় বয়ান হল। এর আগে আমি বিয়ের বয়ান এত কম শুনি নাই। এবারই খুব সংক্ষেপে হল বিয়ের বয়ান। এরপরে বিয়ে পড়ানো শুরু হল। আমি বিয়ের খুতবাটুকু আমার মোবাইলে রেকর্ডিং করে নিলাম। মাগরিবের পরে বয়ান করলেন মাওলানা আহমদ লাট সাহেব। আমি শুনেছিলাম, বাংলাদেশের মাওলানা ওমর ফারুক সাহেব অসুস্থ উনি নাকি তর্জমা নাও করতে পারবেন। পরে দেখলাম, আল্লহ পাকের দয়ায় মাওলানা ওমর ফারুক সাহেব তর্জমা করলেন।
পরের দিন রবিবার, ইস্তেমা’র শেষের দিন। সকালে ফজরের আধা ঘন্টা পরে হেদায়তের বয়ান শুরু করেন মাওলানা সাদ সাহেব আর তর্জমা করলেন মাওলানা জুবায়ের সাহেব। এরপর সকাল ৯:৩০ এর দিকে আসেন দিল্লির মাওলানা জুবায়ের সাহেব। দোয়া শুরু করেন ৯:৪৫। আমি নাইমাকে কল দিয়ে দোয়ার কথা বললাম। কিন্তু ও বলল যে কারেন্ট নাই। আমরা দোয়া শেষ করে ময়দান থেকে চলে আসলাম। আজ আর লিখব না। বাকী কথা না হয় পরে লেখা যাবে। মশা কামড়াচ্ছে ভীষণভাবে।
আব্বু আর মিল্টন ভাই শনিবারে আসরের আগে ময়দানে গেছিল। ওইদিন রাতে আমাদের মহল্লা থেকে না বলা কওয়া অনেক লোক গিয়ে হাজির হয়। এটা শুধু আমাদের এলাকাতেই নয় বরং সন জায়গাতেই একি অবস্থা ছিল। ময়দানে যেখানে আমরাই ঘুমানোর যায়গা পাই না সেখানে এতগুলা আনকোরা মানুষ দেখলে একটু রাগ লাগতেই পারে। জাই হোক, আবু আর মিল্টন ভাই আমাদের খোপ এর পশ্চিম দিকের খোপ এ সিরাজউদ্দৌলা আঙ্কেল এর সাথে শোবার জায়গা পেয়ে গেলো। অন্যদের যে কি দশা হল সেটা আমি জানি না। আমি নিজে ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। আমার বেডিং এর জায়গা কেই দখল দিতে সাহস পায় না। এটাই আমার একটু স্বস্তি ছিল। আমি আমার মত ঘুমিয়ে গেলাম। সারাদিন যতবার বয়ান হয়েছে, আমি মুহিতদের কাছে গিয়ে বয়ান শুনেছি। একই ধরণের মানসিকতা বলে একটা কথা আছে। ওদের সাথে বয়ান শুনেছি, এটা আমার জন্য ভালই হয়েছে। কিন্তু আসেপাশের লোকগুলা এত বেশী কথাবলে যে খুবই বিরক্ত লাগতো।
দোয়ার পরে আমি আব্বু আর মিল্টন ভাই এর সাথে চলে আসি সাদের বন্ধু জয়নালদের বাসায়। রাস্তায় কোন রিক্সা পাওয়া গেলো না। ওদের বাসা পর্যন্ত আমাদের হেটেই যেতে হল। ওদের বাসায় গিয়ে জোহরের নামাজ পড়লাম আর দুপুরের খাবার খেয়ে ৩ টার দিকে রওনা দিয়ে বাসায় চলে আসি। সন্ধ্যার সময় আবার শহিদুল ইসলাম স্যারের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল বিলাস ভবন কমিউনিটি সেন্টার এ। ওখানে যাওয়ারও ব্যাপার ছিল। সন্ধ্যায় আব্বু আমাকে বিলাস বভনে নামিয়ে দিয়ে আসে। বেশ ভালই লাগলো বিয়ের অনুষ্ঠানটা। দুই পক্ষ মিলে আয়োজন করে বিয়ের অনুষ্ঠান। এরপরে আব্বুর অফিসে গিয়ে আম্মুর ট্রিটমেন্ট এর ব্যাপারে আলাপ করা হল। সিদ্ধান্ত হল উনাকে ৩ তারিখে ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যাওয়া হবে।
৩ তারিখে রাস্তায় মুহিতের ভাই আরিফ এর সাথে দেখা। ভাগ্নিকে স্কুল থেকে নিয়ে যাচ্ছিল বাসায়। ওর সাথে নাম্বার বিনিময় হল। বিকালে আমাদের ২য় গাস্থ ছিল BRTA মাসজিদে। ওখানে আসরের নামাজ পড়ে গাস্থে শরিক হলাম। আমি ইস্তেগবাল এর দায়িত্বে ছিলাম। মাগরিবের পরে বয়ানও আমার ছিল। গাস্থ শেষ করে বাসায় এসে দেখি আব্বু, মিল্টন ভাই, নাইমা, আম্মু সহ সবাই অপেক্ষা করছে আমার জন্য। ডাক্তার এর কাছে যেতে হবে। ফেরার পরে নঈম আঙ্কেলদের বাসাত থেকেও ঘুরে আসা হবে কারণ সম্প্রতি আঙ্কেলের ডান কিডনিতে পাথর আর টিউমার একসাথে ধরা পড়েছে। চা খেয়ে উঠে পড়লাম। ল্যাব এইডে ডাঃ ফারুক আলাম সাহেবের চেম্বারে আম্মুর সাথে আমি আর আনিমাও গেলাম। ওখান থেকে গেলাম ধানমন্ডি শঙ্করে নঈম আঙ্কেলদের বাসায়। আন্টি নাস্তার সাথে চকলেট খেতে দিল। গোল গোল চকলেটের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ। আমি বিস্কুট সহ একটা পেলাম। নাইমা ৪-৫ টা খেয়েও বিস্কুট পেল না। এই নিয়ে হাসাহাসি হল। মিল্টন ভাই অবশ্য একটা বিস্কুট পেল শেষের দিকে। আম্মু তো প্রথমে যেতেই চায় নি উনাদের বাসায়। এটা অবশ্য তার অসুস্থতার একটা বহিঃপ্রকাশ ছিল। অনেক বুঝায়ে ঊনাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাসায় আসার পরে যেই জাতীয় ঘটনার অবতারণা হল সেটা আমাদের কারো কাম্য ছিল না।
রাতে খেতে বসছি। টেবিলে দেখলাম টমেটো আর পেয়াজ কাটা। আমাদের জন্য দেয়া হয়েছে মনে করে আমি সেটা ডিয়ে সালাদ বানায়ে ফেললাম। কিন্তু আম্মু বলল যে ওটা শেফার জন্য রাখা হয়েছে। আর শেফার জন্য এক বাটি মুরগির মাংশ ও রাখা হয়েছে। আম্মুর বলার ভঙ্গিটা আমার ভালো লাগে নাই। আমি টমেটোর বাটি ঠেলে সরায়ে রাখলাম। আমি বললাম, যে এই জাতীয় আচরণ করা ঠিক না। শেফার জন্য রাখা হয়েছে ব্লে আমরা খেতে পারবনা বা খেয়ে ফেললে এমন কি হবে? আম্মু বলা নাই, কওয়া নাই রান্না ঘর থেকে এসে টমেটোর পুরা বাটি আমার প্লেটের উপরে উলটে দিল। আমি আব্বু আর নাইমা থ খেয়ে গেলাম উনার এই আচরণ দেখে। রাগ সম্বরণ করতে আমার খুব কষ্ট হল। খাওয়ার শেষ দিকে আর যখনপারলাম না তখন আমি পিছনের কথা কিছু শুরু করলাম। সিঙ্গাপুরে আমার ২০১২ এর শেষের দিকে থাকার কিছু কথা বললাম। তখন যে আমি ল্যাব এ থাকতাম; কি খেতাম কই থাকতাম- সেই কথা ওই ৫ মাস সময় আব্বু আম্মু কখনও জানতে চায় নাই। আমি তুললাম সেই সব প্রসঙ্গ। এই নিয়ে রাতে অনেক কথা কাটাকাটি হল। ২০১২ এর ওই সময়ে আমি কিছু সাবান আর অন্যান্য জিনিস গিফট আকারে পাঠাই। আম্মুর মাথা ঐ সময়ে ঠিক ছিল না। নাইমার কাছে রাগের মাথায় একসময় বলেছিল যে, এই গিফট উনি ড্রেনে ফেলে দিবেন। নাইমা তখন কেদে ফেলে বলেছিল, গিফট যে ফেলে দিবেন, একবারো কি জানতে চাইছেন যে, শাওন কই থাকে কি খায়? সেটা তো জানতে চান নি, এখন গিফট ফেলে দিতে চান কেন? ... আমি পুরানো সব প্রসঙ্গ তুললাম। আমার এই কথা যে আব্বু আম্মুর জন্য লজ্জা এবং অনুশোচনা নিয়ে এসেছিল সেটা আমি পরের দিন আব্বুর কথায় বুঝতে পেরেছিলেন। যাই হোক, আমি ঠিক করে নিলাম যে, আমার সিঙ্গাপুরের থাকাকালীন ঘটনা গুলাকে একটু একটু করে লিখতে থাকো আমার এই ডায়রীর মধ্যে। ... ৩ তারিখ রাতের বেলায় এই সব কথা কাটাকাটি করে শুতে শুতে রাত ৩:৩০ বেজে গেলো। সকালে উঠতে দেরী হয়ে গেলো পরের দিন।
৪ তারিখে সকালে আমার AIM Coaching Center এ ক্লাস ছিল ৯ টা থেকে। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে চলে গেলা। ৪ তারিখ থেকে আমাদের বাসার পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে। কোচিং থেকে যখন ফিরছি তখন মাসজিদের ধারে মুহিতের সাথে দেখা। যথারীতি সেই সুন্দর হাসিমাখা মুখ! ও বলল, চুল কাতাতে যাছে। ওর বড় ভাই এর সি ভি তৈরী হয়ে ছিল। ওর মোবাইল থেকে আমার মোবাইলে ব্লু-টুথ দিয়ে ত্রান্সফার করে দিল। এটাই আমার লাইফের প্রথম ব্লু-টুথ এর ব্যবহার! ১১ টার দিকে ক্লাশ নিয়ে ফিরে আসার পরে আবু আমাকে আর নাইমাকে বলল উনার অফিসে যেতে। আব্বু তার যে কোন বিশেষ কথা অফিসে বলতে পছন্দ করেন। আর আমার কাছে এটাকে সবসময় ফরমাল মিটিং এর মত মনে হয়। অফিসে নানা ধরনের আলাপ হল। তাতে বুঝলাম আমার গত রাতের কথায় আব্বু আম্মু লজ্জিত এবং অনুতপ্ত। আমারো কিছুটা খারাপ লাগা কাজ করছিলো। আমি এই সব পুরানো প্রসং তুলতামই না যদি না আম্মু সামান্য টমেটো নিয়ে আমার সাথে এই জাতীয় ঘটনা না ঘটাতেন। অফিসে আবু জানালো একটা baby adoption এর কথা। আমি আর নাইমা বিভিন্ন প্রসং তুলে ধরে আলাপ করলাম। আব্বু খুওই আগ্রহী baby adoption এর ব্যাপারে এবং একমেয়ে বাচ্চা পালতে চায় নিজেদের মত করে। বলল, সেই সুযোগ ও নাকি আছে। খুজলে নাকি পাওয়াও যেতে পারে। আমি আর নাইমা আমাদের মতামত দিলাম। বললাম, আমাদের তো কোন সমস্যা নাই কিন্তু আমাদের সমস্ত সমস্যার মূলে আছে আম্মুর অসুস্থতা এবং উনার সার্বিক আচরণ। ওখানে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নাই। কারণ এখনও আরো সময় আছে। আমাদের প্রথম বাচ্চাটার আস্তে এখলও আরো প্রায় ৩ মাসের মত বাকী আছে। নাইমা বলল, baby adopt করলে, ও দুধ খাইয়ে দুধ মা হয়ে যাবে। এতে শরীয়তী পর্দার কোন সমস্যা হবে না এই বাচ্চা বড় হলে। আবু এটা শুনে খুবই খুশী। গতরাতের উত্তপ্ত পরিস্থিতি মনেহয় কিছুটা হলেও শান্ত হয়ে আসছিল। বাসার আসে পরেই আমাকে না খেয়েই আবার ক্লাস নেবার জন্য চলে যেতে হল। ক্লাস নিয়ে বাসায় ফিরলাম ৬:৩০ দিকে প্রায়। আমি যে খাই নাই সেটাও আমার মনে ছিল না। মুন আসছিল। আব্বুর সাথে গল্প করছিল। আমি টেবিলে ডদের পাশে বসে খেয়ে নিলাম। এরপর রাতে শেফা আসল। আমাদের ঘরে বসে আমি শেফা আর নাইমা মিলে নানা রকমের বিস্কুট খেলাম আর খুব হাসাহাসি করলাম। আমাদের হাসাহাসি গুলা ছিল সবই কাল্পনিককিছু কথা বার্তা নিয়ে। আর এই হাসাহাসির মূলে ছিল “কাঁদুনে ছেমড়ি”। এই প্রসঙ্গে আমি আপাতত কিছু লিখছিনা। পরে না হয় কোন একদিন লেখা যাবে।
রাতে দেখলাম আম্মু অনেকটাই স্বাভাবি আচরন করছে। আমাদের সাথে টেবিলে বসে গল্পও করল। আমরাও বিভিন্ন জিনিস নিয়ে হাসাহাসি করলাম। এরমধ্যে একতা ছিল শেখ হাসিনা বিষয়ক একটা কার্টুন আর ফেসবুকের কিছু ছবি। রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে প্রায় ১২ টা বেজে গেলো। নাইমা তখন ডায়রী লিখতে বসল। আমি ওর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুমে চোখ জড়িয়ে গেল। ঘুমের মধ্যেই টের পেলাম নাইমা তার ভালোবাসার কিছু অদৃশ্যচিহ্ন ছড়িয়ে দিল আমার চারপাশে। আমি তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে!