ধর্মদর্শন এবং ‘গুগলপ্লেক্স’

পবিত্র কোরান শরীফের ‘সূরা কাহফ’ এর ১০৯ নং আয়াতে আল্লহ পাক উল্লেখ করেছেন,

“বলুনঃ আমার পালনকর্তার কথা, লেখার জন্যে যদি সমুদ্রের পানি কালি হয়, তবে আমার পালনকর্তার কথা, শেষ হওয়ার আগেই সে সমুদ্র নিঃশেষিত হয়ে যাবে। সাহায্যার্থে অনুরূপ আরেকটি সমুদ্র এনে দিলেও”।

অন্যত্র ‘সূরা লুকমান’ এর ২৭ নং আয়াতে আল্লহ পাক উল্লেখ করেছেন,

“পৃথিবীতে যত বৃক্ষ আছে, সবই যদি কলম হয় এবং সমুদ্রের সাথেও সাত সমুদ্র যুক্ত হয়ে কালি হয়, তবুও তাঁর বাক্যাবলী লিখে শেষ করা যাবে না। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়”।
..................................................................

এবার আসি ‘গুগলপ্লেক্স (googolplex)’ প্রসঙ্গে। কিছুদিন আগে আমি এই সংখ্যাটি সম্পর্কে অবগত হই এবং এটি সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু হই। উইকিপিডিয়া এবং অন্যান্য কিছু সাইট থেকে আমি গুগলপ্লেক্স সম্পর্কে জানতে শুরু করি এবং এমন কিছু তথ্য জানতে পারি যে এটি সম্পর্কে আমার বিস্ময়ের সীমা নেই। গুগলপ্লেক্স সম্পর্কে জানতে হলে আগে বুঝতে হবে ‘গুগল (googol)’ কি? গুগল হল একটি বৃহৎ সংখ্যা। ১০^১০০ অর্থাৎ ১ লিখে ১০০ টি শূন্য দিলে যেই বড় একটি সংখ্যা পাওয়া যায় তাকে এক গুগল বলে। অন্যভাবে ইংরেজিতে বললে একে ‘টেন ডিউট্রিজিন্টিলিয়ন’ ও বলা যায়। ১৯৬৩ সালে, ‘এডওয়ার্ড কাসনার’ নামক জনৈক গণিতবিদ এই সংখ্যাটি কল্পনা করেন। উনি এর একটি নাম দিতে চাইলে উনার ৯ বছর বয়স্ক ভাতিজা ‘মিল্টন সিরোটা’ এর নাম দিয়ে দেয় ‘গুগল’। গুগলপ্লেক্স হল, ১০^(গুগল) বা ১০^১০^১০০ অর্থাৎ ১ এর পরে এক গুগল সংখ্যক শূন্য বসালে যেই সংখ্যাটি পাওয়া যাবে তাকে বলা হবে ‘গুগলপ্লেক্স’। এখন আসুন দেখি এই সংখ্যাটির বিশালতা নিয়ে আমরা কিছু ধারণা করতে পারি কিনা।

জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ ‘কার্ল সেগান’ গুগলপ্লেক্স সম্পর্কে বলেছেন, ‘মানুষের ধারণাকৃত মহাবিশ্বে এই সংখ্যা লিখে রাখা সম্ভব নয়’। আলোর গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ৩ X ১০^৮ মিটার বা প্রতি সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার। তাহলে, ৯৩ বিলিওন বা ৯.৩ X ১০^১০ আলোকবর্ষ অর্থাৎ ৯৩০০ কোটি বছরে আলো যতদূর যেতে পারে সেটাই হল মানুষের ধারণাকৃত মহাবিশ্বের ব্যাস। সেই হিসাবে মানুষের ধারণাকৃত এবং আবিস্কৃত মহাবিশ্বকে একটা বড় গোলক কল্পনা করলে তার আয়তন হয় প্রায়, ৩.৫৬৬৪১ X ১০^৮০ ঘণমিটার (প্রায়)। সাধারণ বই এর পৃষ্ঠা দিয়ে এই বিশাল মহাবিশ্বের সম্পূর্ণ যদি ভরে দেয়া যায় আর সবগুলো কাগজ যদি ভর্তি করে ‘০’ (শূন্য) টাইপ করা থাকে, (সাধারণ ভাবে একটি পৃষ্ঠায় ৪০০ টি ০ টাইপ করা থাকতে পারে), তবে প্রায় ৫.৩ X ১০^৮৭ টি শূন্য থাকতে পারে যা এক গুগল থেকেও অনেক কম; গুগলপ্লেক্স এর তো প্রশ্নই আসে না! মানুষ এই মহাবিশ্বের যতটুকু আবিস্কার করতে পেরেছে তাতে গড়ে মোট কণিকা বা পার্টিকেল আছে মোটামুটি ২.৫ X ১০^৮৯ টি যা এক গুগল থেকেও অনেক কম। অর্থাৎ আমরা যদি মহাবিশ্বের যাবতীয় কণিকা দিয়ে গুগলপ্লেক্স নয় বরং গুগল এর এক একটি শূন্যকে আশীর্বাদ করতে চাই, তাহলে পার্টিকেল অনেক আগেই শেষ হয়ে যাবে কিন্তু শূন্য ঢের বাকী পড়ে থাকবে। গুগলপ্লেক্স এর কথা তো বলাই বাহুল্য!

আসুন এইবার গুগলপ্লেক্স কে একটু লিখে দেখার চেষ্টা করে দেখি কি হয়। যদি মাত্র পয়েন্ট ওয়ান ফন্ট এ (০.৩৫৩ মিলিমিটার) গুগলপ্লেক্স কে লেখা হয় তাহলে সংখ্যাটির মোটামুটি দৈর্ঘ্য হবে ৩.৫ X ১০^৯৬ মিটার। এই ধারণাকৃত মহাবিশ্বের ব্যাস হল ৯৩ বিলিওন আলোকবর্ষ বা ৮.৭৯৮৫৪৪ X ১০^২৬ মিটার। তাহলে কি পেলাম? পয়েন্ট ওয়ান ফন্টে লেখা গুগলপ্লেক্স এর দৈর্ঘ্য এই মহাবিশ্বের ব্যাস এর চাইতেও প্রায় ৪ X ১০^৬৯ গুণ বড়! কোন এক লোক যদি এক সেকেন্ডে দুইটি করে শূন্য লিখতে শুরু করে তাহলে তার এক গুগলপ্লেক্স লিখে উঠতে সময় লাগবে প্রায় ১.৫১ X ১০^৯২ বছর যা এই মহাবিশ্বের বয়স হতেও প্রায় ১.১ X ১০^৮২ গুণ বেশী। আবার যদি, কেই মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের কোন একটি ডকুমেন্ট এ এই গুগলপ্লেক্স কে টাইপ করে রাখতে চায় তাহলে তার মেমরী লাগবে প্রায় ২০ ট্রিলিয়ন বা ২ X ১০^১৩ গিগাবাইট, যা এই বিশ্বের সব মেমরী মিলেও সম্ভব নয়।

আবিস্কৃত মহাবিশ্বকে যদি এভাবে কল্পনা করি যে এখানে গ্রহ জ্যোতিষ্ক ইত্যাদি কিছুই নেই, সম্পূর্ণ ফাকা আর এর ভতরে আমরা যদি সরিষা দানা দিয়ে ভরে দেই তাহলে মোট যতগুলা সরিষা থাকতে পারে তার মোটামুটি সংখ্যা হল ২.০১৮২ X ১০^৮৯ টি যা মাত্র এক গুগল থেকেই অনেক কম। এখানে সরিষার গড় ব্যাস ১.৫ মিলিমিটার ধরে হিসাব করা হয়েছে। ক্ষুদ্রতম ঋণাত্বক কণিকা ইলেক্ট্রনের ব্যাস প্রায় ৫.৬৩৫৯ X ১০^-১৫ মিটার। তাহলে সরিষার পরিবর্তে ইকেক্ট্রন থাকতে পারে ৩.৮১ X ১০^১২৩ টি যা এক গুগল থেকে বেশী হলেও গুগলপ্লেক্স এর কাছে অতি নগন্য তুচ্ছ পরিমাণ! পৃথিবীতে সর্বমোট পানি গড় আয়তন প্রায় ১.৪ X ১০^২০ লিটার। তাহলে পানির মোট অণুর সংখ্যা হল প্রায় ৪.৬৮৪৬ X ১০^৪৫ টি। পানির অণুর গড়ব্যাস ২.৭৫ X ১০^-১০ মিটার। তাহলে শুধু পৃথিবী নয় বরং এই মহাবিশ্বের মোট আয়তনে যদি সম্পূর্ণ পানি কল্পনা করা হয়, তাহলে মোট পানির অণু থাকতে পারে প্রায় ৩.২৭৫২ X ১০^১০৮ টি। যদি পানির এ অণুসংখ্যাকে ৭ দিয়ে গুণও করা হয় তবুও এর পরিমাণ এক গুগলপ্লেক্স এর তুলনায় অতি তুচ্ছ।

আমি কিছুদিন আগে মাইক্রোসফট ওয়ার্ডেরএকটি ডকুমেন্টে ১০^১০^৭ অর্থাৎ ১ লিখে ‘এক কোটি’ সংখ্যক শূন্য টাইপ করে দেখলাম মোট পৃষ্ঠা লাগলো ৩০২০ টি। আমার আর সামনে যাবার সাহস হল না। বুঝে গেলাম বিপদে পড়তে যাচ্ছি! এবার আমি একটু অঙ্কের আশ্রয় নিয়ে চরম বিস্মিত হলাম। কারণ দেখুন-

এক কোটি বা ১০^৭ সংখ্যক শূন্য টাইপ করতে পেজ লাগে = ৩০২ X ১০^১ টি
সুতরাং, ১০^৮ “ “ “ ““ “ “ ““ “ “ ““ “ “ ““ “ “ = ৩০২ X ১০^২ টি
১০^৯ “ “ “ ““ “ “ ““ “ “ ““ “ “ ““ “ “ = ৩০২ X ১০^৩ টি
.
.
.
১০^১০০ “ “ “ ““ “ “ ““ “ “ ““ “ “ ““ “ “ = ৩০২ X ১০^৯৪ টি

অর্থাৎ আমি যাভাবে টাইপ করছিলাম (টাইমস নিউ রোমান, ফন্ট ১২), তাতে করে এক গুগলপ্লেক্স টাইপ হতে মোট পৃষ্ঠা লাগতো ৩.০২ X ১০^৯৬ টি। পরে আরো কিছু অঙ্ক কষলাম। ধরে নেই, একটি ডকুমেন্টে ‘এক গুগলপ্লেক্স’ টাইপ করা আছে। আমি যদি কম্পিউটার কে নির্দেশ দেই যে, আমাকে প্রতি সেকেন্ডে ১ কোটি সংখ্যক পৃষ্ঠা সরিয়ে সরিয়ে গুগলপ্লেক্স কে দেখায় তাহলেও কত সময় লাগবে অনুমান করতে পারেন? আমি বলে দিচ্ছি, ৯.৫৭৬৪ X ১০^৮১ বছর! এবার কি ধারণা করতে পারছি যে গুগলপ্লেক্স কত বড় একটি বিশাল সংখ্যা?

‘গুগলপ্লেক্স’ মানুষের উদ্ভাবিত একটি সংখ্যা যেটা আমাদের পক্ষে কোনভাবেই ধারণ করা সম্ভব নয়, সেখানে সমগ্র বিশ্বের মহাসৃষ্টিকর্তার বিশালতা মানুষ কি করে ধারণা করবে? আবিস্কৃত সমগ্র মহাবিশ্বের আয়তনের সমপরিমাণ পানির অণুর ৭ গুণ পরিমাণও যেখানে গুগলপ্লেক্স এর তুলনায় নিতান্তই নগণ্য সেখানে কি করে সম্ভব সেই মহাপ্রভুর মহিমাকে সামান্য এক পৃথিবীর সমূদ্র বরাবর কালি দিয়ে লিখে রাখা? শুরু করেছিলাম কোরানের আয়াত দিয়ে। এই আলোচনা শেষ করছি একটি হাদীস দিয়ে। বুখারী শরীফের ‘কিতাবুর রিকক (كتاب الرقاق)’ অধ্যায়ে সাহাবী সাহল বিন সা’দ আস-সায়েদী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রসূলুল্লহ (সাঃ) ইরশাদ করেণ,

موضع سوط فى الجنة خير من الدنيا وما فيها ولغدوة في سبيل الله او روحة خير من الدنيا وما فيها
(رواه البخارى)

অর্থাৎ, জান্নাতের ‘এক চাবুক রাখার বরাবর’ জায়গা দুনিয়া এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে তার চাইতে উত্তম। আর নিশ্চই আল্লহ’র রাস্তায় ব্যয়িত এক সকাল অথবা এক বিকাল দুনিয়া এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে তার চাইতে উত্তম’।

পরিশেষে বলতে চাই, মানুষ তার কল্পনার বাস্তবায়ন করতে যেখানে সক্ষম নয় সেখানে স্রষ্টার বিশালতা অথবা উনার রাস্তায় ব্যয়িত সময়ের পুরস্কার মানুষের সীমিত জ্ঞানের অতীত, কল্পনারও অতীত। আল্লহ পাক, উনার অশেষ কৃপায় আমাদের সহায় হোন এবং আমাদের সত্য ও কল্যানের পথে পরিচালিত করুণ। আমিন!

Author's Notes/Comments: 

24th October 2012

View shawon1982's Full Portfolio