সিঙ্গাপুরে আমার প্রবাস জীবন প্রায় ৫ বছর হতে চলল। সেই ২০০৮ সালের জানুয়ারী মাস থেকে শুরু। একে একে দিনগুলো পার হয়ে গেল। সুখ দুঃখের কতইনা অনুভূতি মিশে আছে। সিঙ্গাপুরে আসার পর থেকেই, যখনই রাস্তাঘাটে বের হতাম, তখন আশপাশ তাকিয়ে দেখতাম। ভালো লাগতো দেখতে। আমাদের দেশের সাথে এর পার্থক্যগুলো ধরা পড়তো। আফসোস লাগতো। মনে মনে ভাবতাম, এখনও ভাবি; যদি আমাদের দেশটাও এমন হত! মাতৃভূমির কি কোন তুলনা আছে? আমিও তুলনা করতে চাই না। আশার নিঃশ্বাস নেই বুক ভরে!
সিঙ্গাপুরে আসার পরে আমার বারবার একটা কথা মনে পড়তো। এই দেশে কি কোন সরকার বা বিরোধীদল নেই? ধুর! তা কি করে হয়? সরকার ছাড়া দেশের নেতৃত্ব দেবে কিভাবে? এতো হতেই পারে না। কিন্তু এমন কেন? সিঙ্গাপুরে কোথাও কোন পোষ্টার, ফেস্টুন, দেয়াল লিখন কিছুই তো নজরে পড়ে না। নাহ! এমন হবে কেন? তাহলে কি রাজনীতিই নেই? তাও তো হতে পারে না। স্বাধীন দেশ আছে অথচ রাজনীতি থাকবে না সেটা তো হতে পারে না। এখানে রাস্তাঘাটে যখন কোন মন্ত্রী, এম.পি কিংবা স্বয়ং রাস্ট্রপতি যান, তখন তো কোন প্রটোকল দেখি না? দেখি না তো রাস্তা বন্ধ করে ভি.আই.পিরা যাচ্ছেন। এমন তো এই ৫ বছরে একবারও দেখলাম না। মনে মনে বাহ বাহ দিলাম। এমনটাই তো সাম্যের কথা। সবাই সমান। সাধারণ মানুষ যেভাবে গাড়ী করে রাস্তায় যাচ্ছে, তার পাশ দিয়ে একজন মন্ত্রী চলে গেলেও আলাদা করে বোঝার কোন উপায় নেই।
এইতো বেশীদিন আগের কথা নয়। ২০১২ সালের জানুয়ারী মাসের কথা। সিঙ্গাপুরে জাতীয় ভোটাভুটি হবে। সরকার আর বিরোধী দলের কম্পিটিশন। কম কথা? ভাবলাম এইবার দেখা যাবে পোস্টারিং হয় কিনা! নাহ কোথাও কোন পোস্টার দেখলাম না। কোন মিছিল বা মিটিং এর নামগন্ধও কোথাও নেই। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, মাত্র সপ্তাহ খানেকের জন্য কয়েকটা নির্দিস্ট স্থানে, ব্যানার করে প্রচারণা চালানো যেতে পারে। মাত্র কয়েকদিনের জন্য। কোন মিছিল মিটিং কোথাও হতে পারবে না। এর বেশী আর কিছু না। চলাচলতির পথে নজরে পড়লো কিছু প্রচারণা। ব্যাস, এইটুকুই। ভোট হয়ে গেল। সরকার গঠন হয়ে গেল। কোথাও কোন উচ্চবাচ্য নেই। আগে যেমন ছিল, সবকিছুই তেমন চলতে লাগলো।
অন্যএকটা জিনিস যেটা আমাকে খুব আন্দোলিত করেছে, সেটা হল, এখানে প্রত্যেক এম.পি, মন্ত্রী সবাই এলাকা ভাগাভাগি করে, সব বাড়ি বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞাসা করে মানুষের দাবীদাওয়া সম্পর্কে। আর জানতে চায়, তারা কি কি নাগরিক সুবিধা চায়। এদের সাথে থাকে না কোন ক্যাডারের ঝনঝনানি, আর না থাকে কোন পুলিশী বাহাদুরী! অবাক হয়ে দেখলাম এদের প্রশাসন ব্যবস্থা! হরতাল, অসহযোগ আন্দোলন, ধর্মঘট এগুলা তর্জমা করে দিলেও এদের কে বোঝানো যাবে না কি জিনিস। এসব এরা চেনে না।
এতো গেল পুরানো কথা। আজকে মাত্রই (১৭ই অক্টোবর ২০১২) আর্টস ফ্যাকাল্টি, ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর’ আয়োজন করলো এক রাজনৈতিক ফোরামের। বিশেষকরে ছাত্রছাত্রীদের জন্য। আমিও গেলাম দেখতে। ৬টি দল থেকে ৬ জন নেতানেত্রী এলেন। সবাই একসাথে বসে, ছাত্রদের প্রশ্ন শুনলেন। সুন্দর করে করে উত্তর দিতে লাগলেন। সরকারী দল, বিরোধীদল থেকে ৩ জন করে করে ছিলেন। একে অপরের প্রতি কি শ্রদ্ধাবোধ এদের। কি সুন্দর করেই না কথা বলেন। কোন উত্তেজিত কথা বা উচ্চবাচ্য নেই, নেই কোন ধরণের অশোভন উক্তি কটূক্তি! পোষাকে আসাকে চাল চলনে, আর দুই দশটা সিঙ্গাপুরিয়ান থেকে এদের আলাদা করার কোন উপায় নেই। সাথে ছিল না কোন প্রোটোকল। ছিল না বডিগার্ড কিংবা র্যাব সদস্য। ফোরাম শেষ হবার পরে, বুফে চা নাস্তার আয়োজন করা ছিল অডিটোরিয়ামের বাইরে। আমরা সবাই নাস্তা খাচ্ছিলাম। উনারাও এলেন। আমাদের সাথে দাঁড়িয়ে, গল্পও করতে করতে একই নাস্তা করতে লাগলেন উনারা। অবাক হয়ে দেখলাম। একজন মহিলা এম.পি চলে যেতে চাইলেন। উনি একা একাই সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। শুধু অবাকের পরে অবাকই হলাম।
আমার এই লেখার নাম ‘পার্থক্য’ দিয়েছি। কোন বিষয় নিয়ে পার্থক্য করতে গেলে তো দুই পক্ষ থাকতে হয়। কিন্তু আমি তো শুধু এক পক্ষ নিয়েই আলাপ করে গেলাম। অন্য পক্ষ গেল কোথায়? থাক! অন্য পক্ষকে আর ডেকে না নিয়ে আসি এখানে। সেই পক্ষ সম্পর্কে লেখকের থেকে পাঠক অনেক ভাল জানেন। শুধু শুধু আমি আবার কিছু লিখে পাঠকের মূল্যবান সময়ের অপচয় না হয় নাই বা করলাম।