/এক/
মাথার মধ্যে সূক্ষ্ণ একটা ব্যথা চিনচিন করছে। হাত পা সব অবশ হয়ে আছে। ঠান্ডা লাগছে প্রচন্ড। মনে হচ্ছে গায়ে কেউ যদি একটা কম্বল দিয়ে দিত! নড়ে উঠার চেষ্টা করেছে সে। আশ্চর্য! হাত পা একটুও নাড়াতে পারছে না। তাপমাত্রা কমার সাথে সাথে কি সব কিছুই বরফ হয়ে গেল নাকি? কোথায় আছে সে? মনে করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুই মনে করতে পারছে না। মাথার মধ্যে মনে হচ্ছে শনশন শব্দে কিছু একটা বেজে চলেছে। কিন্তু কিসের শব্দ সেটাও চেনার উপায় নেই। চোখ মেলতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। এমন সময় মনে হল কে যেন চোখের পাতার উপরে কি একটা লাগিয়ে দিচ্ছে। নরম কোমল। কিছু একটা মালিশ করে দেয়ার মত করে। আরাম লাগছে বেশ। কিছুক্ষণ করে চোখ মেলে তাকালো সে। সাথে সাথে তীব্র নীল বর্ণের একটা আলোক রশ্মি চোখের ভেতর দিয়ে ঢুকে যেতে লাগলো। এতক্ষণ ধরে পাওয়া সব অনুভুতিগুলো আবার অসাড় হয়ে গেল। এমন সময় সে শুনতে পেল একটা সাংকেতিক শব্দ। কিন্তু মনের ভেতর শব্দগুলো আপনা আপনি অর্থবোধক কিছু ইঙ্গিত দিলো।
সে শুনতে পেল তাকে বলা হচ্ছে, ‘স্বাগতম! নতুন ভুবনে স্বাগতম। আমি তোমার মাথার ভেতরের কন্ট্রোল প্যানেল থেকে ‘ন্যানো রোবট-rxd562’ বলছি। আমাদের এতদিনের প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছে’। কিছু একটা বলতে গেল সে, কিন্তু অবাক হয়ে খেয়াল করলো, ঠোঁট নাড়ানোর আগেই কথাগুলা কিভাবে যেন অটোমেটিক বলা হয়ে গেল। ‘আমি কোথায় আছি? আমি কে?’
‘তুমি পৃথিবীর একজন মানুষ কিন্তু এখন পৃথিবী থেকে ১০০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে, ণীওথিডাল গ্যালাক্সীতে আছো। আর তোমাকে যখন এখানে আনা হয় তখন থেকে ১০০ বিলিওন বছর পার হয়ে গেছে। দূরত্ব আর সময়ের এই হিসাব পৃথিবীর নিয়মে বলা হয়েছে’।
‘আমি এখানে কিভাবে এলাম? আমার পরিচয় কি’?
‘তুমি কি তোমার ইতিহাস জানতে চাও’?
‘চাই’।
‘আমাদেরও তাই ধারণা ছিল। তুমি বেঁচে উঠলে তোমার ইতিহাস জানতে চাইবে। আমরা তোমার মাথার ভেতরের কন্ট্রোল প্যানেলে কিছু স্মৃতি সংরক্ষণ করে রেখেছি। তুমি যা যা জানতে চাও, জিজ্ঞাসা কর! আমি নেটওয়ার্ক এর সাথে সংযোগ দিয়ে দিচ্ছি’।
‘আমি কে’? কাতর স্বরে সে জানতে চাইলো।
‘তুমি পৃথিবী নামক গ্রহ থেকে নিয়ে আসা একজন বুদ্ধিমান প্রানী। তোমার সাধারণ জাতিগত নাম ‘মানুষ’’।
‘আমার পরিচয় কি? আর কি করে এলাম এখানে’?
‘তোমার মূল নাম আমাদের অজানা। আমাদের এই রাজ্যে তোমাকে একটা নাম দেয়া হয়েছে। তোমার নতুন নাম হল- [ৡক্ষ্মপ্বঞ্ছৠ]m(q){12987}’
‘তুমি কে?’
‘আমি একজন ন্যানো রোবট। তোমাকে আগেই বলেছি’।
‘তুমি কোথায় আছ? তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন’?
‘আমি তোমার মাথার ভেতরে আছি। আমি তোমার ভেতরেই আছি। তুমি আমাকে দেখতে পাবে না। আমি তোমার ভেতর থেকে তোমার শারিরীক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছি’।
‘আমাকে কেন নিয়ন্ত্রণ করছো? আমার কি হয়েছে’?
‘পৃথিবীর স্বাভাবিক হিসাবে তোমার মৃত্যু হয়েছে। আমরা তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছি’।
‘মৃত্যু কি’?
‘মৃত্যু হল শরীরের কার্যকারিতা নিঃশেষ হয়ে যাওয়া’।
‘তাহলে আমাকে কিভাবে বাঁচিয়ে রেখেছো?’
‘তোমার শরীর কে আর চিন্তা ভাবনার কিছু উপাদান আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি। তোমার সব অনুভুতি আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারি নি’।
‘আবেগ কি’?
‘আবেগ এক ধরণের মানসিক অবস্থা যা দিয়ে পৃথিবীর মানুষ তাদের অনুভুতিকে প্রকাশ করে’।
‘বুঝিয়ে বল’।
‘মানুষ আনন্দ পেলে হাসে। দুঃখ পেলে কাঁদে। ব্যথা পেলে বা রাগ হলে চিৎকার করে। এগুলো হল আবেগ’।
‘আমাকে এখানে এনেছো কেন’?
‘তুমি ছিলে পৃথিবীর অনেক জ্ঞানী একজন মানুষ। আমাদের রাডারে এটা ধরা পড়ে তোমার মস্তিষ্কের ভেতর ঘূর্ণায়মান ইলেক্ট্রণ থেকে নির্গত ম্যাগ্নেটিক ফিল্ড থেকে। তোমাকে আমরা বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছি’।
‘পৃথিবীতে আমি কেমন ছিলাম? কে কে ছিল আমার’?
‘তুমি ছিলে একজন পুরুষ মানুষ’।
‘পুরুষ কি?’
‘পৃথিবীতে দুই জাতের মানুষের বাস ছিল। পুরুষ আর নারী। তুমি পুরুষ শ্রেণীর ছিলে’।
‘আর কে কে ছিল আমার সাথে?’
‘আমাদের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, তোমার মা আর তোমার স্ত্রী ছিল’।
‘এরা কারা? আমার সাথে এদের কি সম্পর্ক?’
‘পৃথিবীর নিয়ম অনুযায়ী তুমি তোমার মায়ের শরীরে জন্মাও, আর তোমার বংশধর জন্মে তোমার স্ত্রীর শরীরে’।
‘আমি তাদের দেখতে চাই’।
‘তাদের অস্তিত্ত্ব এখন নেই। তবে তুমি তাদের হলোগ্রাফিক চতুর্মাত্রিক ইমেজ চাইলে দেখতে পারো’।
‘আমি দেখতে চাই’।
‘তুমি তোমার সামনে রাখা স্ক্রীন স্ক্যান কর। দেখতে পাবে’।
লোকটি দেখতে পেল দুইজন নারীমূর্তি আবির্ভুত হল ঘরের মধ্যে। তাকে দেখে হাসছে। সে বুঝতে পারছে এদের কোন অস্তিত্ব নেই। তবুও ভালোকরে চাইলো তাদের দিকে। এদের মধ্যে একজন তাকে ক্রমাগত ডেকে চলেছে... ‘তুমি কোথায়? তুমি চলে এস আমার কাছে। আমাকে ছেড়ে কোথায় গেলে...’। সে প্রতিটি কথার মানে বুঝতে পারছে। কিন্তু ভাষাটা ধরতে পারছে না।
‘এরা কোন ভাষায় কথা বলছে?’
‘এরা ওদের তখনকার দিনের ভাষা ‘বাংলা’ তে কথা বলছে। তুমিও এই ভাষায় কথা বলতে যখন ওখানে ছিলে’।
‘এখন কোন ভাষায় কথা বলি তাহলে?’
‘তুমি এখন ণীওথিডাল গ্যালাক্সীর সাংকেতিক ভাষা ‘ত্রিরোণ্ব-৫৬৯’ তে আমাদের সাথে যোগাযোগ করছ’।
‘আমি তাহলে ওদের কথা বুঝছি কি করে?’
‘তোমার মাথায় পৃথিবীর সব ভাষা মেমোরী করে দেয়া হয়েছে। তুমি সব ভাষাই বুঝতে পারবে’।
‘ওরা আমাকে ডাকছে কেন?’
‘কারণ ওদের আবেগ আছে’।
‘তোমাদের আবেগ নেই?’
‘না আমাদের নেই। আমরা অনেক চেষ্টা করেও মানব সভ্যতার কয়েকটা জিনিস আবিস্কার করতে ব্যর্থ হয়েছি। সেগুলো হল, আবেগ, জৈবিক মৃত্যু আর ইশ্বর’।
‘ইশ্বর কি’?
‘মানুষের বেশীরভাগই এক অদৃশ্য মহাশক্তির বিশ্বাস করতো। তিনিই ইশ্বর’।
‘আমার মধ্যে আবেগ কি আছে’?
‘হ্যাঁ আছে। কিন্তু এটির উৎস কি সেটা আমরা জানি না’।
‘পৃথিবীতে কি আমার আর কেউ নেই?’
‘আছে। তোমার বংশধর আছে এখনও। তুমিই পৃথিবীর শেষ ভাগ্যবান ব্যক্তি যার বংশধর এখনও পুরুষক্রমিক ধারায় টিকে আছে’।
‘বুঝিয়ে বল। কিসের ধারা?’
‘প্রথমে তুমি ছিলে, তোমার নাম ছিল [ৡক্ষ্মপ্বঞ্ছৠ]m(q){12987}
এরপর তোমার স্ত্রীর শরীরে তোমার ছেলে হল, নাম হল [ৡক্ষ্মপ্বঞ্ছৠ]m(q){12988}
এরপর তার স্ত্রীর শরীরে তার ছেলে হল, নাম হল [ৡক্ষ্মপ্বঞ্ছৠ]m(q){12989}
এরপর তার স্ত্রীর শরীরে তার ছেলে হল, নাম হল [ৡক্ষ্মপ্বঞ্ছৠ]m(q){12990}
এরপর তার স্ত্রীর শরীরে তার ছেলে হল, নাম হল [ৡক্ষ্মপ্বঞ্ছৠ]m(q){12991}
এরপর তার স্ত্রীর শরীরে তার ছেলে হল, নাম হল [ৡক্ষ্মপ্বঞ্ছৠ]m(q){12992}
এরপর তার স্ত্রীর শরীরে তার ছেলে হল, নাম হল [ৡক্ষ্মপ্বঞ্ছৠ]m(q){12993}
........................’
‘চুপ কর! আমি আর শুনতে চাই না। আমি বুঝে গেছি’।
‘তুমি অনেক বুদ্ধিমান!’
‘আমি পৃথিবীতে যেতে চাই। আমি দেখতে চাই আমার বংশধারায় কে আছে’।
‘আমরা জানতাম তুমি এমন কিছু চাইবে। তাই আমরা সব ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছি’।
‘কিভাবে যাব আমি সেখানে?’
‘তোমাকে আমরা অতি দ্রুতগামী ফ্রিন্টণ এনার্জিতে বিভাজিত করে ফেলব। এরপর আমরা তোমার সিগনাল পাঠালে, পৃথিবীতে আমাদের যে এজেন্ট আছে তারা তোমাকে ওখানে তোমাকে রিসিভ করে তোমাকে এখনকার মত করে ফেলতে পারবে’।
‘তোমরা কি পৃথিবীতে আগে থেকেই ছিলে?’
‘হ্যাঁ ছিলাম। আমরা অতিক্ষুদ্র বলে আমাদের কেউ দেখতে পায় নি। আমরা সবখানেই মিশে যেতে পারি’।
‘কি করতে তোমরা পৃথিবীতে?’
‘আমরা মানুষের উপরে গবেষণা করতাম। এখনও করি। যেমন করছি তোমার উপরে’।
‘কেন করছো এই গবেষণা?’
‘আমরা চাইছি মানুষকে অমরত্ব দান করতে’।
‘পেরেছো?’
‘না আমরা এখনও পারি নি। জৈবিক মৃত্যুকে আটকানো গেলে অমরত্ব দেওয়া সম্ভব’।
‘আমি এখনই পৃথিবীতে যেতে চাই। আমি দেখতে চাই এখন আমার যে বংশধর আছে তাকে’।
/দুই/
গাছতলায় এক পাগলাটে বুড়ো বসে আছে। মাথার চুল আউলা ঝাউলা। উদভ্রান্তের মত চোখের দৃষ্টি। মানুষ তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে কিন্তু কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। এই আধ পাগলা বুড়োটাই আমাদের সেই নাম না জানা লোকটা, যে নীওথিডাল থেকে এসেছে তার পৃথিবীর বংশধর কে দেখে যেতে। আস পাশ দিয়ে যত মানুষ যাচ্ছে সবার শরীরে সে স্ক্যান করে দেখছে তাদের জিন-কোডিং। কারো সাথে মিলছে না। অথচ ওরা বলে দিয়েছে যে তার বংশধর যে হবে, তার জিনের সাথে মিল থাকবে। মাথার ভেতরের কন্ট্রোল প্যানেলে সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তার নিজের জিনের গঠন। সে অপেক্ষা করে বসে আছে। মাথার ভেতর থেকে বারবার সংকেত আসছে অপেক্ষা করতে। তার আশে পাশে অনেক ন্যানো রোবট তার চালচলন পরীক্ষা করছে। সে তো এখন আর সত্যিকারের মানুষ না। কৃত্রিম ভাবে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। সে এখন নীওথিডাল এর একজন প্রতিনিধি মাত্র। শুধু এখনও কিছু চিন্তা করার শক্তি আর আবেগ অবশিষ্ট রয়ে গেছে। যেটার উপরে কোন নিয়ন্ত্রণ কেউ নিতে পারে নি।
মাথা নীচু করে সে বসে আছে। হঠাৎ করে মাথার ভেতরে সিগনাল প্রবল হয়ে সুপার আল্ট্রাসনিক ফ্রিকোয়েন্সিতে চলে গিয়েছে। তার মানে, এতদিন ধরে সে যে জিনিস খুঁজছে, তা তার খুব কাছে। মাথা উচু করে সে ভালো করে স্ক্যান করতে লাগলো। দেখলো একটু দূর দিয়ে, একটা ছোট বাচ্চা ছেলে হেঁটে যাচ্ছে। সাথে তার মা। জিন কোডিং অনুযায়ী এইসব রিপোর্ট তার মাথার মধ্যে চলে আসছে। হঠাৎ করে নীওথিডাল থেকে ন্যানো-রোবট কথা বলতে শুরু করে, ‘স্বাগতম [ৡক্ষ্মপ্বঞ্ছৠ]m(q){12987}! তুমি তোমার অভীষ্ট লক্ষ্যে চলে এসেছ। সামনে যে ছেলেটিকে দেখতে পাচ্ছো, সেই তোমার জীবিত একমাত্র বংশধর’।
লোকটি দেখছে ছেলেটি তার মায়ের হাত থেকে ছুটে তার দিকে দৌড়ে আসছে। জিন কোডিং এ পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে এই বাচ্চাটাই তার বংশধর। সে হাত ইশারা করে ছেলেটিকে কাছে ডাকলো। ছেলেটার হাতে একটা খাবারের টুকরা। ছেলেটি কাছে এসে, খাবারের টুকরাটি লোকটার দিকে বাড়িয়ে দিলো। বললো, ‘এই নাও’। ছেলেটি বাংলা নয়, অন্য কোন একটা ভাষায় কথা বলছে। কিন্তু সে ঠিকই বুঝতে পারছে, ছেলেটি কি বলছে। সে হাত বাড়িয়ে খাবারের টুকরাটি নিলো। জানে এটি এখন আর তার খাবার নয়। তার খাবার তো ফ্রিন্টন এনার্জির মত কয়েকটি বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের শক্তি। লোকটি ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। মানুষের মানবিকতা আর আচরণ থেকে সে এমনটিই জেনেছে। সে কোন কথা বলছে না। কারণ সে কথা বললেও তার এই সাংকেতিক ভাষা পৃথিবীর কেউ বুঝবে না। এখানে তার কোন পরিচয় নেই। তার পরিচয় সেই কবেই বিস্মৃত হয়ে গেছে।
ছেলেটির মা চলে এসেছে। হাত ধরে তাকে টানছে। বলছে, ‘চলে এসো! পাগল লোকদের কাছেও যাবে না। তোমাকে না কতবার বারণ করেছি?’ বলতে বলতে ছেলেটিকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। ছেলেটি মায়ের বকুনি শুনে মন খারাপ করে চলে যাচ্ছে। কিন্তু যাবার পথেও বারবার মাথা ঘুরিয়ে এই পাগল বুড়োটাকে দেখতে লাগলো। লোকটি বুঝতে পারছে এটা তার একটা আবেগঘন মূহুর্ত। মাথার মধ্যে সঙ্কেত চলে গেছে আবেগের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে অশ্রু নির্গমনের জন্য। মাথার ভেতর রিঅ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। তার দুই গাল দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।