‘হিজড়া? কি বললে হিজড়া আসছে?’ বিরক্তিতে চেয়ারম্যান আতাহার সাহেবের মুখের চামড়ায় কয়েকটা ভাঁজ পড়ে গেল।
‘অসুবিধা কি? ওরা একটু নাচ গান করেই চলে যাবে’। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হেসে বললেন আতাহার সাহেবের স্ত্রী সফুরা বেগম।
‘কে ওদের আসতে বলেছে?’ রাগত স্বরে জানতে চাইলেন তিনি।
‘চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলের ঘরের নাতি হইসে। এই কথা কি কারো জানতে বাকী আছে? আপনি এত রাগ কইরেন না তো। আনন্দ ফূর্তি করতে চায় করতে দেন। ওরা আইলে কিছু পইয়সা দিয়ে বিদায় করে দিয়েন। ওরা তো অনেক গরীব’। হাসিমুখে সফুরা কথাগুলা বলে গেলেন।
‘খাইয়া লইয়া কাম নাই আমার’। বলতে বলতে গজগজ করতে করতে নাতিকে দেখতে গেলেন আতাহার সাহেব।
আধাঘন্টা পরে কাছারি ঘরের সামনে ধুন্ধুমার লেগে গেল। দুনিয়ার মানুষ জড় হয়েছে হিজড়া নাচ দেখার জন্য। চেয়ারম্যান আতাহার সাহেব ভীষণ বিরক্ত মানুষের কাজকর্মে। মানুষের খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, ভর দুপুরে আসছে হিজড়া নাচ দেখতে। যত্তসব অকর্মার ঢেকি! আর নিজের বড় ছেলেটা? আস্ত গাধা। নিজে বাপ হয়ে গেছে সেদিকে খেয়াল নেই; বসে গেছে হিজড়া নৃত্য দেখতে। গাধার গাধা। মনে মনে গালি দিয়েও মনকে শান্ত করতে পারলেন না আতাহার সাহেব। নিজের ঘরে শুয়েও শান্তি নেই। মানুষের হই হল্লা কানে আসছে।
একসময় টিকতে না পেরে উঠে এলেন তিনি। মনে মনে নিজের কাছেও একটু কৌতুহল হল আতাহার সাহেবের। পকেট দেখে নিলেন টাকা আছে কিনা। গিয়ে যেন এই আপদগুলারে বিদায় করে দিতে পারেন। কাছারি ঘরে গিয়ে জানালা দিয়ে উকি দিলেন আতাহার সাহেব। দেখেন শাড়ি পরে, মুখে কড়া রঙ এর মেকাপ দিয়ে গান করছে তিনজন হিজড়া। আর সবাই হা করে তাই দেখছে। এদের দুইজনের বয়স বেশী, আর এখজনের বয়স কম। বেশ কম বলেই মনে হল। কম বয়সী হিজড়াটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন তিনি। কয়েকবার ঢোক গিললেন।
কি করে সম্ভব? কিভাবে সম্ভব? ভালো করে মুখটা দেখার চেষ্টা করতে লাগলেন। মনে হচ্ছে তো ... জোর করে চিন্তাটা উড়িয়ে দিতে গিয়েও পারলেন না আতাহার সাহেব। পায়ে পায়ে কাছারি ঘর থেকে এগিয়ে গেলেন। চেয়ারম্যান সাহেব আসছে দেখে কয়েকজন কাছারি ঘরের সামনে থেকে সরে গেল। উনাকে দেখে হিজড়ারা গান থামিয়ে সভয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম জানালো। আতাহার সাহেবের কোন দিকে খেয়াল নেই। তিনি অল্পবয়সী হিজড়াটাকে বারবার দেখছেন। বাম হাতের দিকে তাকালেন। হাতের তালুর উপরে বড় কালো জরুলটা চোখে না পড়ার মত নয়। ডান হাতের কড়ে আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে দেখলেন ওটার পাশে ছোট্ট একটা অকেজো আন্তুল এখনো ঝুলে আছে। নাহ আর সন্দেহ নেই! ভুলে যান নি আতাহার সাহেব। চোখ দিয়ে পানি পড়তে চাইলেও পড়তে দিলেন না তিনি। কারণ উনি যে চেয়ারম্যান!
পকেট থেকে পাঁচশো টাকার তিনটা নোট বের করে অপেক্ষাকৃত বয়সী হিজড়াদের হাতে দিয়ে বললেন, তোমরা এখন যাও। আস্তে আস্তে জমায়েত সবাই চলে গেল কাছারি ঘরের আঙ্গিনা থেকে। হিজড়ারা টাকা নিয়ে খুশি হয়ে বেরিয়ে গেল। ওরা চলে যেতেই মনের ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠলো আতাহার সাহেবের। এতক্ষণ সামলে রাখা চোখের পানি এইবার আর বাঁধ মানলো না। নিজের অজান্তেই খালি পায়ে হাঁটা শুরু করলেন আতাহার সাহেব। জুতা পরার কথা মনেও রইলো না। পেছনে তাকালে দেখতে পেতেন, সফুরা তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হেসেই চলেছে!
‘থামো তোমরা’! পিছন থেকে আচমকা ডাক শুনে তিন হিজড়া ঘুরে দাঁড়ালো। চেয়ারম্যান সাহেবের অশ্রুসিক্ত মুখ দেখে অল্পবয়সী হিজড়াটা খুব অবাক। আতাহার সাহেব এসে দুই হাত দিয়ে, ওর মুখ ধরে বললো, ‘কত বড় হয়ে গেছিস রে’। বলেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো। ভীষণ অবাক হয়ে গেল ওরা তিনজনেই। অল্পবয়সী হিজড়াটার চোখে ভয়ের ছায়া। সে বয়স্কজনের গা ঘেষে দাঁড়ালো। বলল, ‘মা! উনি এমুন করে ক্যা’?
‘চেয়ারম্যান সাহেব, কি হইসে আপনার? এমুন করেন ক্যান?’ বয়স্কজন বলে উঠলেন।
‘তোমার নাম কি?’ অল্পবয়স্ক জনকে জিজ্ঞাসা করলেন আতাহার সাহেব। অন্য কোন দিলে খেয়াল নেই তার।
‘চম্পা। আপনি কান্দেন ক্যান?’
‘চম্পা! কি বলে তরে ডাকুম আমি রে!’ বলেই আবার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন চেয়ারম্যান সাহেব।
‘মা উনি এমুন করতাসে ক্যান’? চম্পা বয়স্ক হিজড়াকে জিজ্ঞাসা করে আবার।
‘অহন বুঝবার পারছি রে। চেয়ারম্যান সাবে কেন এমুন করতাসে। উনি তোর বাবা। আমি আগে বুঝবার পারি নাই। অহন বুঝতে পারছি। আইজ থেইকা ২০ বছর আগে হেয় নিজে তোরে আমাগো কাছে দিয়া আসে। তখন আমি থাকতাম গোয়ালখালী। উনি মনে হয় তোরে চিনতে পারছে’।
‘আমার বাবা’? ভীষণ অবাক হয় চম্পা। ‘আমগো আবার বাবাও হয় নাকি মা? আমরা কি হেগো মত মানুষ যে আমাগো বাবা থাকবো?’
‘ধুর পাগলী। কি যে কস। ল যাই গা। বেলা হইয়া গেসে। রান্ধন লাগবো। আমগো তো কেউ রাইন্ধা দিবো না রে’। বলেই ওরা হাঁটা শুরু করে।
‘চম্পা!’ পেছন থেকে কান্না জড়িত কন্ঠে ডাক দেয় আতাহার সাহেব।
‘আমারে ডাইকেন না। আমার কোন বাবা নাই। থাকার দরকার নাই। এরাই অখন আমার সব। আমি আপনারে চিনি না। চিনবার চাইও না। আমারে ফালায় দেওনের সময় মনে পড়ে নাই? অখন ক্যান? পারবেন আমারে আপনাগো ঘরে নিতে? পারবেন না তো, তাই না? আপনার মত বাবা গো ঘেন্না করি আমি। আমগো আল্লায় হিজড়া বানাইসে। আমরা নিজেগো নিজে বানাইতে পারলে হিজড়া হইতাম না’। বলতে বলতে চম্পার চোখে পানি এসে গেল। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে, কথাগুলা বলেই চম্পা ঘুরে চলে গেল ওদের সাথে।
চেয়ারম্যান আতাহার সাহেব অনেকক্ষণ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখলেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলেন চম্পার পায়ের ঘুঙুর থেকে ভেসে আসা ‘ঝুন ঝুন’ শব্দ। ফেরাতে পারলেন না নিজের ঔরসজাত সন্তানকে। একদিন নিজেই যাকে দিয়ে এসেছিলেন হিজড়া পল্লীতে। প্রকৃতি এ কেমন খেলা খেললো তার সাথে? চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো আতাহার সাহেবের। কারণ, তিনি যে ‘বাবা’।