//এক//
-আমার স্ত্রী মাঝে মাঝে কেমন যেন অস্বাভাবিক আচরণ করে। আমি বুঝতে পারি না। কোনমতে কথাগুলা বললো ইমন।
-কেমন আচরণ? বিস্তারিত বলুন। গম্ভীর ভাবে বললেন সাইক্রিয়াট্রিস্ট ডঃ রওশন আরা।
ইমন মাথা নীচু করলো লজ্জায়। কিভাবে বলবে বুঝতে পারছে না। আজকে ছুটি নিয়ে সোজা অফিস থেকে চলে এসেছে। আপয়েন্টমেন্ট আগে থেকেই নেয়া ছিল। পুষ্প এখনও কিছু জানে না।
-কি হল বলুন? চুপ করে থাকলে আমি বুঝবো কি করে?
-ইয়ে মানে, আমাদের বিয়ে হয়েছে ৫ মাস হলো। এখনো আমি আমার স্ত্রীর ... বলে ইমন চুপ করে গেল।
-আপনাদের বিয়ে কিভাবে হয়েছে? পারিবারিক ভাবে?
-আমরা ক্লাসমেট ছিলাম। নিজেরা পছন্দ করেছি। পরে পারিবারিক ভাবে আমাদের বিয়ে হয়।
-আপনাদের মধ্যে ফিজিকাল রিলেশন হয় নাই এখনো, এটাই তো বুঝাতে চাইছেন তাই না? কাগজের উপরে কেস হিস্ট্রি লিখতে লিখতে জিজ্ঞাসা করলেন সাইক্রিয়াট্রিস্ট।
-জ্বী। বলেই ইমন আবার মাথা নিচু করে লজ্জায়।
-ঐ সময়ে আপনার স্ত্রী কি ধরণের আচরন করে খুলে বলুন।
-বিয়ের পরে প্রথমবার আমি যখন ঘনিষ্ট হতে চাইলাম, কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচন্ড চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। ওর চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে সবাই চলে আসে। লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল। এই নিয়ে অনেক টিটকারি শুনতে হয়েছে।
-এরপর? শেষের কথাগুলো কানেই তুললেন না রওশন আরা।
-এরপর ওকে যখন এই কথা জিজ্ঞাসা করলাম, ও কিছু মনে করতে পারে না। এরপরে আবার যখন ঘনিষ্ট হতে চাইলাম, দেখলাম প্রচন্ড ভয় পেয়ে ধাক্কা দিয়ে আমাকে দূরে সরিয়ে দেয়। এরপর মাথা চেপে ধরে ব্যথা ব্যথা বলে অচেতন হয়ে যায়।
-কোন চিকিৎসা করিয়েছেন?
-করিয়েছি। সিটি স্ক্যান ও করিয়েছি কিন্তু কোন লাভ হয় নাই।
-কি যেন নাম বললেন আপনার স্ত্রীর?
-পুষ্প।
-কাল পুষ্পকে নিয়ে আসবেন। ওর সাথে কথা বলে না কোন সিদ্ধান্ত নেবো না।
সম্মতি জানিয়ে ইমন চেম্বার থেকে বের হয়ে বাসার দিকে রওনা হয়। মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
//দুই//
-বিয়ের আগে আপনার মেয়ের মধ্যে কোন সমস্যা বা কোন অস্বাভাবিকতা দেখেছেন? ডঃ রওশনের চেম্বারে পুষ্পর বাবা মাহতাব উদ্দিন আর ইমন বসা।
-মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে চিৎকার দিয়ে উঠতো। কিছু মনে করতে পারতো না। মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে পুষ্প’র বাবার।
-আপনি বলছেন পুষ্প হারিয়ে গিয়েছিল?
-জ্বী। ৫ দিন পরে ওকে খুঁজে পাই।
-তখন ওর বয়স কত ছিল?
-১২ বছর।
-ঘটনাটা খুলে বলুন। বলে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলেন সাইক্রিয়াট্রিস্ট।
-১৩ বছর আগের কথা। মাহতাব উদ্দিন বলতে শুরু করেন-
পুষ্প জিদ করলো পহেলা বৈশাখে মেলা দেখতে যাবে। ওকে ভিড়ের কথা বললাম। কিছুতেই মানতে রাজি না। কখনো যায় নি, তাই এবার আমাকে নিয়ে যেতেই হবে। পুষ্প পান্তা ভাত খেতে পছন্দ করতো। ওর মা’কে এজন্য প্রায়ই পান্তা ভাত করে দিতে হতো। পহেলা বৈশাখে তো পান্তা খাবেই। বাইরে খেতে চাইতো, অনেক বলে কয়ে বাসায় যেন খায়, বুঝালাম। আমি ওকে নিয়ে রমনার কাছে গেলাম।
প্রচন্ড ভিড় ছিল। আমি পুষ্পের হাত ধরে রেখেছিলাম। রাস্তায় এত মানুষ ছিল যে ভালভাবে হাঁটতেও পারছিলাম না। কথা বলছিলাম ওর সাথে। হঠাৎ করে দেখি পুষ্প নেই। চিৎকার করে ডাকলাম। কোথাও খুঁজে পেলাম না মেয়েকে। আমার কাঁদা দেখে আমার আশে পাশের মানুষও অস্থির হয়ে গেল। একজন আমাকে নিয়ে গেল রমনা থানায়। জিডি করালাম। বাসায় এসে ঘটনা শুনে পুষ্পের মা অসুস্থ হয়ে বিছানা নিলো। কোথাও বাদ রাখলাম না যেখানে আমি মেয়েকে খুঁজি নাই। বলতে বলতে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন পুষ্পের বাবা।
-এরপর? অনেকটা তাড়া দেয়ার মত শোনালো রওশন আরা’র কথা।
-৫ দিনের মাথায় রমনা থানা থেকে ফোন আসে, আমার মেয়ের মত একজনকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে। মরা মেয়ে মনে করে লোকে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ গিয়ে দেখে পুষ্প অচেতন হয়ে আছে। সাভার সদর হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করায়। ডাক্তার জানায়, কড়া ডোজের পেথিড্রিন দিয়ে পুষ্পকে অচেতন করে ফেলে গেছে কেউ। এরপর সাভার থানার পুলিশ খবর পাঠায় বিভিন্ন থানায়। পরে রমনা থানা থেকে আমার মেয়ের ছবির সাথে মিলিয়ে দেখে আমাদের খবর দেয়। পাগলের মত ছুটে গেলাম।
দেখলাম হাসপাতালের বিছানায় পুষ্প শুয়ে আছে। কাঠির মত হয়ে গেছে এই ক’দিনে। দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে মেয়েকে দেখে কাঁদতে লাগলাম। ও দেখলাম ভাবলেশহীন চোখে আমাকে দেখছে। যেন আমাকে চিন্তেই পারছে না। আসলেও চিনতে পারলোও না। আমি কাছে যেতেই চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। মেয়েকে ঢাকা নিয়ে আসি। টানা তিন বছর ওর মানসিক সমস্যার চিকিৎসা চললো। এরপরে আসতে আসতে স্বাভাবিক হয়। প্রথম প্রথম কারো সাথে কথাই বলতো না। শরীর একটু ভালো হবার পরে স্কুলে যেতো ঠিকই কিন্তু সহপাঠিদের কাউকে চিনতে পারতো না। ওর বান্ধবীরা অনেক কষ্টে ওর সাথে আবার বন্ধুত্ব করে তোলে। ওদের আমি আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এই পাঁচদিনে পুষ্পের কি হল, কোথায় ছিল এখনও অজানা রয়ে গেছে আমাদের কাছে।
-ওই ঘটনার পরে মেয়ের মধ্যে আর কোন অস্বাভাবিকতা দেখেছেন?
-দেখেছি। পান্তা ভাত খেতে চাইতো না। একদিন গ্রামের বাড়িতে গিয়ে শখ করে নৌকায় উঠলে চাইলো। কিন্তু নৌকা চলা শুরু করা মাত্রই প্রচন্ড চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। জ্ঞান ফিরলে কিছু মনে করতে পারতো না। বলতো প্রচন্ড মাথা ব্যথা করে।
-এবার আমি বলি মন দিয়ে শুনুন। আপনার মেয়ে ঐ পাঁচদিনে বেশ কয়েকবার ধর্ষনের শিকার হয়েছে। বয়স অনেক কম ছিল বিধায় ঘটনাটা ওর মনে এমনভাবে রেখাপাত করে যে ও সব স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে। ওর আর কিছুই মনে নেই। শুধু কোন পুরুষের সাহচর্য কাছে এলেই ও অবেচেতন মন থেকে প্রতিবার শুরু করে। কিন্তু নিজে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। প্রথমে ব্যাপারটা ধরতে আমাকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। পরে পুষ্পকে কয়েক দফা হিপ্নোটিক সাজেশন দিয়ে আমি যে তথ্য উদ্ধার করেছি তা হল, আপনার মেয়েকে ভিড়ের মধ্যে দুষ্কৃতিকারীরা এক বা একাধিক জন অজ্ঞান করে তুলে নিয়ে যায়। এরপর দূরে কোন ভাটি অঞ্চলে সম্ভবত কোন নৌকায় নিয়ে যায় আর ওখানে আটকে রাখে। এরপর ওকে ড্রাগ দিয়ে অচেতনের মত করে রাখতো আর বারবার ধর্ষণ করে। আধো চেতনায় পুষ্প অনেক কিছুই বুঝে উঠতে পারে নাই। ওর বাড়ন্ত কিশোরী শরীর ধর্ষণের প্রভাব সামাল দিলেও, মন পারে নাই। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, যার ফলে নৌকায় উঠলেই ভয় পায়। আর কোন পুরুষ এমনকি ওর স্বামী কাছে এলেও অবেচেতন ভাবে ওর মধ্যে প্রতিবাদ দেখা দেয়। এক নাগাড়ে বলে চুপ করে গেলেন সাইক্রিয়াট্রিস্ট রওশন আরা।
//তিন//
কাঁদরে কাঁদতে ব্যাগ গোছায় পুষ্প। ইমন পুষ্পকে জড়িয়ে ধরে। ‘কেন আমাকে ছেড়ে যাবা পুষ্প?’
-আমি অপবিত্র। আমি তোমার যোগ্য নই। বলে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে পুষ্প।
-কে বলেছে তুমি অপবিত্র। আমি তোমাকে ভালবেসেছি পুষ্প। তোমার শরীর কে নয়। যা ঘটে গেছে, এতে তোমার আমার, আমাদের কারো দোষ নেই। তুমি কেন আমাকে কষ্ট দিবে? কেন পাগলামী করছো? বলতে বলতে ইমনও কেঁদে ফেলে। পুষ্পকে পাগলের মত ভালোবাসে সে।
-পারবে সব জানার পরেও আমাকে কাছে টেনে নিতে?
-কেন পারবো না? বলে গভীর আবেগে পুষ্পকে কাছে টেনে নেয় ইমন। অব্যক্ত ভালোবাসা দু’জোড়া ঠোঁট এক করে দেয়।