*
চিঠিটা পড়েই তমাল খাটের থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। মুখটা হাসি হাসি। চিঠিটা বার বার উলটে পালটে দেখলো কয়েকবার। ভাবেনি এইভাবে এমন একটা সুযোগ তার জীবনে এসে যাবে। চিৎকার ডাকলো, মা! মা! কই তুমি?
-এইত আমি! কি হইছে বাবা? তমালের ডাক শুনে ব্যস্ত হয়ে ওর মা উঠে এলেন শাড়িতে হাত মুছতে মুছতে।
-মা! ঐ যে তোমার মনে আছে না? আমি মডেলিং এর জন্য ছবি দিলাম যে?
-কবে দিলি? তমালের মা রাবেয়া একটু অবাক হয়ে যান।
-ঐ যে মা এক মাস আগে দিলাম যে? তুমি ভুলে গেছো? আজকে ওদের চিঠি পেলাম। ওরা আমাকে ইন্টারভিউ এর জন্য ডাকছে।
-কবে ইন্টারভিউ? রাবেয়ার মুখে বিষণ্নতার ছায়া পড়ে।
-এক সপ্তাহ পরে মা। আমাকে যেতে হবে। তুমি তো জানো মা আমি মডেল হতে চাই।
-সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু ইন্টারভিউ কোথায় হবে?
-ঢাকাতে। বনানীতে ওদের অফিস।
-ঠিক আছে যাস। বলে রাবেয়া রান্নাঘরে আবার চলে গেলেন।
*
সন্ধ্যা হয়ে এলো। তমালের আর তর সইছে না। এই এক সপ্তাহ যেন কাটেই না। সময় যেন যেতেই চায় না। মনে মনে কত স্বপ্ন দেখল এই কয়দিন। কাল রাতে তো ঘুমই হল না ঠিক মত। ক’দিন আগে রাবেয়া তিন হাজার টাকা দিয়ে বলল, কিছু ভাল জামা কাপড় কিনে নিতে। ইন্টারভিউ তে পরে যাবার জন্য। তমাল মা’কে প্রশ্ন করেছিল, কোথায় পেলে মা এই টাকা? রাবেয়া শুধু বলেছিল, ‘ছিল আমার কাছে’। অভাবের সংসারে যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে অতিরিক্ত টাকা রাখার আর সুযোগ কোথায়? তমালের চোখে এখন রঙ্গীন স্বপ্ন। মনে মনে ভাবে, মডেল হলে তো অনেক টাকা হবে। তখন তাদের এই অভাব আর থাকবে না। মায়ের জন্য একটা সেলাই মেশিন কিনে দিবে ভাল দেখে। কত চিন্তা, কত পরিকল্পনা তমালের।
যাবার সময় রাবেয়া তমালের হাতে আরো দুই হাজার টাকা দিয়ে দিল। চোখ মুছে ছেলেকে বিদায় দিতে গেল। তখন তমালের চোখ গেল মায়ের কানের দিকে। মায়ের কানে ছোট একজোড়া সোনার দুল ছিল। এখন আর সেটা নেই। তমালের আর বুঝতে বাকি থাকে না। ওকে টাকা দেয়ার জন্য মা গোপনে দুল বিক্রি করে দিয়েছে। তমালের চোখ ফেঁটে কান্না চলে এল। ঘর থেকে বের হবার আগে মাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে ফেলল।
-মা তুমি আমার জন্য তোমার কানের দুল বেঁচে দিলা?
-তাতে কি হইছে রে? তুই ইনকাম করে আমাকে আরো ভাল দুল কিনে দিবি।
-ঐটা তো বাবা তোমাকে দিয়েছিল মা। বাবা’র স্মৃতিকে তুমি বেঁচে দিলা মা?
-কিচ্ছু হবে না বাবা। ও তুই ভাবিস না। তোমার বাবা’র চিহ্ন হিসাবে তুই তো আমার কাছেই রয়ে গেলি বাবা। কানের দুল দিয়ে কি হবে?
কাঁদতে কাঁদতে তমাল মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসে উঠে বসে। ভারাক্রান্ত মনে ছেলেকে বিদায় দিয়ে বিধবা রাবেয়া তার ঘরে ফেরত আসেন।
*
পাবলিক বাস থেকে নেমে প্রায় ছুটতে ছুটতে তমাল বনানীর ‘ফাল্গুন মিডিয়া সেন্টার’ অফিসে ঢোকে। ভোর বেলা এসে পৌঁছুলেও রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম এত বেশী ছিল যে তমাল রীতিমত দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। যদি সময় মত যেতে না পারে। অফিসের রিসেপশনে গিয়ে তমাল একটু অবাক হয়। অন্য কোন প্রতিযোগিকে তো দেখা যাচ্ছে না। যাকগে ওসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগ নেই। কেউ না থাকলেই ভাল। যদি ও চান্স পেয়ে যায়! মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস এক্তা বেরিয়ে আসে। ঠিক তখনই ওকে রিসেপশনিস্ট বলল, স্যার আপনাকে যেতে বলেছে। দুরু দুরু বুকে তমাল দরজা খুলে ঢোকে প্রডিউসার এর ঘরে। ঘরে ঢুকেই তমাল অবাক। ঘরটা বেশ অন্ধকার। ডিম লাইটের মত কয়েকটা বাতি জ্বলছে।
-মে আই কাম ইন স্যার?
-ইয়েস! টেক ইউর শিট। গমগম স্বরে বললেন বললেন প্রডিউসার মাশরুর চৌধুরী। এরপর টেবিলের উপরে রাখা একটা ল্যাম্প জ্বেলে দিলেন।
-চোখে হঠাৎ আলো আসায় তমাল চোখ কুঁচকে ফেলে।
-ইয়াং ম্যান! আমি নিজে তোমার প্রফাইল দেখেছি। আমার পছন্দ হয়েছে। আমি তোমাকে নোমিনেট করেছি আমার পরবর্তী টেলিফিল্ম “মুক্তির চেতনা” এর জন্য। মুক্তিযুদ্ধের উপরে করছি। তোমার কোন আপত্তি আছে?
-আ...আমার...আপত্তি? বলেই ঢোক গিলল তমাল। এতদ্রুত এমন একটা অফার পেয়ে যাবে তমাল ভাবতেই পারছে না। গলার কাছে দলার মত কি যেন একটা আটকে গেছে। ঢোক গিললো একটা। একবার তাকিয়ে দেখলো যে প্রডিউসার তার সাথে মশকরা করছে কি না দেখার জন্য। মাঝবয়সী লোকটার চেহারা দেখে তমালের মনে হল না যে ঠাট্টা করছে।
-রাজি থাকলে ফোন করে জানিয়ে দিও। এই নাও অফিসের কার্ড। আগামী সপ্তাহ থেকে শ্যুটিং এর কাজ শুরু।
-ঠিক আছে স্যার। কোনমতে বলল তমাল। ওর বিশ্বাস হচ্ছে না। স্বপ্ন দেখছে না তো? প্রথম দফাতেই এই সাফল্য!
-তোমার থাকার যায়গা আছে তো? না থাকলে আমার রিসেপশনিস্ট কে গিয়ে বল। তোমার থাকার জায়গা কোথায় হবে তা বলে দিবে।
-জ্বি স্যার।
-তুমি এখন এসো। বলে হাত দিয়ে তমালকে যেতে ইশারা করলেন। তমাল চেয়ার থেকে উঠতে যাচ্ছিলো এমন সময় আবার বসতে ইশারা করলেন প্রডিউসার। তমাল বসে পড়ে।
-আমার একটা শর্ত আছে। ঠোটের কোনায় একটু ধূর্ত হাসি ফুটিয়ে তুললেন প্রডিউসার।
-জ্বি বলুন স্যার। কোনমতে তমাল কথাগুলা গলা থেকে বের করল। বুক ধড়ফড়ানি তো কমেই নাই বরং এখন মনে হচ্ছে হৃৎপিন্ডটা গলার কাছে এসে লাফাচ্ছে।
-মাঝে মাঝে আমাকে একটু সময় দিতে হবে। পারবে তো?
-বুঝলাম না স্যার। তমাল একটু অবাক হয়।
-না মানে, কাজের ফাকে ফাকে আমাকে একটু সময় দিতে হবে। এই শর্তে রাজি থাকলে বল। না হলে অন্য কাউকে নিতে হবে আমাকে।
-আমাকে কি করতে হবে বলুন স্যার। আপনার কোন কাজ করে দিতে হবে? আমি রাজি আছি স্যার।
-তুমি মনে হয় বুঝতে পারো নাই আমার কথা, তাই না? এইবার প্রডিউসার এর দাঁত বের করা হাসি দেখা গেল।
-না স্যার। কি করতে হবে আমাকে বলেন। তমাল বোকা বনে যায়।
-পুওর বয়! তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন প্রডিউসার। তোমাকে সবকিছু শিখিয়ে নিতে হবে দেখছি। অবশ্য এমন আনাড়ি ছেলেই আমার পছন্দ।
-জ্বি মানে স্যার। তমাল বোকার মত আবার প্রশ্ন করে।
-আহ! তুমি দেখছি কিছুই বোঝো না। শুধু আমাকে তোমার সময় দিতে হবে। বুঝে না থাকলে স্ক্রিনে দেখো। বলে রিমোট কন্ট্রোলার চেপে টিভি চালু করলেন প্রডিউসার।
তমাল দেখতে লাগল। একজন ইউরোপিয়ান আর একজন নিগ্রো ছেলে সোফায় বসে গল্প করছে। বুঝে উঠতে পারছে না যে এখানে প্রডিউসার ওকে সিনেমা দেখাতে বসে গেলেন কেন? যাই হোক তমাল মন দিয়ে দেখছে। কিন্তু দুই মিনিট পার না হতেই একি? তমালের দুই কান দিয়ে মনে হয় বাষ্প বের হতে লাগল। দুই সমকামী ছেলের শয্যাদৃশ্য এক মিনিট দেখার পরে তমালের মনে হল মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। এ কোন জগতে এল? কিসের পাল্লায় পড়লো? মনের অজান্তেই চোখ বন্ধ করে বলে উঠল, মা তুমি কোথায়? তমালের মনে হল যেন ওর সারা গায়ে জ্বর চলে এসেছে। পা ভারী হয়ে গেছে। কোনমতে একদৌড়ে অফিস থেকে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে দশ তালা থেকে নেমে আসে। লিফট নিতে গেলেও মনে হয় মানুষরূপী ঐ জানোয়ারটা ওকে ধরে ফেলবে। তমালের হাতে তখনও সেই চিঠিটা ধরা।
বিল্ডিং থেকে বের হয়েই একটান দিয়ে চিঠিটা টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে রাস্তার উপরে ফেলে দেয়। দাঁতে দাঁত চেপে রাস্তা ধরে দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে। ভাবছে, দেশ শত্রুর কবল থেকে মুক্ত হলে কি হবে, মানুষ এখনও তার নগ্ন-পাষন্ডতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। সুস্থ স্বাভাবিক মুক্তির চেতনা এখনও মানুষ পায়নি। তমাল দ্রুত পায়ে গিয়ে বাসে উঠে বসে। বারবার কেন জানি মাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। কাঁদতে চাইছে না তবুও কেন জানি চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।