খুব বেশী আগের কথা না। এইত মাত্র কয়েক বছর আগের কথা। সবকিছু এত বেশী জীবন্ত যেন মনে হয় এখনও সব কিছুর চোখের সামনে ভাসে। তখন আমি সবেমাত্র ভার্সিটিতে পড়ছি। ছোটবেলার মত সারা বছর ঈদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম যে কখন রোজার ঈদ আসে। ঈদ মানেই নানুবাড়িতে খুলনাতে যাওয়া আর সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হওয়া। শহরে থাকতে থাকতে আমরাই কেমন যেন ইট-কাঠের মত হয়ে যাই। তাই যখনই ঢাকার বাইরে যাবার সুজোগ হয় তখন তা হাত ছাড়া করতে মন চায় না। আমাদের আত্মীয় স্বজন যারা ঢাকা থাকে সবাই ঈদে খুলনায় যান। আমরা সব ভাই-বোন একসাথে হয়ে কত আনন্দময় সময় কাটিয়েছি। এখনও মনে পড়লে আফসোস লাগে যে কেন সেইসব দিন আর ফিরে আসে না। ফিরে আসবেও না। যে সময় পার হয়ে গিয়েছে তা আর ফিরে না। নিষ্ঠুর এই সত্য মানতে মন চায় না কিন্তু মানতে হয়।
একবার এক ঈদে, যতদূর মনে পড়ে ২০০৬ এর কথা। ঈদের পরে খালাত-মামাত ভাইরা বলল যে, ভাইয়া চল ‘ডে-নাইট’ চা খাই। শুনে খুব অবাক হলাম। ডে-নাইট চা? এ আবার কেমন জিনিস? ওরা বলল, চলই না। গিয়ে নিজেই দেখবা। উৎসাহ কে চাপা দিতে পারলাম না। অরা বলল, দৌলতপুর ডে-নাইট কলেজের কাছে একজন ঐ চা ভাল বানায়। আমার উৎসাহে ভাটা পড়ে গেল। ডে-নাইট কলেজের কাছে চা, তাই মনে হয় এই নাম! ওরা জানালো তা না। চা টার নামই ডে-নাইট। যাই হোক, ওদের সাতে অবশেষে আমি একটা টং এর চায়ের দোকানে হাজির হলাম। আমাদের আবার টং এর দোকানে দল বেধে চা খাওয়ার অভ্যাস আছে। ডে-নাইট চায়ের অর্ডার দেয়া হল। অল্প বয়সী একটা ছেলে চায়ের দোকানে ছিল। মন দিয়ে তার চা বানানো দেখতে লাগলাম। প্রথমে দেখলাম চায়ের কাপে শুধু গরম পানি নিয়ে তার মধ্যে চিনি গুলে নিল। এরপর ছাকনির মধ্যে খানিকটা শুকনা চা-পাতা দিয়ে তার উপরে ফোঁটা ফোঁটা করে কেটলি থেকে ফুটন্ত গরম পানি দিতে লাগল। অবে বিস্ময়ে দেখলাম লাল রঙ এর চায়ের লিকার ফোঁটা ফোঁটা করে গরম পানির উপরে পড়লে লাগল আর সেটা মিশেও গেল না বরং সাদা পানির উপরে জমা হতে লাগল। যখন সবটা লিকার দেয়া হয়ে গেল, মুগ্ধ চোখে দেখলাম একই কাপে দুই রঙ এর তরল জমা হয়েছে স্বীয় বর্ণে। উপরে চায়ের লিকার আর নিচে চিনিগোলা গরম পানি। সাধারণ একটু রঙ চা কিন্ত বানানোর কি অপূর্ব কৌশল। দাম মাত্র ২/= প্রতি কাপ। ছবি তুলে নিলাম ডে-নাইট চায়ের। নামকরণের সার্থকতা বুঝলাম। কালচে লাল সাদা রঙ এর আলাদা আলাদা থাকার ফলে চায়ের এই নাম। এরপরে যতবারই খুলনা গিয়েছি, ডে-নাইট চা খেতে ভুলি নাই।
এইবার আসি আখের রসের প্রসঙ্গে। এটা অবশ্য এমন বিশেষ কিছু না। কিন্তু আমাদের জন্য আয়োজন করে খাওয়াটা অবশ্য মজারই বটে। দৌলতপুর বাস-স্ট্যান্ড এর সাথেই এক বয়স্ক মানুষ আখের রস বেচতেন। আমরা উনাকে মামা ডাকি। উনিও আমাদের অনেক স্নেহ করেন। আমরা উনার কাছে আখের রস খেতে গেলে উনি উনার সব কাজ বন্ধ করে দিয়ে আমাদের জন্য রস তৈরি করতে লেগে যান। ঢাকাতেও আখের রস পাওয়া যায় কিন্তু খাই না পরিচ্ছন্নতার অভাবে। কিন্তু দৌলতপুরে ভিন্ন কথা। আমরা আগে থেকে বলে গেলে ঐ মামা আমাদের জন্য বাছাই করা আখ নিয়ে আসেন। এরপর আমরা দন বেধে আখের রস খেতে লেগে যাই। ঠাট্টা করে অনেক সময় আমরা বলি খেতে খেতে গলা পর্যন্ত উঠিয়ে ফেলা। আমার ক্ষেত্রে এই অবস্থাই হতো। কয়েক গ্লাস একটানে খেয়ে নিতাম। এখানেই শেষ না। কোকের ২ লিটার এর বোতল নিয়ে যেতাম আর ওটা পুরা ভরে নিয়ে আসতাম বাসায় যারা আছে তাদের জন্য। দাম অনেক কম ছিল। এক গ্লাস মাত্র ৭/= করে নিতেন। আখের রস আমার অনেক পছন্দ ছিল। তাই খুলনা গেলে এই জিনিসটাও মিস করতে চাই না। সিঙ্গাপুর এসেও দেখি দোকানে আখের রস বিক্রি করে। এক গ্লাস নেয় S$ 1.8 যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ২০০/= এর মত। সে না হয় ঐ টাকে দিয়ে খাওয়া গেল। কিন্তু আমাদের দেশের মাটিতে আখের রস খাওয়ার যে উদ্দীপনা আর মমতা, সেই মমতা এই প্রবাস জীবনে কোথায়?