সকাল বেলাতেই সাফিয়া বেগমের ঘরে তার দুই নাতনি এসে উপস্থিত। টুম্পা আর তিতলি। ওদের নানীর বয়স এখন আশির কোঠা পার হয়ে গেলেও হাঁটাচলা করতে পারেন লাঠি ছাড়াই। নিয়মিত খবরের কাগজ আর বই পুস্তক পড়েন। সকাল বেলাতে গোসল সেরে বারান্দায় বসে রোদে চুল শুকাচ্ছিলেন সাফিয়া বেগম। চুল বেশীরভাগই পেকে সাদা হয়ে গেলেও বোঝা যায় অনেক চুল ছিল তার মাথায়। দুই নাতনিকে দেখে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকলেন। টুম্পা ক্লাস টেন এ পড়ে আর তিতলি ক্লাস এইট এ। দুই বোন গিয়ে নানুর দুই পাশে গিয়ে বসে।
:নানু কি করছ?
-কিছু না তো। বসে আছি। তোমারা এত সকালে? নাস্তা করেছ?
:এখনও করি নি। একটু পরে করব।
-তোমাদের মতলবটা কি নানুরা? কৌতুক করে বলেন সাফিয়া বেগম।
:তোমার সাথে গল্প করব। তিতলি উত্তর দেয়।
-বেশ তো। কর গল্প। কি গল্প করবে?
:নানু তুমি আমাদের গল্প বলবে?
-আমি তো গল্প তেমন জানি না। আমি কি বলব তোমাদের?
:তুমি তো কত কত বই পড়। তোমাকে গল্প বলতেই হবে।
-কি নিয়ে গল্প শুনতে চাও তোমরা? সাফিয়া বেগম চিন্তা করতে থাকেন।
:আমাদের কে একুশের গল্প বল নানু। আম্মু বলেছে তখন তুমি ঢাকায় ছিলে। তুমি অনেক কিছু জানো। আমরা তোমার কাছে একুশের গল্প শুনতে চাই।
-সে তো অনেকদিন আগের কথা নানু। আমার কি আর অত কিছু মনে আছে? বলতে গিয়ে মুখে বিষাদের ছায়া পড়ে সাফিয়া বেগমের।
:তোমার যা মনে আছে তাই বল।
-কি করবে তোমারা এই গল্প শুনে?
:আমাদের স্কুলে একুশের উপরে গল্প লিখতে হবে। তোমার কাছ থেকে শুনে ওখান থেকে লিখব।
-আমার গল্প তো তোমাদের ভাল নাও লাগতে পারে নানু।
:তুমি বল। ভাল না লাগলেও লিখব। আমরা শুনতে চাই তোমার গল্প।
-ঠিক আছে শোন তাহলে। স্মৃতির মণিকোঠা বেয়ে অতীতে যেতে থাকেন সাফিয়া বেগম। প্রায় বিস্মৃত সেই ১৯৫২ সালে।...
ঢাকা ভার্সিটিতে তখন মেয়েরা খুব কম ছিল। হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন। তাও অনেক প্রগতিশীল পরিবারের মেয়ে ছাড়া কেউ বাইরে পড়ার কথা চিন্তাও করতে পারতো না। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শিউলি নামে একটা মেয়ে ছিল। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ত। তখনকার দিনে ক্যাম্পাসে কোন মেয়ের সাথে কোন ছেলে কথা বলবে এটা কেউ তেমন ভাবতে পারতো না। শিউলি খুব মিশুক ধরনের ছিল। ক্লাসের সবার সাথে তার ভাল বন্ধুত্ব ছিল। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে কথাটা মাথায় রেখেই সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখত সে।
দ্বিতীয় বর্ষের শুরুর দিকে ইংরেজী বিভাগের চতুর্থ বর্ষের একটা ছেলের সাথে তার পরিচয় হয়। তার নাম ছিল মির্জা এজাজ হোসাইন মাহমুদ। নাম শুনেই শিউলির কেমন যেন একটু খটকা লাগে। কারন বাঙালি ছেলেদের এমন নাম শোনা যায় না বললেই চলে। আবার দেখতে বাঙ্গালী ছেলেদের মতই লাগে। তবে গায়ের রঙ বেশ ফর্সা আর নাকটা বেশ টানাটানা ছিল। দারুন বাংলা বলতে পারত। বন্ধুদের কাছ থেকে শুনে শুনে শিখেছে। বাংলা বলতে পারত এজন্য বলছি যে, ছেলেটা বাঙ্গালী ছিল না। ও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি আর ওর বাবা ছিল তৎকালীন পাকিস্তানি আর্মির লেফটেন্যান্ট জেনারেল। শিউলির সাথে ওর ক্যাম্পাসেই পরিচয় হয় আর কথাও হত ওখানেই। তখনকার দিনে একটা ছেলের সাথে একটা মেয়ের এমন কথাবার্তা ভাল চোখে দেখা হত না। এজাজ একদিন শিউলিকে বলে যে সে আরও ভাল করে বাংলা শিখতে চায়। শিউলি বলে, তুমি তো ভালই বলতে পার। কিন্তু এজাজ আরও ভাল করে শিখতে চায়। ক্যাম্পাসের এক পাশে একটা বড় পুকুরের মত ছিল। ক্লাসের পরে ওরা ওখানে গিয়ে বসে অনেক কিছু আলাপ করত। শিউলি তখন বুঝতে পারে এজাজের বাংলা ভাষার প্রতি একটা অকৃত্রিম টান রয়ে গেছে। কেন এই উৎসাহ জানতে চেয়েছে অনেকবারই কিন্তু এজাজ কিছু বলে নি। শুধু মুচকি মুচকি হেসে গেছে। একটা খাতা নিয়ে আসত এজাজ। শিউলি ওকে বাংলা লেখা শিখিয়েছিল। মাত্র অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই এজাজ বাংলা লেখা আর পড়া রপ্ত করে ফেলে ভালভাবেই।
এজাজের বাবা খুব কট্টরপন্থী ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষজনের প্রতি মনে মনে ঘৃণা পোষণ করত। সে জানত না যে তার ছেলে বাংলা জানে। একদিন এজাজ কথায় কথায় বলে যে, সে বাংলা শিখেছে। ওর বাবা এই কথা শুনে রাগে হাতের গরম চায়ের কাপ চা সহ এজাজের গায়ের উপরে ছুঁড়ে মারে। মনে মনে এজাজ অনেক দুঃখ পেলেও মুখে বাবাকে কিছুই বলে না। আচরণে এজাজ ছিল ওর বাবার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। বাংলা চর্চা এজাজ ছাড়ে না। শিউলির কাছ থেকে এজাজ অনেক কিছুই শিখে নিতে থাকে। শিউলি ওকে মাঝে মাঝে কবিতা পড়ে শুনাতো। এজাজ অনেক কিছুই বুঝতে পারতো না। শিউলি ওকে সব কিছু বুঝিয়ে দিতো। একদিন শিউলিকে অবাক করে দিয়ে এজাজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “সোনার তরী” কবিতাটা পুরো মুখস্ত শুনিয়ে দেয়। কারণ শিউলি একদিন কথায় কথায় বলেছিল যে, ঐ কবিতাটা তার অনেক ভাল লাগে। শিউলি আস্তে আস্তে এজাজের প্রতি দুর্বল হয়ে যায়। এজাজও ভালবেসে ফেলে শিউলিকে। যদিও ওরা ভাল করেই জানত ওদের এই প্রেমের পরিণতি পাওয়া আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র। অন্তত তখনকার ঐ সময়গুলোতে।
এরপরের ইতিহাস সবার জানা আছে। কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র ভাষণের পরে ছাত্র সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। কেউ মানে নিতে পারে নাই বাংলা ভাষার প্রতি এই ঘৃণ্য আক্রমন। এজাজ পাকিস্তানি ছেলে হওয়া সত্ত্বেও এই সিদ্ধান্তে ভীষণ মর্মাহত হয়। একটি ভাষার প্রতি তাদের স্বদেশী ভাষার এই আগ্রাসন ছেলেটা মেনে নিতে পারে নাই। বাবাকে না জানিয়ে বন্ধুদের সাথে আন্দলনে যোগ দিতে থাকে।
এরপর এসে গেল ২১শে ফেব্রুয়ারীর সেই ভয়াল দিনটি। সবার সাথে মিছিলে যোগ দেয় এজাজও। মিছিলের দ্বিতীয় সারিতে ছিল এজাজ অন্যদের সাথে। কেউ ভাবতেও পারেনি যে একজন পাকিস্তানি ছেলে বাঙ্গালী ছেলেদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করবে। এইটুকু বলেই সাফিয়া বেগম থেমে গেলেন। টুম্পা অধৈর্য হয়ে গেল। জিজ্ঞাসা করে, এরপর কি হল নানু? থামলে কেন?
-এরপর আর কি? পশ্চিমারা মিছিলের উপরে গুলি চালালো। কতজন মারা পড়ল।
:এজাজ এর কি হল?
-এজাজও গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়ে যায়।
:তারপর?
-পশ্চিমা এক সৈন্য এজাজকে চিনে ফেলে চিৎকার শুরু করে দেয়। বুকে গুলি খেয়ে এজাজ যখন রাস্তায় পড়ে ছিল তখন ওকে ধরাধরি করে ক্যাম্পে নিয়ে গেল। কিন্তু নেয়ার পথেই এজাজ মারা যায়।
:আহারে। বাংলা ভাষার জন্য মারা গেল পাকিস্তানি এক ছেলে। ভাবাই যায় না তাই না নানু?
-কি জানি। হয়ত বা তাই। বলেই শাড়ির আঁচলের কিনারা দিয়ে চোখ মুছেন সাফিয়া বেগম।
:তুমি কাঁদছো যে নানু? তিতলি খেয়াল করে।
-কই না তো। চোখে যেন কি পড়ল। সাফিয়া লুকাতে চাইলেন যেন।
:শিউলি’র কি হল বললে না তো?
-লেখাপড়া শেষ করে। এরপর বিয়ে হয়ে যায়। অনেকদিন আগের কথা টুম্পা।
:হ্যাঁ অনেকদিন আগের তো বটেই। টুম্পা গভীর মনযোগ দিয়ে নানীর দিয়ে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ করে এরপর নানীকে প্রশ্ন করে বসে, ‘শিউলি মেয়েটা তুমিই ছিলে তাই না নানু?’
সাফিয়া বেগম এই প্রশ্নের কোন উত্তর দেয় না। শুধু টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘পুরানো অনেক কথা এমন আছে যা আমরা মনে ঠাঁই ইচ্ছে করেই দেই না। মানুষ অনেক নিষ্ঠুর। মানুষ অনেক ইতিহাস মনে রাখে না। আমাদের ইতিহাসে অনেকের নাম লেখা থাকে না’।