মুসলিম সম্প্রদায়ের বিয়ের একটা অপরিহার্য অংশ হল মোহরানা। এটা এমন একটা অর্থ বা সম্পদ যেটা স্ত্রী’র প্রাপ্য এবং স্বামীকে অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। ইসলাম ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী এটা পরিশোধ করা না হলে বৈবাহিক বন্ধন বৈধ হয় না। মোহরানা পরিশোধ না করা আর Live-together করা একই জিনিষ বা বলতে পারেন এই বিয়ে হল Live-together এর একটা সামাজিক স্বীকৃতি মাত্র। অজ্ঞতার কারনে মানুষ আজকে এই ধর্মীয় নিয়ম কে নিছক সামাজিক প্রথায় পরিণত করে ফেলেছে। যদি জরিপ চালান হয় তাহলে আমার মনে হয় না ১% বিবাহিত লোক ও পাওয়া যাবে যারা তাদের স্ত্রীদের মোহরানা ঠিকমত পরিশোধ করে ফেলেছে। শুধুমাত্র এই কারণে মেয়েরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অথচ কয়জনের এই ব্যাপারে মাথা ব্যথা আছে? আজকের সমাজে যৌতুক নিয়ে সবাই সতর্ক এবং সবাই জানে যে ইসলাম ধর্মে এটা নিষিদ্ধ। কিন্তু মোহরানা পরিশোধ না করে স্ত্রীকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এই ব্যাপারে কোন মহলেই তেমন কোন উচ্চবাচ্য নেই। সবাই ধরেই নিয়েছে বিয়ে পড়ানোর সময় মোহরানা জাতীয় কিছু একটা থাকতে হয় আর এটা পরিশোধ করলেই বা কি আর না করলেই বা কি। কিন্তু কয়জন এটা নিয়ে চিন্তা করে দেখেছে যে এটা ছাড়া বিয়ে বৈধ হয় না? আমার প্রশ্ন হল, তাহলে যেই সামাজিক স্বীকৃতি দিয়ে বিয়ে করা হলো, সেটা যদি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ না হয়, তাহলে এই দাম্পত্য জীবনে যে সব সন্তান জন্মগ্রহন করে, তাদের জন্ম কতখানি শুদ্ধতার দাবি রাখে? শুদ্ধ বৈবাহিক বন্ধন ছাড়া কোন সন্তান জন্মালে আমাদের সমাজ তাকে ‘জারজ’ আখ্যা দিতে পটু। তাহলে যেই সমাজ ব্যবস্থাপনায় নগন্য কিছু পুরুষ ছারা কেউই ঠিকমত মোহরানা পরিশোধ করে না, তাহলে সেই সমাজের অবস্থান কোথায় গেল? পুরা সমাজটাই কি ‘জারজ’ সম্প্রদায় হয়ে গেল না? এই প্রশ্নের উত্তরের ভার আমি আপনাদের কাছেই ছেড়ে দিলাম।
বর্তমানে আমাদের সমাজে একটা আধুনিক Fashion চালু আছে। সেটা হলো মোহরানা’র অঙ্ক বা পরিমান। কন্যাপক্ষের ধারণা যে উচ্চমাত্রার মোহর ধার্য করা না হলে তাদের Prestige থাকে না। কিন্তু এই ধারণা কয়জন মেয়ের অভিভাবক রাখেন যে তাদের মেয়ের এই ন্যায্য অধিকার আদায় হবে কি হবে না? বা পাত্র আদৌ এই ব্যাপারে ওয়াকেবহাল কিনা? কিংবা পাত্রের আদৌ ওই অর্থ পরিশোধ করার সামর্থ আছে কিনা? ইসলাম তো শান্তির ধর্ম। এখানে কারও উপরে তো জোর করে কিছু চাপায়ে দেয়া হয় নাই। বিয়ে তো শুধুমাত্র একটা সামাজিক অনুষ্ঠান না বরং এর সাথে ধর্মীয় অনেক নিয়ম রয়ে গেছে যা সারা জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। পাত্রীপক্ষের এই খামখেয়ালীপনার স্বীকার হচ্ছে নিরপরাধ কিছু ছেলে আর মেয়ে। যাদের বৈবাহিক বন্ধন এর সুত্রপাত ঘটে অবৈধতার সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে। মেয়েরা তো কোন পণ্য সামগ্রী না যে বিয়ের সময় মোহরানার নাম করে তাদের কে নিলামে উঠানো হচ্ছে। বেশী মোহরানা ধার্য করে যে নিজের আদরের মেয়েকে পাত্রপক্ষের কাছে বিক্রি করে দেয়া হল সেই ব্যাপারে কয়জন বাবার মাথা ব্যথা আছে?
মোহরানার অঙ্ক তো নির্ধারণ হওয়া চাই পাত্রের সামর্থ অনুযায়ী। এখানে বাড়াবাড়ি করার কোন অবকাশ ইসলামে নেই। মুসলিম বিধিমতে যে বিয়ের মোহরানার অঙ্ক কম থাকে সেই বিয়ে এবং দাম্পত্য জীবন কল্যাণময় হয়। তাহলে এই অপরিহার্য বিধান নিয়ে একটা ছেলে আর মেয়েকে বিয়ের মাধ্যমে অকল্যাণের মধ্যে ঠেলে দেয়ার অর্থ কি? পাত্রীপক্ষ ইচ্ছামত মোহর ধার্য করছে আর পাত্রপক্ষ এটা পরিশোধ করছে না, পাত্রীর অভিভাবকের এই বিষয়ে মাথা ব্যথাও নাই; তাহলে কি এর অর্থ এই দাঁড়াল না যে, পাত্রীপক্ষ পাশ্চাত্য সভ্যতা(!)’র অনুগামী হয়ে তাদের মেয়েকে Live-together এর জন্য পাত্রের হাতে তুলে দিলেন? এখানে ভেবে দেখার অনেক বিষয় রয়ে গেছে।
এবার আমি আপনাদের কে একটা গল্প বলি। আসলে গল্প তো আমাদের জীবন আর সমাজেরই প্রতিফলন দেয়। গল্পের এমন অনেক দিক আছে যা আমাদের মুখোশধারী সমাজের আসল রুপ উন্মোচন করে দেয় খুব সহজে। যেই গল্পের কথা আপনাদের বলতে চাচ্ছিলাম সেটা একটা বিয়ের গল্প। পাত্র বিদেশে লেখাপড়া করে। ছুটিতে দেশে এসেছে। পাত্রের বাবা ছেলেকে বিয়ে দেবার জন্য অনেক আগে থেকেই মহাব্যস্ত। ছেলেই গা করে নাই। এক মাসের ছুটি। অনেক জায়গাতেই পাত্রী দেখা হচ্ছিল কিন্তু সুবিধামত পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে ছুটির একেবারে শেষপ্রান্তে এসে পাত্রীর সন্ধান মিললো। পাত্রের বাবা মহা আগ্রহে ছেলের বিয়ের তোড়জোড় এ লেগে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বিখ্যাত ‘হৈমন্তী’ গল্পের মতই অনেকটা “কন্যার বাপ সবুর করতে পারিতেন কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না......” জাতীয় পরিস্থিতি তৈরি হল। নানা জায়গা থেকে নানারকম কথা চালাচালিও হতে থাকল। যাই হক শেষ পর্যন্ত বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন হল। বিয়ে পড়ানোর আগে পাত্রকে একঘরে কয়েকজন আত্মীয় আর বন্ধু সহকারে বসানো হল এবং পাশের ঘরে বিয়ের কথা পাকাপাকি হতে থাকলো। শেষমুহুর্তে একজন এসে খবর দিল যে বিয়ের কথা লেখা হচ্ছে আর বিয়ের মোহরানা ঠিক হয়েছে ত্রিশ লাখ টাকা! এইখবর পাওয়ার পর পাত্রের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। কারণ সে নিজে এখন ছাত্র। ত্রিশ লাখ টাকা এখন সে কোথা থেকে পাবে? ঘরের মধ্যেই পাত্রের সামনে ছি! ছি! বলা শুরু হল। বলা হল যে এমন অস্বাভাবিক একটা অঙ্ক কেন ঠিক করা হল? বিয়ের শুরুই হল ‘ছি’ শব্দ দিয়ে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় পাত্রকে নিয়ে লোকে লোকারণ্য এক ঘরে বসায়ে ত্রিশ লাখ টাকা মোহরানা ধার্য করে বিয়ে পড়ায়ে দেয়া হল। বিয়ে পড়ালেন পাত্রীর এক নিকট আত্মীয়। ত্রিশ লাখ টাকার বোঝা মাথায় নিয়ে, ঘর ভর্তি মানুষের সামনে, লজ্জায় অবনত হয়ে, শুন্য হাতের এক ছাত্র যে এই বিয়ের আসরের পাত্র, তার বাবার মুখের দিকে তাকায়ে, একটা জ্বলন্ত অন্যায়ের সামনে, নতি স্বিকার করে, নীচুস্বরে ‘কবুল’ বলে বিয়েতে তার সম্মতি জ্ঞাপন করলো! হয়ে গেল বিয়ে!
এবার শুনুন বিয়ের আগের কিছু কাহিনী। বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। পাত্রীর বাবা বিয়ের কথার জন্য তার আত্মীয় কে নির্বাচিত করলেন। তিনি একজন আলেম(!) হিসাবে সমাদৃত এবং একটা নামকরা টিভি চ্যানেল(!) এ নিয়মিয়ত পদধূলি দেন। মোহরানার আলোচনায় উনি সুকৌশলে কিছু হাদিস কে এড়ায়ে গেলেন যেখানে মোহরানা কম রাখার কল্যানময় দিক তুলে ধরা আছে। পাত্র পক্ষের একজন সন্মানিত অতিথি এবং বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ এই ব্যাপারে প্রতিবাদ করেন। যতবারই উনি প্রতিবাদ করতে চান ততবারই পাত্রের বাবা তার হাত চেপে ধরেন যেন উনি আর কথা না বাড়ান। পাত্রের বাবার এহেন আচরণের মুখে উনি একসময় চুপ হয়ে যান এবং আর কিছুই না বলার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। পাত্রের বাবা ছেলের বিয়ে নিয়ে এতই বেশি চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন যে এমন অন্যায়ের মুখে উনি সবকিছু বোঝা সত্ত্বেও মেনে নেন। ছেলের অবস্থা ভাবার সময় কই! নিজে ব্যবসায়ী মানুশ। ত্রিশ লাখ টাকার অঙ্ক হয়ত তার কাছে এমন বেশী কিছু মনে হয় নাই। নিজের Status এর দিকে তাকায়ে উনি মেনে নিলেন। আমাদের সমাজের চাপায়ে দেয়া কলঙ্কময় প্রথা সামনে থাকল আর পিছে চাপা পড়ে গেল হাদিস কোরান এর মহান উপদেশ। সমাজের কুপ্রথার মুখোশ যখন আমরা মুখে তুলে নিয়েছি তখন হাদিস কোরান নিয়ে ভাবার সময় কই? ধর্মীয় উপদেশ এখন চলে গিয়েছে গ্রন্থের মধ্যে। আমাদের জীবনে এর প্রতিফলন ঘটালে আমাদের বানানো Status আর Prestige এর মুখে চুনকালি পড়বে যে! আর অন্যায়কে ন্যায় বানাতে ধর্মের খোলস দিয়ে ঢাকার জন্য এইজাতীয় কিছু তথাকথিত জালেম থুক্কু আলেম তো আছেনই। যারা মানুষের দুর্বলতম জায়গায় মোক্ষম আঘাত করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে পিছপা হবেন কেন? পরে জানতে পেরেছিলাম যে, পাত্রীকে নিজের পুত্রবধূ না করতে পারার শোক এই আলেম(!) সাহেবের মনে কাজ করছিল। আর উনি উনার কতিপয় জামাতার কথায় কান দিয়ে, হাদিস কে বস্তাবন্দী করে, ত্রিশ লাখ টাকা মোহরানার বোঝা এই পাত্রের উপর চাপায়ে দেয়। সমস্ত ঘটনা পাত্রীর বাবার সামনেই ঘটে। কিন্তু কিছুই বললেন না উনি! নিজের আত্মীয়ের এহেন অন্যায় কে মুখবুজে দেখে গেলেন। উনিও মেনে নিলেন আর পাত্রের বাবাও মেনে নিলেন। হায়রে Prestige হায়রে Status হায়রে Society হায়রে প্রাত্র-পাত্রী!
আমার গল্প বলা শেষ! পরিশেষে আমি কয়েকটা প্রশ্ন রাখতে চাই। ঐ আলেম ভদ্রলোকের কাছে আমার প্রশ্ন হল, ‘মোহরে-মেসেল’ এর নামে যে ধুন তুলে আপনি এই নিরপরাধ ছাত্রটার উপর ত্রিশ লাখ টাকার বোঝা চাপায়ে দিলেন, আপনার নিজের ছেলে হলে কি আপনি এই কাজ করতে পারতেন? সবাই তো আপনার উপর বিশ্বাস করে আপনার সিদ্ধান্ত মানবে বলেছিল। সিদ্ধান্ত দেয়ার আগে কোথায় ছিল আপনার এলেম এর কোথায় ছিল আপনার আমানতদারী?
পাত্রীর বাবার কাছে আমার প্রশ্ন, কিসের মোহে পড়ে আপনি ত্রিশ লাখ টাকার বিনিময়ে আপনার মেয়েকে বিক্রি করে দিলেন? কি এমন ঠেকা ছিল আপনার এমন অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করার? কেন আপনি দুইটা কথা বললেন না এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে? সমাজে তো মানুষ আপনার কথার অনেক মূল্যায়ন করে। আপনি তাহলে আপনার এই নতুন জামাতার কি মূল্যায়ন করলেন? নাকি এখানেও আপনার Status এর কাছে আপনিও নিজের মেয়ের জন্য Live-together কে স্বীকৃতি দিলেন?
পরিশেষে পাত্রের বাবার কাছে আমার প্রশ্ন, আপনার ছেলের কি এমন সমস্যা দেখা দিয়েছিল যে তার বিয়ে নিয়ে আপনি এত উতলা হয়ে সব অন্যায়ের কাছে পরাজিত হলেন? আপনার ছেলে কেমন, সেটা আপনার চেয়ে তো ঐ বিয়ের আসরের কেউ বেশী জানত না। নিজের ঔরসজাত ছেলেকে কিভাবে পারলেন এমন একটা জুলুমী সিন্ধান্তের মুখে ঠেলে দিতে? নিজের হাতে নিজের ছেলের মেরুদন্ড ভেঙ্গে তাকে মানসিকভাবে পঙ্গু করে না দিলে কি চলতো না?
সবার কাছে আমার শেষ আরজ, এমন ঘটনা আমাদের সমাজে চলতে দেয়া যায় না। নিজেদের মেকি Status এর মুখে আমারা আমাদের সমাজ যে ‘জারজ’ বানায়ে ফেলতেও দ্বিধা করছি না। ধিক! শত ধিক! ঐসব মানুষকে যারা মুখে ইসলামের বাণী আউড়ান অথচ নিজেদের বেলার নৈব নৈব চ। বন্ধ করেন বিয়ের আসরের এইসব প্রহসন। কেউ আর তার ছেলেমেয়েদের এমন অনিশ্চিত এবং অকল্যানময় জীবনের দিকে ঠেলে দেবেন না এই প্রত্যাশাই রইল। সবার অধিকার সুনিশ্চিত হোক আর আমাদের সমাজ তার কলঙ্কময় অধ্যায় থেকে মুক্তিলাভ করুক।
Zayed-Bin-Zakir (Shawon)
write2shawon@yahoo.com