২৪ নভেম্বর ২০২২

এবার আমি আমার নিজের জীবনের আর শৈশবের কিছু কথা বলবো। সেটাও এই বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করেই। আমার মধ্যে খেলা বিষয়ক কোন আগ্রহ নেই। আমি খেলা দেখিও না, বুঝিও না এবং আগ্রহও নেই। আসলে আমার মধ্যে বিশ্বকাপ কেন খেলা বিষয়ক কোন আগ্রহই কখনই তৈরি হয়নি। আমার শৈশবটাই এমন ছিল। আমাকে এমন ভাবে মানুষ করা হয়েছে যে এখানে খেলা ধুলার কোন আগ্রহ তৈরী করা হয়নি বরং আমার মনের মধ্যে শ্রেণীবিভেদ তৈরী করা হয়েছিল। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমাকে বুঝানো হতো, প্রতিবেশী ছেলেমেয়েদের সাথে খেলা যাবে না। ওদের সাথে খেললে আমি নষ্ট হয়ে যাবো। তাহলে আমাকে কি করতে হবে? আমাকে ঘরে থাকতে হবে। ঘরের বাইরে গেলে আমাকে দুষ্টু লোক ধরে নিয়ে যাবে, আর বাইরের ছেলেদের সাথে খেললে আমি খারাপ হয়ে যাব। বারংবার এইসব কথা শুনতে শুনতে আমার শৈশব কেটেছে এবং আমি যথারীতি মহল্লার কোন ছেলে পেলের সাথে মিশিনি এবং খেলিনি। বাবা মায়ের অনেক অনুগত এবং বাবা মায়ের কথা অন্ধের মত শুনতে যেটা হয় সেটাই আমার ক্ষেত্রে হয়েছে। অবশ্য আমার মা কে আমি সংসারে একজন সাক্ষী গোপাল হয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু কখনও দেখিনি। উনার নিজের কোন কথা ছিল না। মন্ত্রের মত আমার বাবা যা বলে দিত উনি সেইগুলাই আমার উপরে চালাতেন।

 

বাস্তব কিছু কথা বলি। ১৯৯৪ সালের কথা। আমি ক্লাস সিক্সে উঠেছি। তখন আমেরিকায় বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা হচ্ছিলো। আমেরিকার সাথে তাল মিলায়ে তখন বাংলাদেশ সময় রাতেই খেলার ম্যাচগুলো দেখাতো। তখন বিটিভি টাই সম্বল ছিল। সেটাতেই খেলা দেখাতো। সবাই রাত জেগে জেগে খেলা দেখতো। আমার বাবা মাও দেখতেন। আমারও মাঝে মাঝে ইচ্ছা হতো রাত জেগে জেগে খেলা দেখি আর নিয়ম কানুন গুলো বুঝার চেষ্টা করি। আমি রাতে খেলা দেখতে বসলে উনারা অনেক বিরক্ত হতেন এবং আমাকে খেলা দেখতে দিতেন না। আমার মা আমাকে বলতেন, সকালে উঠে স্কোর শুনে নিও। তাহলেই হয়ে যাবে। আর আমাকে বারবার দোহাই দেয়া হত, কালকে স্কুল আছে। খেলা দেখা যাবে না। আর ছুটির দিন থাকলে বলা হত স্যার আসবে, পরীক্ষা আছে হ্যান ত্যান ইত্যাদি। মোটকথা আমাকে কখনই খেলা দেখতে দেয়া হত না।

 

১৯৯৪ সালেরই কোন এক খেলার সময় বাবাকে বলেছিলাম, পরের বাপ বিশ্বকাপ যখন হবে তখন আমি ক্লাস টেন এ পড়বো। আমাকে উত্তর দিলেন, তাহলে তো তোমার খেলা দেখা হবে  না। আমি বললাম কেন? তখন বললেন, কারণ তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৯ সালে আমার মাধ্যমিক তথা এস.এস.সি পরীক্ষা চলবে। সুতরাং আমাকে তো ভাল রেজাল্ট করতে হবে। খেলা দেখলে আমি পড়ালেখা করবো কখন? কাজেই ম্যাট্রিকে ভাল রেজাল্ট করতে হবে দেখে চার বছর আগেই আমার হাত পা বেধে দেয়া হল যেন আমি খেলা না দেখি। এরপর থেকে সত্যি করে বলছি, খেলা দেখার উপরে আমার বিতৃষ্ণা চলে আসে। এরপর আমি খেলা দেখি নি। এখনও দেখি না। স্কোর শুনি। কারণ ছোট বেলায় আমাকে শেখানো হতো স্কোর শুনে নিও। এখনও আমি স্কোর শুনি। খেলা দেখার কোন আগ্রহ পাই না। একটা ইন্ট্রোভার্ট বাচ্চাকে যে আগ্রহ জাগিয়ে তুলে খেলাধুলায় আগ্রহী করা উচিত সেটা আমাদের পিতা মাতাকে কে বোঝাবে? উনাদের মানদন্ডে উনারা তো সকল ভুলের উর্ধ্বে ছিলেন। যারা সকল ভুলের উর্ধ্বে বসে থাকেন, তাদের ভুল কে ধরবে? সমাজ? না আমি?

 

আমার শৈশবে আমি সংখ্যবার আমার বাবা এবং মায়ের মুখে শুনেছি, আমরা নাকি ফার্মের মুরগির মত বড় হচ্ছি। আমরা কিছু বুঝি না পারি না। আমরা খেলা ধুলা জানি না। আর উনাদের সময় উনারা কত রকমের খেলা ধুলা করতেন। স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগ ঘরে ফেলে দিতে যতক্ষন দেরী, খেলতে নেমে যেতে নাকি দেরী হত না। সাঁতার কাটতে নামলে বড়রা মারতে না আসা পর্যন্ত পানি থেকে উঠতেন না। আর সেই তুলনায় আমরা? আমরা কিছু পারি না কারণ আমরা ফার্মের মুরগী। আর উনারা সম্ভবত দেশী মুরগি ছিলেন। পাকিস্তানি কক মুরগি বলা যাচ্ছে না, কারণ ওগুলাও চাষ করে। আমাদের কে সব দিক দিয়ে অক্ষম করে পালা হয়েছে, সব রকম লাইফ স্কিল থেকে দূরে সরায়ে লালন পালন করা হয়েছে, এরপর আমাদের ক্ষণে ক্ষণে কথা শুনানো হয়েছে। আমাদের জীবন, আমাদের আনন্দ, আমাদের শৈশব সবকিছুকেই বই, লেখাপড়া আর ভাল রেজাল্ট এর গন্ডিতে আবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর বাইরে যেন আমাদের কোন জগত নেই। গান শোনা যাবে না, জিন্স পরা যাবে না, সানগ্লাস পরা যাবে না। উনারা যা বলবেন এর বাইরে কোন কিছুই করা যাবে না। কোন ভালও মানুষ কি জিন্স আর সানগ্লাস পরে নাকি? ওগুলা তো পরে শুধু মাস্তান আর সন্ত্রাসীরা। এসব শুনে বড় হতে হয়েছে আমাদের। এত কিছুর পরেও কি আমাকে যৌন নিপীড়ন থেকে বাঁচাতে পেরেছিলেন উনারা? না সে বিষয়ে কোন খবর রাখতেন?  

 

এখন আমি নিজেও একজন পিতা। আমি আমার বাচ্চার সাথে কার্টুন দেখতে বসি। ওরা যদি কোন অ্যানিমে মুভি দেখে তো সময় থাকলে আমিও বসি। ওদের সাথে গল্প করতে করতে মুভি দেখি। ভালও না লাগলেও ওদের সাহে আনন্দ ভাগাভাগি করতে চেষ্টা করি। আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি যেন বাচ্চারা খেলা ধুলায় আগ্রহী হয়। আমার বাচ্চা যদি মহল্লার বাচ্চাদের সাথে খেলে তো একটু দূরে বসে দেখতে তো অসুবিধা নেই। আমার বাচ্চা কার সাথে মিশছে না মিশছে সেটা তদারকি করার দায়িত্ব অবশ্যই বাবা হিসেবে আমার। কিন্তু ঢালাও ভাবে আমি তো প্রতিবেশী বাচ্চাদের সাথে মিশতে মানা করতে পারি না। ওদের কে খারাপ ভাবতে শেখাতে পারি না। নিজেরা যকঘন নাটক সিনেমা দেখি, যদি ওদের দেখার উপযুক্ত হয় তো সাথে বসাই। নিজে যখন রাস্তায় হাঁটতে নামি তখন বাচ্চাদের সাথে নেই। ওরা সাইকেল চালায়। আমি ওদের খেলাধুলার দিলে খেয়াল রাখি। মেয়ে যা যা শিখতে চাইছে, সবকিছু ওকে দিতে চেষ্টা করছি। মেয়ে মার্শাল আর্টস, ছবি আঁকা, স্কেটিং, সাঁতার যা যা শিখতে চায় সবকিছু আস্তে আস্তে ওকে শেখাচ্ছি। কখনও ওকে বলি না, তোমাকে ফার্স্ট হতেই হবে, ওমুকের চেয়ে বেশী নাম্বার পেতে হবে! ওর বন্ধুরা কে কি নাম্বার পেলো কখনই জানতে চাই না। মেয়ের রেজাল্ট কার্ড এ কোন নাম্বার কোম দেখলে বলি, ভাল করসো। আরেকটু মন দিয়ে পড়, এর পরের বার দেখবা আরও ভালও করবা। পরের বার ঠিকই নিজে থেকেই ভাল করে রেজাল্ট দেখায়। ওদের রেজাল্ট কার্ড আমাদের সামনে নিয়ে আসতে ওরা ভয় পায় না। জানে আব্বু আম্মু বকা দিবে না, গালিগালাজ দিবে না। বাচ্চার মায়ের সাথে গোপনে গোপনে আলাপ করি, মেয়ের কোন বিষয়ে কমতি আছে আর কোন দিকে নজর দেয়া লাগবে। সেইভাবে পরামর্শ করে কাজ করি।

 

আমার বাচ্চারা এখন জার্সি পরে ঘুরে বেড়ায়। বিশ্বকাপ দেখুক বা না দেখুক বিশ্বকাপের আনন্দ ওদের ছুঁয়ে গেছে। আমরা ওদের শৈশবকে আনন্দ দিয়ে মুড়ে দিতে চাইছি। সময়ের সাথে সাথে সবকিছু পরিবর্তন হয়। শুধু বদলানো যায় না আমাদের অতীত। যা ফেলে এসেছি, তা শুধু ক্ষণে ক্ষণে একটা না পাওয়ার যন্ত্রণা দিয়ে যায়। কিছু করার থাকে না।      

View shawon1982's Full Portfolio