নতুন নতুন যারা কথা শিখেছে(!) এদের মুখে “প্রোডাক্টিভ ওয়ার্ক” এবং “আন-প্রোডাক্টিভ ওয়ার্ক” কথাগুলো বেশ শোনা যায়। বেশ গালভরা দুইটা শব্দ। যারা উচ্চারণ করে তাদের ভাব(!) তখন দেখার মত হয়। উচ্চমার্গীয় বোদ্ধা হয়ে তাঁরা এই শব্দগুলো অন্যের উপরে ছুঁড়ে দেন। যার উপরে ছোড়া হল সে কতখানি বিদ্ধ হলো সেটা দেখার টাইম কই? শব্দদুটা বলতে গিয়ে গায়ে যে একটু গরম গরম ভাব হলো সেটা ঠান্ডা হতে তো একটু টাইম লাগে। বর্তমানে মিডিয়ার যুগে অবশ্য আমরা সবাই বোদ্ধা এবং বাক-যোদ্ধা! মিডিয়ার ব্যবহার এর কল্যানে এখন ঘরে ঘরে “মহামান্য বিচারক” এর ছড়াছড়ি। সবাই এখন বিচারকের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়ে যায়। আগুপিছু বিবেচনা করার দরকার নেই। নিজের মনে যা হল শুধু সেটার উপরে বিবেচনা করে বিচারের রায় ছুঁড়ে দিলেই হল। সেই সাথে ঐ দুটো শব্দ তো আছেই। প্রোডাক্টিভিটির সাথে অর্থের যোগ থাকতেই হবে যে! অর্থ এলো তো খুব প্রোডাক্টিভ! আর অর্থ নেই, তো কিছুই নেই। সবকিছুই চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় গন্ডিতে আবদ্ধ করে দিয়ে দিয়ে আমরা আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলি। টাকা থাকতে হবে তো! টাকা নেই তো মান সন্মান আবার কি? সাহিত্য আবার কি? ফুহ!
মহান বিচারকের ভুমিকা পালন করতে করতে আমরা ভুলেই যাই যে “আমি” টা আসলে কি আর “আমার” যে আসলে কি দরকার! দায়িত্ব কর্তব্য পালন এবং ঐ যেই অর্থের “প্রোডাক্টিভিটি” এর জন্য আমরা নিজেদের “আমি” টাকে কবর দিয়ে দেই কোন জানাজা দেয়া ছাড়াই। মৃত মানুষকে কবর দিতে হয় একবার। কিন্তু আমরা আমাদের “আমি” কে কবর দেই দিনের মধ্যেই অসংখ্যবার। কোন বিকার নেই, কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, কোন আফসোস নেই। শখের জন্য কিছু করা মানে বিলাসিতা। শখের বসে কিছু লেখা মানেই ফালতু সময় নষ্ট। শখের বসে বই কেনা মানেই টাকার অপচয়। আর শখের বসে একটু গান শোনা বা আড্ডা দেয়া মানেই হল নষ্ট হয়ে যাওয়া। আমাকে নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচতে হবে। নিজেকে সমাজের দেয়ার আবরণের মধ্যে লুকিয়ে নিথর করে রোবট হয়ে যেতে হবে। মহামান্য বিচারকের চোখে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। না হলে তো সব শেষ হয়ে গেল। প্রোডাক্টিভিটি গোল্লায় গেল। যে কাজে টাকা সে না, সেটা আবার কাজ নাকি?
আমাদের দেশে “কলাবিদ্যা” তথা আর্টস কে “কলা” দেখানো লোকের অভাব নেই। যারাই একটু সাহিত্য নিয়ে ভাবে, কবিতা ভালবাসে, কবিতা লেখে, গল্প লেখে, নাটিক ঠিয়েটার করে- আপামর অনেকেরে কাছেই এরা হল নিষ্কর্মা আর গাঞ্জুট্টি তথা গাঞ্জাখোর। সবাই কে কি এক পাল্লায় মাপা যায়? সাহিত্য মনা হলেই সবাই গাঞ্জাখোর হবে? এই বিচারের মাপনি মানুষ কোথা থেকে পেয়েছে? সাহিত্য যে আত্মার খোরাক, সেটা আত্মাহীন এবং বিবেকের মুন্ডুহীন মানুষগুলো কিভাবে বুঝবে? যার আত্মা বলে কিছু নেই, সে কি করে বুঝবে আত্মার পরিস্ফুটনের জন্য কি দরকার? আমাদের কে ছোট বেলা থেকেই “এক্সট্রুডার” মেশিনের মধ্যে দিয়ে বড় করা হয়। এক দিক দিয়ে ঢোকানো হয় আর এক দিক দিয়ে গলে টলে “জিনিস” বের হয়ে আসে। আমরা “জিনিস” পয়দা করি, “জিনিয়াস” না। কারণ মেধার মূল্যায়ন আমরা শিখি নাই। সাহিত্যিক পরিচয় দিতে আমরা লজ্জিত হই। পেশার কলামে সাহিত্যিক বা কবি কথাটা লিখতে শিখি নি আমরা। আমরা কুন্ঠিত হয় এই কথা বলতে যে, আমি কবিতা লিখি। আমি সাহিত্য ভালবাসি। সমাজ আমাদের “আমপ্রোডাক্টিভ” কাজ শেখায় না। সাহিত্য মানেই হল “আনপ্রোডাক্টিভিটি”। বোদ্ধাদের কাছে।
আমি আগে এতো একরোখা ছিলাম না। এখন হয়ে গেছি। এখন নিজেকে “প্রোডাক্টিভ” করার চেয়ে “আনপ্রোডাক্টিভ” করতেই বেশী পছন্দ করি। ছোট মেলা থেকেই “এক্সট্রুডার” মেশিনে থেকে ভাবতাম কবে মুক্তি পাবো। আমাকে মুক্তিটা দেবে কে যদি আমি নিজেকে নিজে মুক্ত না করতে পারি? আমি যখন আসুস্থ হই, আমি যখন কোন সমস্যায় পড়ি, কই তখন তো কোন বাকপটু বিচারক কে দেখি না আমাকে এক বেলা খাওয়ায় দিয়ে যায়! আমার শরীরের খোঁজ খবর নেয়? কই কোথায় থাকে তখন তাঁরা? যারা আমার কোন উপকারেই আসে না কিছু কথা শোনানো ছাড়া, তাদের কথা শুনে কেন নিজেদের আত্মিক সত্ত্বাকে শেষ করে দেবো? কক্ষণও না। এতে আমাকে সমাজের বিরুদ্ধে যেতে হলে যাবো। আমাকে “বেয়াদব” খেতাব দেয়া হবে? এখন আর পরোয়া করি না। একসময় মানুষের চোখে “ভাল” থাকার চেষ্টা করেছি। সেই চেষ্টা করতে গিয়ে, সবই হারাইসি। কিছুই নেই। শুধু আমার আমি টুকু ছাড়া। ঐটুকু কে আর এখন মারতে পারবো না। নাই বা হলাম সমাজের চোখে ভাল। নিজের কাছে অন্তত বাঁচতে চাই।