তীব্র অনুতাপে ভুগছি গত দুই তিনদিন ধরে। কিছুতেই ভুলতে পারছি না। আমার মনের ভেতরে তীব্র খারাপ লাগে কাজ করছে। আর নিজের মনে মনে ভাবা কিছু ব্যাপার আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। সবসময় যুক্তি দিয়ে জীবন চলে না। আমরা অনেক সময় আবেগের কাছে পরাস্ত হই। ইগো প্রবলেম দিয়েও সব সমস্যার সমাধান হয় না বরং সমস্যা বেড়ে চলে। কিন্তু ঘটে যাওয়া ঘটনা যখন বারবার মনে পড়তে থাকে তখন খুব খারাপ লাগতে থাকে। আমার সেটাই হচ্ছে। আমি আমার মনের এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাচ্ছি না। আমার মনের মুক্তি খোঁজার একটা চেষ্টায় আমি লেখার চেষ্টা করি। লিখে মনের ভার কতটা কমাতে পারবো জানি না তবে লিখতে গিয়েও মন ভার হয়ে যাচ্ছে।
দুইদিন আগে এক রোগীকে দেখতে গেলাম আমি আর নাঈমা। নিজের মনে মনে যুক্তি দাঁড় করালাম। নিকট না দূর এই হিসাব করতে বসে গেলাম। নিজের জালে নিজেই আটকা পড়লাম। অহেতুক নাঈমাকে দুই কথা শুনায়ে দিলাম। বেচারি চুপচাপ শুনে আমাকে বুঝাতে গিয়ে ব্যর্থহয়ে চুপ করে গেল। বাসা খুঁজে পেতে দেরী হচ্ছিলো। নাঈমা বাসাটা সহজে খুঁজে পাচ্ছিলো না। এজন্য আমার মেজাজ আরও চড়ে যাচ্ছিলো। আমার কাছে অর্থহীন মনে হচ্ছিলো। আমি যখন রাগ করি, তখন সেটা চাপিয়ে রাখতে পারি না কিছুতেই। আমার বড় ব্যর্থতার গুলোর একটা এটা। আমার মুখ দেখেই নাঈমা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলো আমার রাগ হচ্ছে। বাসা কেন খুঁজে পাচ্ছে না এজন্যও ওকে দুই কথা শুনায়ে দিলাম! বললাম, মাস খানেক আগে এলে, এখন খুঁজে পাচ্ছো না কেন? মেমরি এতো কম কেন? এরপর ভুল লিফট এ উঠে ভুল বাসায় চলে যাবার কারণে আমার মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল। যাই হোক, রাগ হজম করতে করতে অবশেষে সেই বাসা খুঁজে পেলাম যেখানে রোগী অবস্থান করছেন।
বাসায় গিয়ে আমি ড্রইং রুমে বসে ছিলাম। নাঈমা আগে গিয়ে দেখা করে আসলো। প্রায় আধা ঘন্টা পরে রোগী নিজেই উঠে এলেন। আমাকে ডাক দিলেন। আমি গিয়ে ডাইনিং টেবিলে তার পাশে বসলাম। রোগী একজন ডায়াবেটিক পেশেন্ট। সুগার লেভেল অনেক বেশী। মাস দুই তিনেক আগে ডান পায়ে আঘাত প্রাপ্ত হন। এরপর থেকে জটিলতা বাড়তে বাড়তে এখন মারাত্মক পর্যায়ে চলে এসেছে। অপ্রতিরোধ্য ব্যথায় তিনি শুতে পারেন না, ঘুমাতে পারেন না। অসহ্য ব্যথা দিবানিশি তাকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছে। পায়ের পাতায় কালো হয়ে গিয়েছে। আমি দেখেই বুঝতে পেরেছি যে খুব সম্ভবত উনার গ্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছে (আল্লাহ না করুন)। আমার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। এই বয়সে যদি এখন উনার পা টা কেটে ফেলতে হয়... আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না। সেদিনের পর থেকে আমি এক মুহুর্তও সেই রোগীর কথা মাথা থেকে দূর করতে পারছি না এবং অনুশোচনায় ভুগছি আমার করা আচরণের জন্য। কেন এমন করেছি আমি?
আমার দুই হাটুতে অস্টিওফাইট আছে। হাড্ডি চোখা হয়ে যাওয়া। পা ভাজ করে বসতে পারি না এবং বেশী হাঁটলে পা বেথা করে। গত সাত বছর ধরে এই রোগ বয়ে নিয়ে চলেছি। আমার মনে হত আমি কত কষ্টে আছি। কিন্তু গতদিন এই রোগীকে দেখার পর থেকে আমি সত্যিই অনেক বেশী ভারাক্রান্ত। সারাক্ষণ দোয়া করে যাচ্ছি মন থেকে। এই মানুষটার যদি একটা পা কাঁটা যায়, কি অসহনীয়ন জীবন তাকে কাটাতে হবে। এটা ভেবে আমার অনেক খারাপ লাগছে। আপনারা যারা এই লেখা পড়বেন তাঁরা সবাই উনার জন্য দোয়া করবেন। আর আমার জন্যও দোয়া করবেন যেন মানুষের মত মানুষ হতে পারি। জীবনের সবকিছু হিসাব মিলিয়ে চলে না এটা যেন বুঝতে পারি। কাউকে দেখতে যাবার ব্যপারে যেন কাছের দূরের হিসাব না করি। আমার কিছু ভাল লাগছে না।