গতকাল গিয়েছিলাম আমার এক খালাতো বোনের বিয়েতে। যেহেতু খালাতো বোনের বিয়ে সেহেতু সেখানে আর অনেক খালাতো মামাতো ভাই বোনের সাথে দেখা। পারিবারিক এই অনুষ্ঠান গুলোর বড় সুবিধা এটাই বলে মনে হয় আমার কাছে। দীর্ঘদিনেও যাদের সাথে দেখা হবার বা কথা হবার সুযোগ হয় না, এখানে এলে তাদের সাথে দেখা হয়, কথা হয়। আরেক সমবয়সী খালাতো বোনের সাথে দেখা। ও ডাক্তার। আমরা একই বয়সী। আমার এই বোন আবার আমার ফেসবুকের যাবতীয় লেখাই পড়ে। আমাকে আবার নানা রকমের পরামর্শও দেয়। ওর সাথে আমার এই যাতীয় পারিবারিক অনুষ্ঠান ছাড়া দেখা হয় বলে মনেই হয় না। কাল ও আমাকে বললো, তোমার লেখায় এত দুঃখ কেন? আমি বললাম, সবই যে আমার নিজের জীবনের কথা লিখি তাও কিন্তু না। মাঝে মাঝে তো আসপাশ নিয়েও লিখি। তখন ও বললো, না না, তোমার লেখায় সেটায় মনে হয় না। আমার অবস্থা তখন ধরা পড়া ইঁদুরের মত। কোন দিকেই পালাতে পারছি না। তখন ও হাসতে হাসতে বললো, কথা শেয়ার করবে। মনের মধ্যে ডিপ্রেশন চেপে রাখবে না। আবার না তুমি সুইসাইড করে বসো। এবার আমার এক প্রস্থ হাসির পালা এলো। আমি বললাম, না না তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পার, আমি অন্তত সুইসাইড করে বসবো না।
ব্যাপারটা আসলে সেটাই। আমার জীবনে যত দুঃখ, সেটা বাড়ছে, ক্রমশই বাড়ছে। দুঃখের সাথে ক্ষোভ ও বাড়ছে। কিন্তু দুঃখ যতই হোক না কেন, সেটা আমাকে আত্মহননের দিকে নিতে পারবে না। যদি সম্পূর্ণ মস্তিষ্ক বিভ্রাট না হয় আর কি! মানসিক রোগী হবই তাও তো গ্যারান্টি দিতে পারছি না। আর হলেই বা কি? তাতে কার কি লাভ? আমার নিজের কোন লাভ আছে? থাকলে আমাকে জানান। তাহলে আমি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যেতে চাইবো। আর পাগল মরে গেলে কেউ মনে রাখে না। এই প্রসঙ্গে আমার একটা কথা মনে হলো। আমরা কতকাল মানুষের স্মরণে থাকি? সেলিব্রিটি হবার কথা বলছি না। আমরা সাধারণ মানুষ? বংশানুক্রমিক ভাবে আমাদের বা একজন মানুষ কে কয় জেনারেশন মনে রাখে? উত্তর হলো, আমার মনে হয় যে কয় জেনারেশন তাকে দেখেছে কিংবা কতদিন ধরে চেনে বা দেখেছে। আমরা আমাদের নানা, দাদাদের পর্যন্তই দেখি সাধারণত। কাজেই ঐ জেনারেশনের পর্যন্তই মায়া কাজ করে। এর পরে? আমার সন্তানরা কি কোন আবেগের বশে আমার নানা দাদাদের স্মরণ করবে? কোন কারণ আছে কি? আমি নিজেই কি আমার বড়ো আব্বা বা বড় আম্মাদের স্মরণ করি যদি উনাদের স্মৃতি না থাকে? আমার জন্য আমার মায়ের নানী (বড় মা) কিছুটা ব্যতিক্রম। আমি উনাকে দেখেছি। আমি উনার একটা ছবি আমার লাইব্রেরী ঘরে বাধাই করে রেখে দিয়েছি। একটাই কারণ, আমি আসলে উনাকে ভুলতে চাচ্ছি না। আমি উনাকে বার বার মনে করতে চাচ্ছি বলেই উনার ছবি বাধাই করে রেখে দিয়েছি। তাহলে কথার সারবস্তু কি পেলাম? সর্বোচ্চ দুই জেনারেশনের মনের তালিকায় থাকতে হয়ত পারি। সেটা কত বছর? একশ? না হয় ধরেই নিলাম আরও কিছুদিন? তারপর? তারপর চিরতরে বিস্মৃত হয়ে যেতে হবে।
এটাই যদি আমাদের জীবনের বিস্তৃতি হয় তাহলে আত্মহনন করে কি পাবো? আদৌ কিছু থাকবে ভাগে? যদি মরেই গেলাম, তাহলে আমাকে নিয়ে কি কি হলো বা না হলো তাতেই বা কি যায় আসে? জীবিত মানুষ নিয়েই যেখানে কারও কিছু যায় আসে না সেখানে মৃত মানুষ বা আত্মহনন করে শেষ করে দেয়া মানুষ নিয়ে কার কি যায় আসে। আমার এক মামাতো ভাই ২০০৩ সালে আত্মহনন করে মারা যায়। কই কারও আলোচনায় তো ওকে আসতে দেখি না। ওর বাবা জীবিত আছে। তার কি মনে পড়ে? আমার সেই মামাকে সামনে পেলে একদিন জিজ্ঞাসা করে দেখা যেতে পারে। কি লাভ? ফিরে আসবে? ফিরায়ে আনতে পারবো? আহা উহু করা ছাড়া আর কিছু করার আছে? নেই। কাজেই আত্মহনন করে রাতারাতি কয়েক দিনের জন্য আহা উহু আর হিরো হয়ে কিছুই তো পাবার নেই আমার। কাজেই সে পথে কেন যাবো? নেই তো, কিছুই নেই। ধর্ম বিশ্বাস প্রসঙ্গ আপাতত অনুক্ত রাখলাম। যদিও বিশ্বাসী হিসেবে সেটা আমি বাদ দিতে পারি না। তবুও আপাতত তোলা থাক।
আমরা নিজেরা কে কাদের কতটুকু মনে রাখি? রাখতে চাই? দয়া করে কাজের দোহাই দিয়েন না। সবাই কোন না কোন কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকে। আমি আমার নিজের জীবন দিয়ে বলি, সৃস্টিকর্তার নামে শপথ করে, কসম করেই বলছি, এগুলা মিথ্যা অযুহাত। মিথ্যা দোহাই। মনে করতে চাই না দেখেই মনে পড়ে না। ছদ্মবেশের আড়ালের কিছু মিথ্যা কথা যে কাজে ব্যস্ত ছিলাম। কাজে ব্যস্ত আমিও থাকি। অবশ্য অনেকের মনে হতে পারে, প্রাইভেটের মাস্টার তো। এগুলো তো কোন কাজ করে না। সারাদিন শুয়ে বসে থাকে। এমন যারা ভাবে তাদের কথা আলাদা। প্রাইভেটের মাস্টার বলে অনেকের সন্মানের ন্যুনতম কোটাতেও আমরা থাকি না। কারণ আমরা তো “মাস্টার” না। আমরা হলাম “প্রাইভেট এর মাস্টার”। আমি বুঝিয়েছি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকতা। বিজ্ঞ পাঠক বুঝে গেছেন আমি জানি। তবুও বলে দেয়া। তাদের জন্য যারা বুঝেও বুঝতে চাইবে না। আর এক শ্রেণির মানুষের জন্য। যাদের সবকিছুর জন্য অনেক “চিনি” থাকে। উনারা সুগার-কোটিং এর ওস্তাদ।
আমি যাদের মনে করতে চাই, আমি যাদের সত্যিকারের ভালবাসি, যাদের কে মনে মনে ফিল করি, মিস করি অথবা যাদের জন্য শূন্যতা অনুভব করি, তাদের জন্য তো আমার সময়ের কোন অভাব হয় না। শত হাজার কাজের ব্যস্ততার মাঝেও, সামান্য একটু টোকা দিয়ে খোঁজ খবর নিতে তো আমার কোন সমস্যা হয় না। ঠিকি তো তাদের সাথে যোগাযোগ রাখি। হয়ত কথার পরিমাণ কিছু কম হয়। কিন্তু মাসের পর মাস, দিনের পর দিন তো ভুলে থাকি না। যাদের জন্য মনে শূন্যতা তৈরী হয়, ভালবাসা তৈরী হয়, তাদের কথা তো এক মুহুর্তের জন্যও ভুলি না। প্রতি মুহুর্তে মনে পড়ে। কাজের মধ্যে নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যাই, কিন্তু তাদের স্মরণ করতে তো ভুল হয় না।
এবার একটু উল্টা দিকের কথা কথা বলি। যাদের জন্য আমার মনের ভেতরে শূন্যতা তৈরি হয়, তাদের মনে আমার জন্য সামান্য একটু “পিঁপড়ার কামড়” ও তৈরী হয় না। কারণ তাদের তরফ থেকে সাড়া পাওয়া যায় না যে। আমার পরাণ জ্বলে, কলিজা হলে, শ্বাসকষ্ট ও হয়- কিন্তু বিনিময়ে তাদের মনে আমার জন্য একটু পিঁপড়ার কামড়ও তৈরী হয় না। হলে বোঝা যায়। তাদের মনে পিঁপড়া কেন, কুমিরের কামড় তৈরীও হয়। তবে সেটা আমার জন্য না। অবশ্যই অন্য মানুষের জন্য। সেটাই দেখে আসছি। বাকী সারাজীহব দেখেই যেতে হবে। একটা দিক ভালই হল। শূন্যতা তৈরী হওয়াটা। শূন্যতা তৈরি না হলে, শূন্যতা বলে কিছু না থাকে সাহিত্য আসতো না। লেখক কবি তৈরী হতো না। অতি আনন্দে ভরপুর থাকলে দুই একটা ছন্দময় ছড়া তৈরী হতে পারে সর্বোচ্চ। এর বেশী আর কোন সাহিত্য শূন্যতা ছাড়া আশা করা যায় না। আমার সারা জীবনের উপলব্দি এটাই। আপনারা একমত নাও হতে পারেন। আমি এটাই বুঝি শূন্যতা ছাড়া লেখা হয় না। সাহিত্য তৈরী হয় না।
কয়েকদিন আগে রাস্তায় চলতে গিয়ে বাম পা টা মচকে যায়। ভালই মচকায়। প্রথম দুইদিন তেমন কিছু বুঝতে পারি নি। এরপর শুরু হয়েছে ব্যথা। পা ফুলে ফেল। খোঁড়াই হয়ে গেলাম দুই তিন দিনের জন্য। এত প্রচন্ড ব্যথা! পায়ের পাতায় ব্যথা অথচ পুরো শরীর অকেজো হয়ে গেল। হাটতে যদিও পারছিলাম কিন্তু প্রতি মূহুর্তে পা টনটনিয়ে উঠেছে। বুঝতে পারলাম একটা জিনিস। শরীরের ব্যথাও মনের ব্যথার চেয়ে অনেক ভাল। শরীরের ব্যথা সবকিছু ভুলায়ে দিতে পারে। কিন্তু মনের ব্যথা? মনের ব্যথা তো কিছু ভুলতে দেয় না। এই কথাটুকু আমি ফেসবুকে দিয়েছিলাম। ইচ্ছা করেই দেই মাঝে মাঝে। অ্যাটেনশক সিক করতে না। আমার অতি প্রিয় মানুষদের প্রতিক্রিয়া দেখতে। যাদের জন্য আমার মনে ব্যথা তৈরী হয়, শ্বাসকষ্ট হয়, মনের ভেতরে অনেক বড় বড় গহ্বর তৈরী হয়, একরাশ শূন্যতা তৈরী হয়। তাদের খুঁজে বেড়াই। বেশী ভাগ প্রতিক্রিয়া তাদের থেকে পাই, যাদের আশাও করিনি। অথবা যাদের জন্য আমার সেই অনুভুতি তৈরী হয়নি। তারাই বেশী খোঁজ খবর নেয়। কি অদ্ভুত না?
আমার খুব অতীতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। সেই আগের দিনের মত করে। ঠিক আমার সেই স্কুল জীবনের মত করে। স্কুল জীবনে সেই ১৯৯৪ সালে বইতে পড়েছিলাম “পেন-ফ্রেন্ড” বা পত্রমিতালির কথা। সেই থেকে মোটামুটি ২০০২ পর্যন্ত পত্র মিতালি করে এসেছি চিঠি পত্রের মাধ্যমে। আমার অনেক বেশী প্রিয় শখের একটা। ২০ বছর পরে ২০২২ এ এসে আমার আমার সেই শখকে নতুন করে শুরু করেছি। আমার সেই আগের দিনের মত করে চিঠি লিখছি, এবং পোস্ট অফিসে গিয়ে চিঠি পোস্ট করছি। আবার সেই আগের দিনের মত পত্রমিতাদের চিঠির অপেক্ষাও করছি। অথচ মেসেঞ্জারে টোকা দিলেই দিনের মধ্যে হাজারটা কথা বলা যায়। তবুও! চিঠিই লিখি। তাদের খামে মোড়া হাতে লেখা চিঠিই আশা করি। আমার নতুন নতুন বেশ কিছু পত্রমিতা তৈরী হয়েছে। আমেরিকা, জর্জিয়া, অস্ট্রিয়া, জার্মানী, ইতালি, মালাউই, উগান্ডা, ত্রিনিদাদ, ফিলিপাইন সহ কয়েকটি দেশে আমার কিছু ভাল পত্র বন্ধু তৈরী হয়েছে। এদের জন্য মনের মধ্যে শূন্যতা এখনও তৈরি হয়তো হয়নি, কিন্তু ভাললাগা তৈরি হয়েছে নিশ্চই।
আমার ব্যথার পোস্ট পড়ে আমার “ব্যথার দান” বন্ধুদের মনে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া তৈরী হয়নি। ওরা ব্যস্ত। ওদের অনেক কাজ। ওরা নানা রকম অফিসে কাজ করে। কেউ তো আর আমার মত “প্রাইভেট মাস্টার” না। কাজেই প্রাইভেট মাস্টার দের জন্য এত আজাইরা সময় কই? ওরা খোঁজ নেয় না। আমি একরাশ শূন্যতা নিয়ে অপেক্ষা করি। কিন্তু আমার মেসেঞ্জারের ইনবক্স ভরে যায় নানা রকম সান্ত্বনার মেসেজে। কারা দেয় জানেন? আমার এই না দেখা বিদেশী বন্ধুগুলা। ওরা আমার ফেসবুকের বাংলা লেখাগুলো ইংলিশে বা নিজের ভাষায় অনুবাদ করে পড়ে এরপর আমাকে বোঝার চেষ্টা করে এবং প্রায় প্রতিদিন নিয়ম করে করে সকাল সন্ধ্যা আমার খবর নিয়ে যাচ্ছে। ঠিক যেমনটা আমি করি আমার সেই শূন্যতার মানুষগুলোর জন্য। যাদের জন্য মনে শূন্যতা তৈরি হয়। আমি টের পেলে তাদের খোঁজ নেই। সাধ্যমত নেই। মন থেকে ভুলে যাই না কখনই। আমার জর্জিয়ান বন্ধুটা গতকাল আমাকে কি বলেছে জানেন ইনবক্সে? আমি অনুবাদ করে বলছি। “শাওন আমি জানি না তুমি আমার কাছে সিক্রেট রাখবে কিনা। তবুও আমাকে বল, তোমার কি হয়েছে? তোমার আসলে কোথায় ব্যথা? তুমি কি শরীরে কোন ব্যথা পেয়েছ না কি তোমার কাছের কেউ মারা গেছে? তোমার আপত্তি না থাকলে তুমি আমাকে বল”। আমার মালাইউ এক বন্ধু আমাকে বলেছে, তোমার ব্যথা না কমা পর্যন্ত আমি তোমার জন্য প্রার্থনা করতেই থাকব। এইসব কথা যখন আমার না দেখা বন্ধুরা বলে তখন আমার কি মনে হয় জানেন? আমার একটাই কথা মনে হয়। শূন্যতা কি জিনিস তা আমার এখনও বোঝার বাকী আছে। আমার মানুষ হতেও আরও কিছুটা বাকী আছে।