স্মৃতির পাতা থেকে সবগুলো জন্মদিনের কথা
========================
দেখতে দেখতে জীবনের ৪০টি বছর পার করে ফেললাম। ছাত্রজীবনে ভাবতাম, এই বয়সটা কেমন হতে পারে। সেই বয়সেরই দ্বারপ্রান্তে এসে এখন আর নতুন করে কিছু মনে হচ্ছে না। কারণ মনের দিক থেকে আমার কোন পরিবর্তন খুব সম্ভবত নেই। মাথার চুল কিছু হালকা হয়ে গেছে, সামান্য কিছুতে পাকও ধরেছে। এছাড়া আর নতুন কিছু কি হয়েছে? মনে তো হয় না। এখনও সেই ভার্সিটি পড়ার দিনগুলো খুব মনে পড়ে। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনের হিসেব নিকেশের খাতা খুলে বসি। খাতাটা বারবার খুলি আবার উল্টেপাল্টে রেখে দেই কারণ হিসেব তো মেলে না। আর চেষ্টাও করি না। যেমন চলছে চলুক না। আমার খুব ইচ্ছা ছিল আমার বিগত ৪০ বছরের জন্মদিন গুলোর কিছু কিছু লিখবো যতটুকু মনে আছে। সেই প্রয়াসে লিখছি। তাহলে শুরু করি-
৬ জুন ১৯৮২ রবিবার
আমার জন্ম হলো ঢাকায়। মগবাজারে অবস্থিত রাশমনো জেনারেল হসপিটাল এ। সময়টা শুনেছিলাম। এখন আর মনে নেই। হসপিটাল এর দোতালায় ছিল খুব সম্ভত লেবার রুম। সেখানেই জন্ম। বাবা সৌদি প্রবাসী ছিলেন। আমার জন্মের সময় দেশে ছিলেন না। আমার জন্মের পর কেউ আজান ইকামাত দিয়েছিল কিনা শুনিনি। খুব সম্ভবত বড় খালা এবং বড় ফুফু সে সময় উপস্থিত ছিলেন। নানী ছিলেন কি? উনিও তখন মনে হয় হসপিটাল এ ছিলেন। গাইনোকলজিস্ট ছিলেন প্রফেসর সেলিনা জাহান! সম্ভত এটাই নাম উনার। আমার বাবা মায়ের বিয়ে হয়েছিল ১৯৭৯ সালের ২৫ মার্চ। আমার মায়ের বয়স তখন ছিল মোটামুটি ১৪ বছর। এখন শুনলে কেউ আঁতকে উঠতে পারে বাল্য বিবাহ বলে। তখনকার দিনে মনে হয় এটা অনেক স্বাভাবিক কিছু ছিল। আমার জন্মের প্রাক্কালে আমার মায়ের বয়স ১৬ এর মত হয়েছিল। বেশ অল্প বয়সে গর্ভধারণ করেছিলেন বলে আমার মায়ের অতি নিকটজন একজন আমার আগমনের একদম প্রারম্ভ লগ্নেই বাচ্চাকে “অ্যাবোর্ট” তথা গর্ভপাতের কথা বলে ছিলেন। আমার বাবার একরোখা সিদ্ধান্তে সেটা করা হয়নি। এসব কিছুই আমি অনেক বড় হয়ে শুনেছি। বাবাকে ধন্যবাদ এজন্য যে আমাকে অ্যাবোর্ট করানো হয়নি। এখনও বেঁচেবর্তে আছি। কিছু করতে পারছি কি না জানি না, বেঁচে আছি। আবার বাবাকে তিরস্কার! মনে হয় সেদিন ঐ সিদ্ধান্ত নিলেও মন্দ হতো না। হয়তো আমার চেয়ে আরও ভাল সন্তান উনি পরে পেতেও পারতেন। আমিও একরকম মরে বেঁচে যেতাম। জীবনের এতো হিসেব নিকেশ করে কি আর হিসেব মেলানো যায়? জন্মের পরে আমাকে খুলনা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কতদিন পরে সেটা জানি না।
৬ জুন ১৯৮৩ সোমবার
প্রথম জন্মদিন! খুব স্বাভাবিক ভাবে আমার কিছুই মনে নেই। ছবি দেখেছি পারিবারিক অ্যালবাম এ। জন্মদিনটা তখনকার মত ভাল করেই পালিত হয়েছিল। যথারীতি বাবা তখনও প্রবাসে। আমার জন্মদিনের উৎসবটা পারিবারিক ভাবে উদযাপিত হয়েছি আমার বড় খালার শ্যামলী আদাবরের ১০ নাম্বার রোডের বাসায়। বাসা নাম্বার ৭২৪, আর বাড়ির নাম ছিল নীলাঞ্জনা। এখন সেই বাড়ি আর নেই। সেখানে এখন বহুতল ভবন নির্মিত হয়ে গিয়েছে।
আমার সেই জন্মদিনে আমাকে গোলাপী রঙের একসেট গেঞ্জি প্যান্ট পরানো হয়েছিল। আম্মুও দেখেছি গোলাপি রঙের একটা শাড়ি পরেছিলেন। ছবিটা সামনে নেই। কথায় তাও জানি না। থাকলে আরও ভাল করতে বলতে পারতাম। আমি যা বলছি তা সেই দেখা ছবিটা স্মরণ করে বলছি। ওই অনুষ্ঠানের প্রধাণ আকর্ষণ ছিল নব পরিণীতা নমিতা মামি। উনি আমার নমিতা খালা হতেন। আমার মায়েরই আপন মামাতো বোন। আমার ৪র্থ মামা অর্থাৎ রাজা মামার সাথে উনার বিয়ে হয় সেই বছরেই। সেই হিসাবে নমিতা খালা থেকে নমিতা মামী। উনার সাথে আমার এত ভাল সম্পর্ক যে, সমস্ত মামীদের আমি “আপনি” করে বললেও নমিতা মামিকে বরাবর তুমি করেই বলি। আর ছোট বেলার বেশীরভাগ আবদার নমিতা মামির কাছেই হতো। মামী লাল একটা কাতান পরা ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। সেই অনুষ্ঠানে আমার জন্য একটা প্যাস্ট্রি কেক আনা ছিল। কোথা থেকে জানি না। শুনিনি কখনও। সেই সময়ে প্যাস্ট্রি কেক বেশ দুর্লভই ছিল। আর অন্যান্য খাবারের মধ্যে ট্রেডিশনাল মিষ্টি, কলা, চানাচুর খুব সম্ভত এগুলাও ছিল। তখনকার জন্মদিনে এই জাতীয় কিছু খাবার থাকতোই।
৬ জুন ১৯৮৪ বুধবার
আমার ২য় জন্মদিন। এটার কোন স্মৃতি সংরক্ষিত নেই। খুব সম্ভবত খুলনা দৌলতপুরে নানা বাড়ীতেই ছিলাম। নানা বাড়ীতে আমি সবার অনেক আদরের ছিলাম। আমার মামাতো বোনদের একদম চোখের মণি ছিলাম। অনেক অনেক গল্প আছে সেসব নিয়ে। অন্য কোথাও বলবো।
৬ জুন ১৯৮৫ বৃহস্পতিবার
আমার ৩য় জন্মদিন। এটার কোন স্মৃতি সংরক্ষিত নেই। খুব সম্ভবত খুলনা দৌলতপুরে নানা বাড়ীতেই ছিলাম।
৬ জুন ১৯৮৬ শুক্রবার
আমার ৪র্থ জন্মদিন। এটার কোন স্মৃতি সংরক্ষিত নেই। খুব সম্ভবত খুলনা দৌলতপুরে নানা বাড়ীতেই ছিলাম। এই বছরের কোন এক সময়ে ঢাকা চলে আসি। এই বছরই ঢাকায় মিরপুর ১০ নাম্বার সেনপাড়া পর্বতায় আমাদের একটা জমি কেনা হয় এবং একটা টিনশেডের বাড়ি তোলা হয়। সেই টিনশেডের বাড়িটা ১৯৯৯ সালের আমার মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত ছিল। এরপর সেটা ভেঙ্গে সেখানে বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট করা হয়।
৬ জুন ১৯৮৭ শনিবার
আমার ৫ম জন্মদিন। এটারও কোন স্মৃতি আমার নেই। তখন আমি স্কুলে ভর্তি হয়েছি। প্লে গ্রুপে পড়তাম। স্কুলের নাম ছিল সিটি কিন্ডারগার্টেন। সেনপাড়াতেই ছিল। এখন স্কুলটা আর নেই। অনেক আগে থেকেই নেই।
৬ জুন ১৯৮৮ সোমবার
আমার ৬ষ্ঠ জন্মদিন। এটি বেশ ঘটা করেই পালিত হয়েছিল সৌদি আরবের আর-আর নামক শহরে। ঐ বছর জানুয়ারীতে সৌদি গিয়েছিলাম। পারিবারিক অ্যালবামে আমার এই জন্মদিনের বেশ কিছু ছবি আছে। আমার মাথা টাক করা ছিল কিছুদিন আগেই। মাথায় তখন খোঁচা খোঁচা চুল! আমি বেশ মোটাসোটা ছিলাম। একেবারে গোলগাল যাকে বলে। সৌদি আরবে গিয়ে আরও মোটা হয়েছিলাম! আমি লাল একটা গেঞ্জি আর সেটারই সেট এর লাল হাফ প্যান্ট পরেছিলাম। পুরা ড্রেস আমার শরীরে আঁটসাঁট হয়ে বসেছিল। আমার প্রিয় একটা বন্দুক ছিল। সেটা নিয়ে খেলছিলাম আর সেটার সাথে পোজ দেয়া ছবিও আছে। আম্মু বাসায় নিজে একটা কেক বানিয়েছিলেন। আর বাসায় অনেক মুরগি পোড়া বা গ্রিল-চিকেন করা হয়েছিল। ড্রিঙ্কস, সালাদ, আরবী রুটি এসব ছিল। সবার একসাথে বসে খাওয়ার ছবিও আছে। পোলো ক্যান্ডির মত মাঝখানে ছিদ্র করা কেক! আর সেই পার্টি বাসায় হয়েছিল। আমার বড় চাচাও তখন সৌদিতে একই বাসায় থাকতেন। ঐ বাসায় আরও কিছু লোক ছিল। তাদের মধ্যে একজন দানব ছিল হাফিজ নাম এর। যেই দানবের কাছে আমি যৌন নিপীড়নের শিকার ছিলাম। সেই দানবের ছবিও আছে আমার সেই জন্মদিনে।
৬ জুন ১৯৮৯ মঙ্গলবার
আমার ৭ম জন্মদিন। এটাও সৌদি আরবের আর-আর এই হয়েছিল। তবে এবার আমার বড় খালার বাসাতে। আমাদের সোদির বাসা থেকে বড় খালার বাসা একই গলির এমাথা ওমাথা ছিল। এই জন্মদিনের ছবিও আছে। তখন আমার সামনের পাটির উপরের দুটো দাঁত পড়ে গেছে। ফোকলা দাঁত নিয়ে কেক নিয়ে হাসছি সেই ছবিও আছে। এবার কেক বানিয়েছিলেন আমার বড় খালু। পুরা কেকের গায়ে চকলেট ক্রিম উনি মাখিয়ে সুন্দর করে ডেকোরেট করেছিলেন। আমি হালকা সবুজ রঙ এর একটা গেঞ্জি পরা ছিলাম। নতুন সংযোজন হিসেবে পরিবারে একজন নতুন মানুষ এসেছিল। আমার আম্মুর কোলে তখন তার দ্বিতীয় ছেলে, যার জন্ম ঐ বছরই ফেব্রুয়ারীতে ছিল। তখন আমার বেশীর ভাগ সময় কাটতো বড় খাবার বাসাতেই। ওখানে থাকতেই বেশী পছন্দ করতাম। কারণ আমার খালাতো ভাই শুভ্র আমার একই বয়সী ছিল। আমার থেকে মাত্র দুই মাসের ছোট ও। আর খালাতো বোন নিশা আপু আমার থেকে ৪ বছরের বড় ছিল। ওদের সাথেই সারাদিন খেলাধুলা, ঝগড়া, আড়ি, রাগ, ভাব এসব চলতো! একটু একটু পরপর চকলেট খেতাম আর সানটপ নামের একটা জুস খেতাম!
৬ জুন ১৯৯০ বুধবার
৮ম জন্মদিন। ঢাকায়। তখনও বড় খালার বাসায় থাকি। এই জন্মদিনে কিছু করা হয়নি। তখনও বাবা সৌদি থেকে আসেন নি। আমরা আগের বছর নভেম্বর মাসে সৌদি থেকে চলে আসি। আমি তখন ক্লাস টু তে পড়ি। শ্যামলীতে বড় খালার বাসাতেই থাকতাম। ছোট খালা খালুর সাথে আমি আম্মু আর ছোট ভাই সাদ। দুঃখের বিষয় দেশে এসেও মুক্তি পেলাম না। এখানেও যৌন নিপীড়নের শিকার হলাম। এবার দানবটা হলো ছোট খালার ভাসুরের ছেলে “বশির”। এই জন্মদিন পালিত হয়নি যতদূর মনে পড়ে। আমার কোন ভাল স্মৃতি নেই। তবে ওই দানব আমার সাথে কি কি করেছিল, সেগুলা সবই মনে আছে। আমি প্রতিদিন আম্মুর সাথে শ্যামলী থেকে বাসে করে মিরপুর ৭ নাম্বারে স্কুলে আসতাম। এখন সেটা মিল্ক ভিটা বিন্ডিং। আমার তৎকালীন স্কুলের নাম ছিল প্রি-ক্যাডেট চাইল্ড কেয়ার হোমস।
৬ জুন ১৯৯১ বৃহস্পতিবার
৯ম জন্মদিন! এবার সেনপাড়ায় আমরা। তখন ক্লাস থ্রি তে পড়ি। বড় খালার বাসা থেকে চলে আসি আর আব্বু তার ভকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার “ইন্সটিটিউট অব টেকনোলোজি” শুরু করেন মিরপুর ১০ গোলচক্করের দেওয়ান ম্যানশনের ৩য় তলায়। তখন আমার বোন আমার মায়ের পেটে। প্রায় শেষের দিকে। আমার এই জন্মদিন পালিত হয়নি এবং আমার কিছু মনে নেই। আম্মুকে নিয়ে মাঝে মাঝে টেম্পুতে করে ফার্মগেটের আল-রাজী হসপিটালে যেতাম। আম্মু চেকাপ করাতেন। আবারও গাইনি স্পেশালিস্ট ডাঃ সেলিনা জাহান। যার তত্ত্বাবধানে আমার জন্ম ছিল।
৬ জুন ১৯৯২ শনিবার
১০ম জন্মদিন। সেনপাড়াতেই। ক্লাস ফোরে পড়ি। পালিত হয়েছিল বলে কিছু মনে পড়ে না। তবে এইবার আমার ছোট বোনের প্রথম জন্মদিন আগস্ট মাসে বেশ ঘটা করে পালিত হয়েছিল। আমার এই জন্মদিনের কোন স্মৃতি আমার নেই। তখন নিজে থেকে এত কিছু মনেও পড়তো না।
৬ জুন ১৯৯৩ রবিবার
১১তম জন্মদিন। সেনপাড়াতেই। ক্লাস ফাইভে পড়ি। তখনও প্রি-ক্যাডেট স্কুলেই পড়ছি। আমাকে বৃত্তি পরীক্ষা দেয়াতে হবে সেজন্য সারা বছই বেশ তোড়জোড় হয়েছে। আমি স্কুল ভ্যানে করে স্কুলে যেতাম। তখন স্কুল চলে এসেছে মিরপুর ১১ নাম্বার এ। স্কুলের ক্লাস শেষ হবার পরে শুরু হতো বৃত্তি পরীক্ষার কোচিং। বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। আমার এই জন্মদিনের কোন স্মৃতি নেই। তখন ওই বছরই আমার মাড়ির দাঁত পরা শুরু হয়েছে। আমি একটা রেকর্ড করেছিলাম ২৭ এপ্রিল। একই দিনে আমি ৪টা মাড়ির দাঁত নিজে নিজেই ফেলে দিয়েছিলাম। সাহস বেড়ে গিয়েছিল। দুইটা বাসায় আর দুইটা স্কুলে ফেলেছিলাম। একই সাথে চারটা মাড়ির দাঁত ফেলে দেয়ায় বেশ যন্ত্রণার মধ্যে পড়েছিলাম। দাঁত মাজতে কষ্ট হচ্ছিলো। তবুও মনে মনে বীরত্বের সুখ নিয়েছি। নিজের চারটা মাড়ির দাঁত একই দিনে নিজেই ফেলেছি! আজও সেই তারিখ মনে আছে। তবে হ্যাঁ, জন্মদিনের কোন স্মৃতি নেই। পালিত হয়নি। এই বছর থেকেই প্রথম চশমা পরা শুরু করি। আমার প্রথম পাওয়ার ছিল +০.৭৫ দুই চোখেই। এরপর থেকে এখনও চশমা পরে যাচ্ছি। আমার প্রথম চশমার ছবি আছে অ্যালবাম এ।
৬ জুন ১৯৯৪ সোমবার
১২ তম জন্মদিন। স্কুল পরিবর্তন করে গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়েছি। আর কোন স্মৃতি নেই এই জন্মদিনের। কিছু মনে পড়ে না। বাসা থেকে অনেক দূরে স্কুল ছিল। বাস এ যাতায়াত করতাম। আমার এই জন্মদিন পালিত হয়নি। কিছু মনে পড়ে না।
৬ জুন ১৯৯৫ মঙ্গলবার
১৩ তম জন্মদিন। ক্লাস সেভেনে পড়ি। সারা মুখ ভর্তি ব্রণ! আমার মুখের মনে হয় কোথাও বাদ ছিল না ব্রণ উঠতে। আমার এই জন্মদিনের কোন স্মৃতি নেই। কিছু মনে পড়ে না।
৬ জুন ১৯৯৬ বৃহস্পতিবার
১৪ তম জন্মদিন। ক্লাস এইটে পড়ি। আবার সেই বৃত্তি পরীক্ষার চাপে পড়লাম। এটিও পালিত হয়নি। আমার জন্মদিনের কোন স্মৃতি নেই। ততদিনে মনে হয় সব দাঁত পরা হয়ে গেছে। হাই স্কুলে উঠে দাঁত পড়েনি বলেই মনে পড়ছে।
৬ জুন ১৯৯৭ শুক্রবার
১৫ তম জন্মদিন। এই সালের জন্মদিন আমার জন্ম অনেক স্মৃতিময়। ক্লাস নাইনে পড়ি। সায়েন্স নিয়েছি! ভাবই আলাদা। তখন আমাদের বাসার অন্য অংশে থাকতেন নঈম আঙ্কেলের ফ্যামিলি। উনি আমার বাবার আপন খালাতো ভাই। আঙ্কেল আর বেঁচে নেই। উনার ছেলে মুমিত আমার থেকে চার মাসের বড় এবং আমার ব্যাচমেট। আমরা একই কোচিং এ পড়তাম। কি কারণে যেন মুমিতের সাথে আমার মন কষাকষি চলছিল। কথা বলতাম না। কিন্তু ওইদিন দুপুরে মুমিত এসে আমার হাতে একটা গিফট ধরিয়ে দিয়েই চলে যায়। আমি বললাম, কি এটা? ও হেসে বললো, খুলেই দেখো। সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দা এর বই ছিল। আমার সব রাগ ভাবে পরিণত হয়ে গেল। তখন ছোট দাদা (বাবার ছোট মামা) এর মেয়ে তানিয়া আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিল। তানিয়া আমার চার মাসের ছোট। আমরা ব্যাচমেট। সম্পর্কে আমার ফুফু হলেও আমার সাথে তুই তোকারি সম্পর্ক বন্ধুর মতই। তবে তানিয়া আমাকে আব্বা বলে ডাকে। আর তখন বলতো, আমার মেয়ে হলে তার সাথে তোকে বিয়ে দেব। এখন তানিয়া যমজ কন্যার মা! এখন তো আর বিয়ের কথা বলে না!!! তানিয়াও আমাকে তিন গোয়েন্দা এর একটা ভলিউম উপহার দিলো। ভলিউম-১৬ ছিল সেটা। আমার আনন্দ দেখে কে! আমি তখন তিন গোয়েন্দার পোকা।
রাতে রান্না বান্না হয়েছিল। বড় খালা এসেছিলেন। নিশা আপু এসেছিল বাসায় গিফট নিয়ে আমার জন্য। ও তার আগেই বছরই বুয়েট এ পড়া শুরু করেছে। আমার বুয়েট এ পড়ার অনুপ্রেরণা মুলত আমার এই আর্কিটেক্ট খালাতো বোনকে দেখেই। ওকে দেখে দেখে মনে মনে ভাবতাম, মরি বাঁচি বুয়েটে পরা লাগবেই। যাই হোক নিশা আপু আমাকে আনন্দ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা “প্রথম আলো” বইটার প্রথম পার্ট উপহার দিয়েছিল। বইয়ের প্রথম পাতায় নীল কালিতে সংক্ষেপে এই কথা লেখা ছিল-
“শাওনকে
তোমার জন্মদিনে
নিশা আপু
৬.৬.৯৭”
রাতে সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া করেছিলাম। একই দিনে তিনটা বই উপহার পাওয়া আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার ছিল।
৬ জুন ১৯৯৮ শনিবার
১৬তম জন্মদিন। তেমন কিছু মনে পড়ে না। কয়েক মাস পরেই মাধ্যমিক পরীক্ষা। কোচিং, টিচার এসবের মধ্যে ছিলাম। স্মৃতিতে আর তেমন কিছু ধরা দেয় না।
৬ জুন ১৯৯৯ রবিবার
১৭তম জন্মদিন। এবার বড় খালার বাসায়। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ। তখন ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলছে। আর কয়েকদিন পরে মাধ্যমিকের রেজাল্ট দিবে। সেটা নিয়ে খুব একটা টেনশন নেই। বড় খালার বাসায় সবাই মজা করছি এটাই বড় কথা। আগের দিন বড় খালা জানতে চাইলেন, জন্মদিনে কি খাবা? আমি ফর্দ দিয়ে দিলাম, চাইনিজ ভেজিটেবলের তো খাবই, ওটার সাথে আর যা যা লাগে! খালা মুচকি বেসে বললেন, বুঝসি! এরপর সেদিন ফ্রায়েড রাইস, চিকেন ফ্রাই, চাইনিজ ভেজিটেবল অনেক কিছুই খাওয়া হল। তখন আমার নানী আর মেঝো মামাও ওই বাসায় ছিলেন। বেশ মজাই হয়েছিল। ১৯৮৮ সালের পরে এই আবার বড় খালার বাসায় আমার জন্মদিন পালিত হলো।
৬ জুন ২০০০ মঙ্গলবার
১৮ তম জন্মদিন। তখন আমাদের টিন শেডের বাসা ভেঙ্গে অ্যাপার্টমেন্ট বানানোর কাজ চলছে। কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়েছি। নটরডেম কলেজ বলে কথা। সময় কিভাবে পার হয়ে গিয়েছে আমি জানি না। আমরা তখন ৮/১৮ নাম্বারে আব্দুল হান্নান আঙ্কেলদের বাসায় ভাড়া থাকতাম। বাসার নাম “মাতৃছায়া”। এই বাসার চার তলায় খোদ আব্দুল হান্নান আঙ্কেলদের বাসের ফ্ল্যাটেই আমরা থাকতাম। রাতের বেলা নিশা আপু এসেছিল আমার জন্য গিফট নিয়ে। আমি তখন লতা মঙ্গেশকরের মারাত্মক ভক্ত হয়ে উঠেছি। তখনও ক্যাসেটের যুগ চলে। আমার ক্যাসেট প্লেয়ারটা নিশা আপুরই দেয়া ছিল। আমার জন্য ও “ম্যায়নে পেয়ার কিয়া” ছবি ক্যাসেট নিয়ে আসলো। যে মুভিতে লতা মঙ্গেশকরের অনেকগুলো গান আছে। আমার খুশি আর দেখে কে! তবে ক্যাসেটের প্রচ্ছদে রানী মুখার্জীর ছবি দেখে হতাস হলাম কিছুটা! ম্যায়নে পেয়ার কিয়া এর নায়িনা হল ভাগ্যশ্রী! সেখানে রানী মুখার্জি কেন থাকবে? যাই হোক, শুনতে গিয়ে হতাশ হলাম না। ছবির গান ঠিকই ছিল। কতবার যে শুনেছিলেন সেই ক্যাসেট বলে শেষ করা যাবে না। আর নিশা আপু আমার জন্য একটা সুন্দর গ্লাস ক্যান্ডেল শো-পিস নিয়ে এসেছিল। ছোট একটা কাঁচের ক্লাসে মোমবাতি! উপিরে ছোট একটা মোমের হার্ট!
৬ জুন ২০০১ বুধবার
১৯তম জন্মদিন। সব আনন্দ ধুলিস্মাৎ হয়ে গেল। কারণ তখন আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছিল। দম ফেলানোর সুযোগ নেই তার আবার জন্মদিন! কিভাবে কি হয়েছিল কিছু মনে নেই আমার।
৬ জুন ২০০২ বৃহস্পতিবার
২০তম জন্মদিন! স্বপ্নের ভার্সিটি বুয়েটে ভর্তি হবার পরে প্রথম জন্মদিন! তবে ওই সময় বুয়েট বন্ধ ছিল এইটুকু মনে আছে। আর জন্মদিন পালিত হয়েছিল কিনা মনে নেই! তখন আমার কয়েকটা পেন ফ্রেন্ড ছিল। ওদের কাছে নিয়মিত চিঠি পত্র লিখতাম। তবে সেটাই শেষ। এরপরে আর চিঠি পত্র লেখা লিখি হয়নি। ওই বছর জন্মদিনের কথা তেমন কিছু মনে পড়ে না।
৬ জুন ২০০৩ শুক্রবার
২১তম জন্মদিন। অনেক স্মৃতিময়। অনেক কিছুই মনে পড়ে এই জন্মদিনের কথা। একদম সবকিছু! অনেক মজা করেছিলাম এইদিনে আমরা। অনেক ছবিও তোলা আছে। আর সেগুলা ফেসবুকেও আছে। অনেক জমকালো ভাবে পালন করা হয়ছিল। আমার বাবা তখন বড় ফুফুকে নিয়ে ইন্ডিয়া গিয়েছিলেন। আমার ইচ্ছা ছিলো আমার ভার্সিটির কিছু ফ্রেন্ড কে বাসায় দাওয়াত করবো। তাই বাবাও আম্মুকে বলে দিয়েছিল সাধ্যমত আয়োজন করতে। আমি তখন বুয়েটে সদ্য ২য় বর্ষের টার্ম ওয়ানে উঠেছি। সেদিন বাসায় দোয়াত দাওয়াত দিয়েছিলাম বন্ধু আরিফ (০১০২০২৫), আরিফ (০১০২০০৮), রাফিয়া (০১০২০২২), ফয়সাল (০১০২০৫৭), রাশেদ (০১০২০২৮) এবং প্রতিবেশী ছোট ভাই দিপু (মেকানিক্যাল ২০০২) কে। ওইদিন রাফিয়াকে আমাদের বাসায় ওর বাবা দিয়ে গেল। ওটাই আঙ্কেলের প্রথম এবং শেষবার আমাদের বাসায় আসা। আঙ্কেল এর পরের বছর মে মাসে মারা যান। আঙ্কেল রাফিয়া কে দিয়ে চলে গেলেন। আরিফের সাথে তখন রাফিয়ার তুমুল লেভেল এর প্রেম চলছে। আমরা ওদের কে যত রকম জ্বালানো যায়, জ্বালাই। আরিফ কিছুই বলে না মুচকি মুচকি হাসা ছাড়া। আমাদের এই ব্যাপার এখনও রয়ে গেছে।
বন্ধু আরিফ (রোল 8) একটা ডিজিটাল ক্যামেরা কিনেছিল আগের টার্ম এ। সেটা দিয়ে একের পর এক ছবি তোলা হতো। আমাদের সেনপাড়ার ৫ তালার সেই ফ্ল্যাট বাড়িতে সেদিন কি পরিমান যে আনন্দ করেছিলাম বন্ধু বান্ধব মিলে সেটা বলে বোঝানো যাবে না। আম্মুকে বলেছিলাম যে, খাবারে যন শর্ট না পড়ে। আম্মু বিশাল দুই হাড়ি পোলাও মাংশ রান্না করে ফেললেন। এতো খাবার রান্না হয়েছিল যে সমস্ত মানুষ দ্বিগুন করে ফেললেও খাবার শেষ হতো না। সেদিন আমি ফুল কালো রঙ এর একটা টি-শার্ট পরেছিলাম আর ডেনিম এর একটা থ্রি কোয়ার্টার সম্ভবত। নিশা আপু আর মামাতো বোন পর্ণাও এসেছিল। ফয়সালের সাথে জড়িয়ে শুধু শুধু পর্ণাকে উলটাপালটা কথা বলে জ্বালাতাম। সেদিনও সেই কাজ অব্যহত ছিল।
তখন আমাদের একটা পোষা বানর ছিল। ওর নাম ছিল মধু। এক পর্যায়ে সেই মধুকে নিয়ে এলো সাদ। মধুকে সাথে নিয়েও কিছু ছবি তোলা হলো। সেদিনও আমি নানা রকম গিফট পেয়েছিলাম। রাফিয়া আরিফ দিয়েছিল ছবির ফ্রেম, রাশেদ দিয়েছিল এক সেট নানা রঙ এর কলম। নিশা আপুও শো পিস নিয়ে এসেছিল। সবগুলো এখন মনে পড়ছে না। অদ্ভুত গিফট নিয়ে বিকালে খালাতো ভাই শুভ্র এলো। ও আমার জন্য ডায়াপার আর একটা ফিডার নিয়ে এলো! কি একটা অদ্ভুত অবস্থা! বন্ধুরা আমাকে বললো, আমাকে সেই ডায়াপার পরতে হবে! বাচ্চাদের ডায়াপার আমি অরি কি করে? সাইজে মিললে কথা ছিল! সারাদিন হই হল্লা করে আর আনন্দে কিভাবে যে কেটে গেল টার পাইনি। এখনও মনের মাঝে ভাসে সেই জন্মদিনের কথা। সেসব দিন কি আর আসবে? এখনও মনে হয় আমি সেই ২১ বছর বয়সেই আটকে আছি। বাকী জীবনটাও এমনই থাকতে চাই।
৬ জুন ২০০৪ রবিবার
২২তম জন্মদিন। তখনও মনে হয় কোন কারণে ভার্সিটি বন্ধ ছিল। কারণটা মনে পড়ছে না। তখন লেভেল-২, টার্ম-২ তে পড়তাম। এই জন্মদিনের তেমন কোন স্মৃতি মনে পড়ছে না। তেমন কিছু মনে হয় করা হয়নি। সেবার বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। আর বন্যার কারণে আমাদের দফায় দফায় পরীক্ষা পিছিয়ে গিয়েছিল। সেই পরীক্ষা হয়েছিল সেপ্টেম্বর মাসে।
৬ জুন ২০০৫ সোমবার
২৩তম জন্মদিন। অনেক বাজে ভাবে কেটেছে। তখন ভার্সিটির লেভেল ৩, টার্ম ১ এ সদ্য রেজাল্ট দিয়েছে। রেজাল্ট ভাল ছিল সেজন্য মন ভালও ছিল। কিন্তু পরের টার্ম এর প্রেসারে অনেক চিন্তায় ছিলাম। আর সেবার বাবার নিউরোলজিকাল কিছু সমস্যা দেখা দেয়। সেটা নিয়ে আমরা মারাত্মক দুশ্চিন্তায় ছিলাম। সেটার সুত্র ধরেই উনার জীবনাশঙ্কাও দেখা দিয়েছি। পরে জুলাই মাসে উনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। সেবারও তানিয়া আমাদের বাসায় ছিল। উল্লেখযোগ্য কিছু করা হয়নি সেই জন্মদিনে।
৬ জুন ২০০৬ মঙ্গলবার
২৪তম জন্মদিন। তখন ভার্সিটি ৪র্থ বর্ষের প্রথম সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষার আগের ঘটনা। মাঝে মাঝে হলে গিয়ে পড়ি। কখনও কখনও সুমনের বাসায় গিয়ে গ্রুপ স্টাডি দেই। এর আগের সেমিস্টারেই রাশেদের সাথে বন্ধুত্বের ইতি টেনে দিয়েছিলাম। এর আগে প্রতিবার রাশেদের সাথে গ্রুপ স্টাডি করলেও, ৪র্থ বর্ষে গিয়ে আর করলাম না। সেবার একবার পড়ার ফাঁকে সুমন বলেছিল, কি রে জায়েদ, এবার ডি-ডে তে কি করবি? আমি বললাম ডি-ডে কি জিনিস? ও বললো, তোর জন্মদিন ৬ তারিখে না, ওইদিন হলো ডি-ডে। তুই সার্চ দিয়ে দেখিস। সেদিন বুঝেছিলাম ৬ জুন তারিখটাকে ডি-ডে বলে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
৬ জুন ২০০৭ বুধবার
২৫তম জন্মদিন। বুয়েটের শেষ ফাইনাল পরীক্ষাও দেয়া হয়ে গিয়েছে। এখন রেজাল্টের অপেক্ষায়। আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল বুয়েটের পাট চুকিয়ে তিন-চিল্লা এর জন্য তাবলীগে বের হবো। সেই মানসেই আমার জন্মদিনের দিনই ফজরের নামাজের পরে বেরিয়ে পড়লাম। এটাও একটা স্মৃতিময় ঘটনা। সকাল বেলা ডঃ রেজাউল করিম আঙ্কেলের সাথে বের হবো। উনি আমাকে নিয়ে কাকরাইল মাসজিদে গিয়ে জামাতবন্দী করে দিবেন। আমি অপেক্ষা করছি। এমন সময় আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামলো। মনে আছে সেদিন এত বৃষ্টি হয়েছিল যে মতিঝিল এবং সেই সংলগ্ন এলাকা একদম পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। সেবার জুন মাসে অনেক বৃষ্টি হয়েছিল। রেজাউল করিম আঙ্কেলের সাথে উনার অফিসের গাড়িতে করে কাকরাইল মাসজিদে নিয়ে আমাকে জামাত বন্দী করে দিলেন। জামাদের আমির সাহেব ছিলেন ডঃ আব্দুল হাদী সাহেব। আমি জামাত বন্দী হলাম। রাতে জামাত সহ কাকরাইল মাসজিদ থেকে বেরিয়ে আরামবাগে একটা মাসজিদে অপেক্ষা করছিলাম। তখন সমস্ত রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। এর আগে আমির সাহেব আমাকে আর একজনকে এস্তেমায়ী সামানা (হাড়ি পাতিল চুলা) এগুলা ভাড়া আনতে পাঠিয়েছিলেন। আমরা নিয়ে এসেছিলাম। এরপর সেই রাতে পানি ভেঙ্গে আমরা বাসে উঠে সুনামগঞ্জের দিকে যাত্রা করি। আমার জীবনের সেই চিল্লার প্রথম ভাব পড়েছিল সিলেটের সুনামগঞ্জে। সেই অঞ্চলেও প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল সেবার।
৬ জুন ২০০৮ শুক্রবার
২৬তম জন্মদিন। আমার প্রবাস জীবন তথা সিঙ্গাপুর জীবনের প্রথম জন্মদিন। ভীষণ মানসিক কষ্টে কেটেছিল। জন্মদিন করার কোন মন মানসিকতা ছিল না। মাত্র কয়েকদিন আগেই সেমিস্টার মডিউলের রেজাল্ট দিয়েছিল এবং সেটায় রেজাল্ট হয়েছিল অনেক খারাপ। সেই মডিউলে খারাপ করে আমার ধারণা হয়েছিল আমার দ্বারা আর ডক্টরেট করা হবে না। ডক্টরেট ছেড়ে দিয়ে দেশে চলে আসবো না মাস্টার্স করবো এমন অনেক কিছু সাতপাঁচ ভেবে ভেবে দারুণ মনের কষ্টে দিন কাটছিল। আমার সেই সময়ের কষ্টের কথা কাউকে বলে বোঝাতে পারবো না। যা হোক, তখন বুন-লে হোস্টেলের ৩য় তলায় থাকতাম। বন্ধু সুদীপা (০১০২০৪৭) আমার সাথেই ডক্টরেট করছিল। ও থাকতো অন্য তালায়। সুদীপা ঠিকই মনে রেখেছিলো এবং সেই রাতে আমার জন্য একটা “পানদান শিফন কেক” আর আমার প্রিয় “A&W ব্র্যান্ডের রুট বিয়ার” ড্রিঙ্ক নিয়ে এসেছিল। আমি তখন হাবিব ভাই, শাকিল আর মুজাহিদের সাথে একই ফ্ল্যাটে থাকতাম। মন খারাপের মধ্যেও বন্ধু সুদীপা এগুলো করেছিল আমার মন ভাল করতে। সুদীপার সেই বদান্যতা আমি কখনই ভুলবো না। সেই কেক কেটে খাওয়া হলো। এরপর সুদীপা চলে যায় ওর নিজের রুমে। এর কিছুদিন পরেই আমরা দুইজনই বাংলাদেশে প্রথমবার বেড়াতে আসি।
৬ জুন ২০০৯ শনিবার
২৭তম জন্মদিন এবং আমার অবিবাহিত অবস্থার শেষ স্মৃতিময় জন্মদিন। সিঙ্গাপুর থেকে দ্বিতীয়বারের মত দেশে এসেছিলাম। আমার জন্য কয়েকটা সুখবর ছিল। দেশে আসার পরে জানতে পারি আমার রেজাল্ট ভাল হয়েছে এবং আমার ডক্টরেট আমি ঠিকমতোই চালিয়ে যেতে পারবো। এরপর এলো আমার জন্মদিন। আমার এই জন্মদিনে আমার তিন বন্ধুকে দাওয়াত দিলাম। দুই আরিফ আর রাফিয়া কে। আরিফ আর রাফিয়া এর আগের বছর বিয়ে হয়ে গেছে এবং রাফিয়া সেই সময়ে একদম শেষ পর্যায়ের প্রেগন্যান্ট। ওর পেটে তখন ওর মেয়ে ফারিহা। আমি ফোনে রিকোয়েস্ট করলাম, রাফিয়া আসতে পারবি? আমি গাড়ি করে তোকে নিয়ে আসবো। ওরা তখন মোহাম্মদপুরে থাকতো। তখন আমাদের একটা গাড়ি ছিল। পরে রাফিয়া রাজি হলো। আমি ওকে আর আরিফকে নিয়ে আসলাম। আর আমার বুয়েটের থিসিস পার্টনার আরেক আরিফও এসেছিল অফিস থেকে। ওরা তখন চাকুরী করছে। আমি মাত্র এক মাসের ছুটিতে এসেছি। এর মধ্যেই গোপনে গোপনে আমার বিয়ের প্ল্যান প্রোগাম চলছে। সেবারও আমরা চার বন্ধু অনেক হাসি ঠাট্টা করে দিন কাটিয়েছিলাম। বাসায় বেশ জম্পেস খাওয়া দাওয়া হয়েছিল। এই মাসের ২৯ তারিখে রাফিয়ার মেয়ের জন্ম হয় আর তার পরের দিনই আমার বিয়ে হয়ে গেল।
৬ জুন ২০১০ রবিবার
২৮তম জন্মদিন, সিঙ্গাপুরে! সেদিন রবিবার বিধায় ছুটি ছিল। মাত্র দেশ থেকে বিয়ের অনুষ্ঠান সেরে আবার সিঙ্গাপুরে ফিরে গেছি! নাঈমার আসার কথা কিন্তু সেটাও আরও কিছুদিন পরে। তখন ফেসবুকের যুগ শুরু হয়ে গেছে। আমার ওয়ালে শুভেচ্ছার পর শুভেচ্ছার বন্যা বয়ে যাচ্ছে। একা একা কি আর করবো, তাই ভার্সিটি চলে এলাম। কম্পিউটার ছিল। নাটক সিনেমা দেখতাম! সেদিন তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুই হয়নি। দেশে থেকে আনা একটা ডায়রী এনেছিলাম। ভাবলাম ডায়রী লিখি। সেটাও কয়েকদিন লেখার পরে আর কন্টিনিউ করিনি। এমন অনেকবারই হয়েছে। মোবাইলেওওনেক মেসেজ আসছিলো শুভেচ্ছা জানিয়ে। আমার মনে আছে সেবার আমি মেসেজে প্রথম শুভেচ্ছা পেয়েছিলাম বন্ধু সীমা (০১০২০৫৮) এর কাছ থেকে।
৬ জুন ২০১১ সোমবার
২৯তম জন্মদিন। সিঙ্গাপুরেই। নাঈমা ছিল সেবার আমার সাথে। আমরা থাকতাম তেবান গার্ডেন্স এ, মাহবুব ভাই দের বাসায়। সময় ভালই কাটছিলো। কি কি করেছিলাম মনে নেই, তবে ভার্সিটি থেকে আসার পরে নাঈমা কে নিয়ে মনে হয় কোন শপিং মল এ ঘুরতে গিয়েছিলাম। সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন নানা রকম শপিং মলে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতাম। বেশ ভাল লাগলো। কোন দোকানে কি অফার আছে সেগুলো খুঁজে বের করতাম। এতে সময় বেশ কেটে যেত।
৬ জুন ২০১২ বুধবার
৩০তম জন্মদিন। ডক্টরেট শেষ বর্ষে। অতিরিক্ত সময় লাগায় তখন আর স্কলারশিপ পাচ্ছিলাম না। জমানো টাকায় হিসেব করে করে দিন কাটাতে হচ্ছিলো। আমি আমার সুপারভাইজরের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে দুই মাসের জন্য দেশে এসেছিলাম। তখন আমার সময় একদম ভাল যাচ্ছিলো না। দেশে একটু স্বস্তি পাচ্ছিলাম। সেদিন ঠিক কি করেছিলাম আমার তেমন কিছু মনে পড়ছে না। দেশে বাসায় ছিলাম থেকে থিসিস লেখার দুশ্চিন্তা থেকে কিছুটা নিজেকে দূরে রাখতে পেরেছিলাম। নাঈমা আমাকে আড়ং থেকে একটা লেদার এর ওয়ালেট উপহার দিয়েছি। সেটা আমি বহু বছর ব্যবহার করেছি।
৬ জুন ২০১৩ বৃহস্পতিবার
৩১তম অন্মদিন। দেশে চলে এসছি তখন। থিসিস জমা দিয়ে। এদিকে ইমেইলে ঘোষণা পেয়েছি জুলাই মাসে সিঙ্গাপুরে গিয়ে আমাকে ডক্টরাল থিসিসের ওরাল ডিফেন্সের জন্য যেতে হবে। সেগুলোর যোগাড়যন্ত্র চলছে। এর মধ্যে চলছে আমার বেকার জীবন! আহা কি সময় গেছে সেই সময়। আপনজনের চেহারা, এমনকি বানা মায়ের চেহারাও যে বেকারত্বের সময়ে পালটে যায় সেটা সেবার হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। তখন আমি মিরপুর ১০নাম্বারে এইম কোচিং সেন্টারে ফিজিক্স পড়াতাম আর চাকরী খুঁজতাম। আমার সেই প্রথম জীবনে আমি এমন কিছু ছাত্র পেয়েছিলাম যাদের সাথে আমার এখনও সুসম্পর্ক বজায় আছে। সেবারের জন্মদিনের কথা আর বিশেষ করে কিছু মনে পড়ে না।
৬ জুন ২০১৪ শুক্রবার
৩২তম জন্মদিন। প্রথমবার বাবা হবার পরে প্রথম জন্মদিন। মেয়ে জুওয়াইরিয়া এর বয়স তখন মাত্র এক মাস। তখনও পুরো দমে চলছে বেকারত্ব। কোন চাকরী বাকরীর সন্ধান নেই। জীবনে ভাল হতাশা চেয়ে যাচ্ছিলো। কয়েক জায়গা থেকে চাকরীর ইন্তারভিউ থেকে রিজেক্ট হয়েছি ওভার কোয়ালিফায়েড বলে। ফ্যামিলি থেকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলাম। সেবারের জন্মদিনের কথা কিছু মনে নেই। শেফা শুভেচ্ছা জানাতো। একটি ঘটনা স্মরণীয় হয়ে আছে। আমার অনেক মন খারাপ ছিল দেখে বিকালে নাঈমা বলেছিল, চল আমরা একটু বের হই। আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম কই বের হবো? মেয়ে উঠে যাবে। ওকে খাওয়াতে হবে। নাঈমা বললো চল বের হই। যাবো আর চলে আসবো। মেয়ে তখন ঘুমে। ওকে আম্মুর কাছে রেখে আমি আর নাঈমা বের হলাম। আমাদের স্বামী স্ত্রীর একটু একান্তে ঘোরা আলাপ করা আর কি! নাঈমা আমাকে নিয়ে মিরপুর ১৩ নাম্বার এর yummy তে নিয়ে গেল। আমরা দুজন কিছুক্ষণ বসে একটু চিকেন ফ্রাই খেলাম। আর নাঈমা আকে এক সেট গ্লিটার কলম উপহার দিয়েছিল। দিয়ে বললো, এটা নাও। এটা দিয়ে কবিতা লিখো। আমার মনের অবস্থা তখন বলে বঝাতে পারবো না। আমাদের দ্রুত চলে আসতে হয়েছিল মেয়ের কথা চিন্তা করে। এভাবেই আমরা একান্তে চুপি চুপি আমার জন্মদিন পালন করেছিলাম।
৬ জুন ২০১৫ শনিবার
৩৩তম জন্মদিন। চাকরী করছি। স্কলাস্টিকা মিরপুর শাখায় তখন আমি ও-লেভেলের গণিতের শিক্ষক। সেবার শুভেচ্ছা কিছু পেয়েছিলাম। কিন্তু আর কিভাবে সেলিব্রেট করেছিলাম, আমার কিছু মনে পড়ে না। চাকরী ছিল একটা, সেটাই বড় মানসিক প্রশান্তি ছিল। যোগ্যতা অনুসারে চাকরী করছি কি না, সেটা নিয়ে অনেক কথা শুনলেও, আমি সেগুলা কিছু ভাবিনি। আমার কাছে অভিজ্ঞতা বড় বিষয় ছিল।
৬ জুন ২০১৬ সোমবার
৩৪তম জন্মদিন। স্কুলের চাকরী করে যাচ্ছি। এবার নাঈমা বললো, চল তোমাকে নিয়ে বাইরে বের হই। কই যাবা বললে আমাকে নিয়ে বনানী টাইম জোন এ চলে আসলো। বললো তোমাকে ঘড়ি কিনে দেবো। তোমার বার্থডে গিফট। আমার কোন ঘড়ি ছিল না তখন। পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখলাম। পরে নাঈমা আর আমি পছন্দ করে টাইটান এর কাপল ওয়াচ কিনলাম। সেই ঘড়ি আমি এখনও ব্যবহার করে যাচ্ছি কিন্তু নাঈমারটা ওর বাবার বাড়ি থেকে চুরি হয়ে গেছে। কোন হদিস আর পাওয়া যায়নি।
৬ জুন ২০১৭ মঙ্গলবার
৩৫ তম জন্মদিন। বলা নেই কওয়া নেই নাঈমা রাতের বেলা শেফাকে নিয়ে আমার জন্য একটা oppo স্মার্ট ফোন কিনে নিয়ে আসলো। আমার জন্মদিনের গিফট। এর আগে আমি কোন স্মার্ট ফোন ব্যবহার করিনি। এই প্রথম। আমাকে অনেকবার বলেছিল কিন্তু আমি পাত্তা দেইনি। এজন্য নাঈমা নিজে থেকেই প্ল্যান করে আমার জন্য কিনে নিয়ে আসে। শুরুতে আমি আপত্তি করলেও ব্যবহার করে আনন্দ পেয়েছিলাম। এখন আমি তিন নাম্বার স্মার্টফোন ব্যবহার করছি। তিনটাই নাঈমার কিনে দেয়া। এছাড়া বাসায় আর কোন সেলিব্রেশন করেছি কিনা মনে নেই। মেয়ে বড় হচ্ছে। মেয়ে নিয়েই সময় পার হয়ে যায়।
তবে স্কলাসটিকা স্কুলে সেলিব্রেশন হয়েছিল। আমার কলিগরা কেক এনেছিলেন। সেই কেক খাওয়া হয়েছিল সবাই মিলে। শুভেচ্ছা জানিয়েছিলো। দারুণ কেটেছিল সেই সময়।
৬ জুন ২০১৮ বুধবার
৩৬তম জন্মদিন। একটু স্পেশাল এজন্য যে এই বছর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে জীবন শুরু করি। নাঈমা কয়েকদিন আগে থেকেই বায়না ধরেছে, আমাকে ভাল একটা লেদারের ব্যাগ কিনে দিবেই দিবে। যেন তেন ব্যাগ নাকি আমার হাতে মানায় না। সেজন্য জন্মদিনের আগের দিন শেফা আর আমাকে সহ নিয়ে গেল গুলশান ডি.সি.সি মার্কেটে। সেখানের লেদার এম্পোরিয়াম থেকে আমাকে একটা লেদারের ব্যাগ কিনে দিল। বাসায় এসে আমাকে বললো, এই নাও তোমার বার্থডে এর সারপ্রাইজ গিফট। আমি নিজে কিনে নিয়ে এসে অনেক সারপ্রাইজড হলাম! রাতে মনে হয় কোন একটা রেস্টুরেন্টে খেতে বের হয়েছিলাম।
৬ জুন ২০১৯ বৃহস্পতিবার
৩৭তম জন্মদিন। পল্লবীর বাসায়। তখন নাঈমা প্রায় ৭ মাসের প্রেগন্যান্ট। অনিন্দ্য পেটে। সেই পেট নিয়েই মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাতায়াত করতে হচ্ছে। এই বছর আমার জন্মদিন এ বিশেষ কিছু করা হয়নি। তবে কয়দিন পরে আমাদের বিবাহ বার্ষিকি বেশ ঘটা করেই পালন করেছিলাম। বিয়ের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বাসায় পার্টি দিয়েছিলাম। নাঈমা আমকে রুপার তৈরী পাঞ্জাবীর বোতাম উপহার দিয়েছিল আর আমি ওকে দিয়েছিলাম লাল বেনারসী ওড়না।
৬ জুন ২০২০ শনিবার
৩৮তম জন্মদিন। বাবার বাসা থেকে চিরতরে চলে এসেছি জানুয়ারী মাসে। মার্চ মাস থেকে ভাড়া বাসায় থাকা শুরু করেছি মিরপুর অরিজিনাল ১০ নাম্বার এ, গফুর সাহেবের বাসায়। ওখানে ৬ মাস ছিলাম। তখন খুব জোরে শোরে করোনা এর লকডাউন চলছে। বাইরে বের হবার উপায় নেই। এর মধ্যে নাঈমার জ্বর এর মত হলো। করোনা মনে করে ও আমাদের পাশের রুমে কোয়ারেন্টাইনে চলে গেল। অনিন্দ্য তখন ছোট। আমি এবং বাসার সহযোগী সালমা মিলে বাচ্চাদুইটাকে সামলাতে হচ্ছে। এর মধ্যে জন্মদিন এবং অনেক স্মরণীয় জন্মদিন। কোনদিন ভোলার মত না।
আমার বন্ধু সুদীপা সিঙ্গাপুর থেকে আমাকে কল দিয়ে উইশ করে জানালো যে ও আমার জন্য অনলাইনে খাবার ওর্ডার করে দিয়েছে সিঙ্গাপুর থেকে। আমার বস্ময়ের সীমা রইলো না। আমার জীবনের অন্যতম বিস্ময়কর উপহার মনে হয় এটাই ছিল! দুপুর বেলা ডেলিভারী ম্যান খাবার দিয়ে গেল। পিজ্জা, গোলাপ ফুল, ড্রিঙ্কস! দুপুর বেলা আমরা সবাই মিলে মজা করে খেলাম। সুদীপার এই গিফট ভোলার না কখনই। এরপর রাতের বেলা শেফা অনেক খাবার পাঠালো কারণ ও জানতো নাঈমা কোয়ারেন্টাইনে আছে। রাতে খাবার চলে এলো। পোলাও, ভেজিটেবল, গরুর কালাভুলা এসব। এই গরুর কালাভুনাটা অতি অসাধারণ হয়েছিল খেতে এবং সেটা ওর জীবনের প্রথম রান্না করা গরুর কালাভুনা ছিল। নাঈমা এক ঘরে আর আমি এক ঘরে! এইভাবে খেয়ে দেয়ে কেটে গেল এই লকডাউনের জন্মদিন।
৬ জুন ২০২১ রবিবার
৩৯তম জন্মদিন! অনেক জমকালো ভাবেই পালিত হলো। আমার ৪০ হবার আগের শেষ জন্মদিন। আমার মেয়ে জুওয়াইরিয়া অনেক উত্তেজিত! আমার জন্য কার্ড বানিয়েছে। আমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য আগেই কেক এনে ফ্রিজে রেখে দিয়েছে। যেটা আমি দেখে নিলাম। আমরা তখন আমার শাশুড়ীর সেনপাড়ার বাসায় ভাড়া থাকছি। আমাদের প্ল্যান ছিল এই জন্মদিন ঘটা করে পালন করা হবে। পরের দিন শ্বশুর বাড়ীর সবার দাওয়াত ছিল। আমার এই জন্মদিনে চুমকী আপু, সিম্মি আপুদের সবার দাওয়াত ছিল। আরো কেক পেয়েছিলাম শ্বশুর বাড়ী থেকে। অনেক অনেক ছবি তোলা হল। আমি কালো পাঞ্জাবি পরেছিলাম। মজা করে মাথায় কাগজের টোপর পরে কেক কেটে ছবি তুলেছিলাম। বাচ্চারা আমার এসব কান্ডে অনেক মজা পেয়েছিল। অনেক স্মরণীয় ভাবে কেটেছিল সেই দিন।
জন্মদিনের প্রথম শুভেচ্ছা জানিয়েছিল ছোট ভাই রাদিত। আমার ফেসবুক বন্ধ ছিল থেকে আমাকে ফোন দিয়ে কি বকাঝকা। আমাকে ফেসবুক খোলালো। এরপর পোস্ট করলো খুব সুন্দর করে একটা শুভেচ্ছা বার্তা। আমাদের একসাথে ছবি দিয়ে। ও তখন কিশোরগঞ্জে ছিল। অনলাইনের ক্লাস আর অ্যাসাইনমেন্ট এর ঝক্কি ঝামেলা সত্ত্বেও আমাকে ঠিক সময় মত উইশ করতে ভোলেনি। অনলাইনে এবং ফোন এ আরও অনেক অনেক শুভেচ্ছা পেয়েছিলাম আমি।
বেশ ভালও রকমের চমক আমাকে দিয়েছিল আরেক ছোট ভাই রিফাত। ও আমাকে কিশোরগঞ্জ থেকে রকমারী এর মাধ্যমে অর্ডার দিয়ে আমার জন্য তিনটা বই পাঁঠিয়ে দিয়েছিল। তিনটাই ছিল লতিফুল ইসলাম শিবলী ভাই এর লেখা বই। তখন আমার অনলাইন ক্লাস চলছিল। সময়ের অভাব ছিল না। আমার মনে আছে আমি তিনটা বইই একদিনে পড়ে শেষ করে ফেলেছিলাম। আমার অনেক ভাল লেগেছিল। তবে শুধু বইই নয়। রিফাত আমাকে বিস্মিত করেছিল এমন একটা জিনিস দিয়ে যা ইতিপুর্বে কেউ আমাকে কখনও দেয় নি। ও আমার নামের অক্ষরগুলা দিয়ে একটা অ্যাক্রোস্টিক কবিতা লিখে আমাকে উইশ করেছিল। রকমারী ওর মত করে লাইনগুলা লিখতে পারেনি। পরে রিফাত যখন আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আমি ভীষণ রকম চলকে গিয়েছিলাম। কিছু কিছু ভাবলাসা ব্যাখ্যা করে বোঝানো যায় না। রিফাতের কবিতাটাও এমনই ছিল।
৬ জুন ২০২২ সোমবার
৪০তম জন্মদিন। বহু আকাঙ্খিত ৪০। অনেক ইচ্ছা থাকলেও কিছুই করা হয়নি। সবাই ব্যস্ত। জন্মদিনের দুইদিন আগে শুভ সারিয়া এর তরফ থেকে ভীষণ সুন্দর একটা পারফিউম উপহার পেয়েছি। আমি সেটা আমার অফিসে এনে রেখেছিলাম। আর জন্মদিনের আগের দিন নীলক্ষেতে গিয়েছিলাম আমার নিজের জন্য ফাউন্টেন পেন আর কালি কিনতে। নিজেকে নিজে উপহার দেয়া আর কি। ফাউন্টেন পেন তো আমার সব সময়ের প্রিয় জিনিস। সেটাই কিনলাম। পাশেই বুয়েট। পলাশী পর্যন্ত গিয়েছিলাম আমি আর বন্ধু জিকো। এরপর ছোট ভাইদের এক ঝাকের সাথে দেখা। আমার সাথে দেখা করার জন্য এলো, রাদিত, সুমাইয়া, রাতুল, অন্তর, এহসান আর তুষার। ওরা সবাই বুয়েট কেমিক্যাল ২০১৯ ব্যাচের। এহসান আর তুষার এমনেই খেতে এসেছিল। এসে আমার সাথে দেখা। আমরা একসাথে বসে জুস খেলাম। কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। এরপর বাসায় চলে আসি। পরের দিন অর্থাৎ আমার জন্মদিনের দিনই তিনটা ক্লাস ছিল। যথারীতি সব ক্লাস নিয়ে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরি। বাসায় এসে নাঈমার কাছে বায়না ধরলাম খিচুড়ি খাবো। সালমা বাসায় ছিল। বানিয়ে দিলো খিচুড়ি। সাথে পেয়াজ ভর্তা আর ডিম ভাজি। এটাই ছিল আমার ৪০ তম জন্মদিনের বিশেষ খাওয়া। এভাবেই জীবনের ৪০তম জন্মদিন পার করলাম।
তবে রাতের কথা না না বললেই হয়। ৫ তারিখ রাতে নাঈমা যথারীতি কেক নিয়ে এসেছে ৪০তম ইংরেজীতে লিখে। কিন্তু ১২টা পর্যন্ত ধৈর্য কি আর আমার অনিন্দ্য রাখে? সে ব্যস্ত হয়ে গেল কেক খাবে বলে। আমার ক্ষুদে পিতা মহাশয়ের মান রাখতেই আমাকে ৫ তারিখে রাত ১১.৩০ এ কেক কেটে ফেলতে হলো। এরপর মহাশয় কে খাইয়ে দিয়ে নিজেই আর তেমন কিছু ভাগে পেলাম না। তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হলো কারণ পরের দিন ৬ জুন আমার জন্মদিনের দিনই তিনটা ক্লাস নিতে হবে এবং প্রথমটাই সকাল ৮টায়। এভাবেই কেটে গেল। রাতে বাসায় গিয়ে খিচুড়ি খেলাম।
৬ই জুন ২০২৩ (মঙ্গলবার)
আমার ৪১ তম জন্মদিন! কয়েকদিন আগে থেকেই আমার ছেলে মেয়ের মধ্যে গোপন তোড়জোড় দেখছিলাম। আমার মেয়ে এসবের খবর অনেক বেশী রাখে। আমি চুপচাপ থাকি। এখন কি আর এসব নিয়ে হুল্লোড় করা মানায়? আর বয়স তো কম হল না! মেয়ে আগে থেকেই বলে রাখছে, বাবা ৬ তারিখ মঙ্গলবার তোমার জন্মদিন আর তোমার তো অফিস নাই। আমাদের কোথায় খেতে নিয়ে যাবা? আমি তো হতবাক! মেয়ে সব কিছু নিজেই সেট করে ভাইকেও উস্কে দিচ্ছে! এখন বুফে খাবে না খেলার জায়গাওয়ালা রেস্টুরেন্ট এ গিয়ে সেট মেন্যু খাবে এটা নিয়ে জল্পনা কল্পনা! অবশেষে মেয়েই ঠিক করলো, সেট মেন্যু খাবে। আমি বেঁচে গেলাম! কিছুটাকা যদি বাঁচে আর কি!
৫ তারিখ বিকাল বেলাতেই কেক এনে আমার সামনে রেখে সারপ্রাইজ দেয়া হলো! আমি অনেক বিস্মিত হলাম! বললাম, বাবা আমাকে কি রাত ১২টায় এই কেক দেখে বড় একটা চিৎকার দিতে হবে? মেয়ে বলল, দিও! আমি বললাম, আচ্ছা! ছেলে একটু একটু পরপর জিজ্ঞাসা করছে আমার “হ্যাপি বার্থডে” কখন হবে? যতটা না জন্মদিনের আমেজ তার চেয়ে বেশী আসন্ন কেক খাবার আনন্দ! আমি উৎসাহে ওদের আনন্দ দেখছি!
রাতে আয়শা আর তাকিয়া এলো নাঈমার সাথে কথা বলতে। আমি অফিসে করে এসে প্রচন্ড গরমে এত ক্লান্ত থাকি যে আমার একটু শুয়ে পড়তে পারলেই ভালও লাগে। কিন্তু সেই উপায় কই? একটু একটু পরে আমাকেই জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে যে কেক কখন কাটা হবে? আমু একটু শুয়ে পড়লাম। এদিয়ে রাত বেজে প্রায় ১১.৩০! তাকিয়া আর আয়শা বাসায় চলে যাবে। আমার ছেলে মেয়েরও তর সইছে না। আমার আর উপায় কি? উঠে এসে টেবিল এ বসতে হলো। কেক নিয়ে মহা উৎসাহ দেখাতে হল! হাততালি দিলাম নিজে নিজেই। ছেলে মেয়ে মহা খুশি! ৪১ টা তো আর সম্ভব না, একটা মোমবাতিও জ্বালানো হলো। অনিন্দ্য মহা উতসাহে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলো! এরপর আমি ১২টা বাজার আধা ঘন্টা আগেই ছেমে মেয়ের হাত ধরে কেক কেটে আমার ৪১ বছরের জীবন শেষ করে দিলাম আধা ঘন্টা আগেই। আয়েশা ছবি তুলে দিল! কেক খেলাম! অনিন্দ্য নিজেরটা খেলো। আমার মা দৈবক্রমে আমার বাসায় উপস্থিত ছিলেন। এসেছিলেন একটু আগেই। বারংবার বলা সত্ত্বেও উনি টেবিল এও এলেন না আর কেকও খেলেন না! কেন আমি জানি না। হয়ত আমার জন্মদিনের কথা উনি ভুলে গিয়েছিলেন। আমার ধারণা মনে থাকলে হয়ত আসতেন না। কি জানি, আমার ধারণা। উনাকে জিজ্ঞাসা করে তো আর দেখিনি। অনিন্দ্য নিজের ভাগের কেক খেয়ে ঘরে গিয়ে তার দাদীর কেকটাও মহা উৎসাহে খেয়ে ওর গোলাপী ঠোঁট দুইটা ক্রিম দিয়ে মাখামাখি করে ফেললো! শৈশবের আনন্দ করছে ওরা। বাবার জন্মদিন তো উপলক্ষ মাত্র! আনন্দ তো আমারও কম হচ্ছে না ওদের দেখে।
রাত ১২টায় তাওসিফের সাথে মেসেঞ্জারে কথা হলো। আমাকে সবার প্রথমে অনলাইনে ও উইশ করেছে। কিশোরগঞ্জ থেকে আমাকে উইশ করে চিঠি পাঠিয়েছে। সেই চিঠি ঠিক ৬ তারিখেই আমার অফিসে এসেছে। এটা দারুণ একটা আনন্দের ব্যাপার! চিঠির আনন্দ অন্য কিছুতে পাওয়া যায় না। তাওসিফ কে বললাম, মুখে বলসো ভাল কথা, এবার ফেসবুকে লিখেও উইশ কর! পছন্দের মানুষের কাছে এমন একটু আধটু দাবী করে কিছু আদায় করাকে আমি দোষের কিছু মনে করি না। ও নিজেই করতো। সুন্দর করে আমার সাথে একটা ছবি সহকারে আমাকে ইংলিশ এ দারুন সুন্দর উইশ করলো। তাওসিফের ইংলিশ পড়ার আগে আমার একটু দোয়া দুরুদ পড়ে নিতে হয়। ও এমন সব লিটারেরী ইংলিশ শব্দ সহযোগে লেখে যে আমি সবগুলার অর্থ জানি না। যেমন এবার লিখেছে Tapestry! সত্যি বলছি এর মানে আমি জানতাম না। গুগলে দেখা লাগলো। ওর প্রতিটা ইংলিশ লেখার মধ্যে নতুন নতুন শব্দ পাই। শিখি। নিজের অপারগতা স্বীকার করার যে আনন্দ সেটা কি সবাই বোঝে? আমার ফেসবুক থেকে আমি ইচ্ছা করেই আমার জন্ম তারিখ সরিয়ে রেখেছি। আমি চাই না ফেসবুক দেখে মানুষ আমাকে উইশ করে ভরিয়ে ফেলুক। বরং ঐ দুই চারটা শুভেচ্ছাতেই আমার বেশী ভাল লাগা কাজ করে যারা ঠিকই কষ্ট করে আমার মত এক অধমের সামান্য জন্মদিবসের তারিখটা মনে রেখে আমাকে উইশ করেছে! আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তাওসিফের সাথে কমন লিস্টে থাকা আরো কয়েজন মানুষ উইশ করলো। অনলাইনে মেসেঞ্জারে সবার প্রথমে শুভেচ্ছা জানিয়েছে রিনতি! কেউ কেউ তাওসিফের পোস্ট করা ছবিতে লাভ রিয়্যাক্ট দিয়ে তাদের ভালোবাসা জানিয়ে দিলো। তাওসিফের রুমমেট তমাল এর সাথে কথা হল মেসেঞ্জার এ।
এরপর এলো মঙ্গলবার। আমার আসল জন্মদিনের দিন। ৬ই জুন ২০২৩! ঘুম থেকে উঠলাম দেরী করে। মেয়ে আমার আগেই উঠে পড়েছে। বারংবার তাগাদা দিচ্ছিলো কতক্ষণে আমরা বের হলো। কারণ আমরা ওদের কথা দিয়েছে ওদের কে মিরপুর-১০ এর মেট্রোরেল এ চড়িয়ে এরপর পল্লবীতে ওদের কাঙ্খিত রেস্টুরেন্ট এ নিয়ে যাওয়া হবে। সেটাই করলাম না। গরমে ঘেমে মেয়ে অস্থির আমরা হয়ে গেলেও ছেলে মেয়ের উতসাহের কমতি ছিল না। ওরা খেলাধুলা করলো। আমরা রেস্টুরেন্ট থেকেই মেট্রোরেলের আনাগোনা দেখছিলাম। বাচ্চাদের পছন্দ অনুসারে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চিকেন ফ্রাই, ফ্রায়েড রাইস এসব খাওয়া হলো। এরপর তিনটার দিকে বাসায় চলে আসি। প্রচন্ড গরমে আমরা সবাই অস্থির। মেসেঞ্জারে আমাকে অবাক করে দিয়ে শুভেচ্ছা জানালো কল দিয়ে জানাঙ্গীরনগর ইউভার্সিটির ছোট ভাই শুভ! আমি অনেক খুশী হয়েছি। মামাতো বোন সিম্মি আপু শুভেচ্ছা জানিয়েছে কল দিয়ে। সিম্মি আপু কোনবারই আমাকে উইশ করতে ভোলে না। ঠিক করলাম আমরা কোন একদিন গেট টুগেদার করবো।
আমি দারুণ কিছু উপহার পেয়েছি। সবার প্রথম উপহার দিয়েছে আমার মেয়ে জুওয়াইরিয়া। কয়েকদিন ধরে আমাকে ভীষণ সুন্দর একটা কার্ড নিজের হাতে বানিয়ে দিয়েছে। পুতি দিয়ে, ওরিগ্যামি প্রজাপতি দিয়ে সুন্দর একটা কার্ড। তাওসিফের কাছ থেকে পেলাম পত্র শুভেচ্ছা চিঠি। নাঈমা উপহার দিয়ে আমার অতিপ্রিয় সুন্দর রুপার একটা কলম। আমার অনেক দিনের শখের জিনিস। সবচেয়ে বেশী ভালোবাসা জানিয়েছে আমার ছেলে। একটু একটু পরপর আমার গেলে চুমু দিয়ে বলেছে আব্বু হ্যাপি বার্থডে। আমাকে জড়িয়ে ধরেছে, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। যেন ও আমার ছেলে নয়, আমার বাবা। আমি ওর ছেলে। বাবার কাছ থেকে না পাওয়া স্নেহগুলো স্রষ্টা আমার ছেলের হাত দিয়ে দিয়েছেন আমাকে ফিরিয়ে। জীবনে আনন্দ পাবার মত অনেক কিছুই আছে। একটু খুঁজে নিয়ে হয়। একটু ধৈর্য ধরতে হয়।
আরো টুকরো টুকরো কিছু উইশ পেলাম। ফেসবুকে আমার উইশ যা এসেছে তা মূলত তাওসিফের পোস্ট দেখে! ১৯৯৯ ব্যাচের বন্ধু সজীব ওদের গ্রুপে আমাদের কয়েকটা ছবি দিয়ে মিনি ভিডিও করে উইশ করলো। সেটার দেখা দেখি ওখানে অনেকগুলো শুভেচ্ছা পেলাম। সবাইকে ধন্যবাদ। সবাইকে আমার ভালবাস। রাজন ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়ে ট্রিটও দাবী করে বলসো। দেখি একদিন ওর সাথে দেখা করতে হবে। আমার অনেক কাছের বন্ধু, পত্রবন্ধু তন্ময় রাতে শুভেচ্ছা জানালো। এছাড়া সুদীপা, আরিফ ওরাও শুভেচ্ছা, দোয়া জানিয়েছে। আব্দুল্লাহ আর আলামিন আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে মেসেঞ্জারে ডে-তে ওদের সাথে আমার ছবি দিয়ে। এভাবেই টুকটুক করে কেটে গেল আমার ৪১তম জন্মদিন। ভেবেছি যতদিন বেঁচে থাকবো জন্মদিনের কথাগুলো লিখে রাখবো। যে বছরের পরে লেখা হবে না, বুঝে নেবেন আমি আর বেঁচে নেই। আমি এমন কোন মানুষ নেই যে মনে রাখতে হবে। তবুও যদি মনে পড়ে, আমার জন্য দোয়া করবেন।
৬ই জুন ২০২৪ (বৃহস্পতিবার)
এই বছর ৬ই জুন আমার ৪২ বছর পূর্ণ হয়ে গেল। রাত ১২টা থেকে শুরু করে দিনের শেষ পর্যন্ত নানা ভাবে কাটিয়ে দিলাম আমার এই ৪২তম জন্মদিন। জন্মদিন কি অন্যদিনগুলোর থেকে আলাদা কিছু? আমার তেমন কিছু মন হয় না। আর পাঁচ দশটা দিনের মতই। তবু জন্মদিন কে কেন্দ্র করে কত কিছু ভাবা হয়। এই দিন কে আলাদা করে স্মরণ করা হয়। অন্তত বাচ্চাদের কথা মনে করে হলেও এই দিনটাকে আলাদা করে স্মরণ করা হয়। সেই ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি। এখনও দেখে যাচ্ছি। বয়স বেড়ে যাচ্ছে, তবুও কিছু স্মৃতি তো থেকেই যায়। আমি চাই আমার এই টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলোকে ধরে রাখতে। ৪০ বছর বয়স থেকে লেখা শুরু করেছি। তারই ধারাবাহিকতায় এবার লিখছি আমার ৪২তম জন্মদিনের কিছু টুকরো টুকরো কথা।
রাত ১২টা বাজার অনেক আগে থেকেই ছেলে অনিন্দ্য অস্থির হয়ে গিয়েছিল কখন সময় হবে আর সে তার বাবাকে “হ্যাপি বার্থডে” বলে সারপ্রাইজ দেবে! আমাকেই বারবার ওকে সময় শুধরে দেয়া লাগছিল। এমনটাই ছিল সেই সারপ্রাইজ। আমার জন্য রাতেই কেক আনতে হবে সে বায়না ধরেছিল। পরে নাঈমা, পরের দিন কেক আনবে প্রমিজ করায় সে কিছুটা শান্ত হয়। আমি কিছুটা টায়ার্ড ছিলাম। মেয়ের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার শেষ পরীক্ষা (ইংলিশ) এর প্রিপারেশন নিচ্ছিলো। মাঝে মাঝে ওকে গ্রামার এর এটা ওটা দেখিয়ে দিচ্ছিলাম। কখন যেন চোখ লেগে গেল। একটু ঘুমিয়েও পড়েছিলাম মনে হয়। এরপর চোখ মেলে দেখি ১১.৫৫ বাজে। আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকী আছে। আমি অপেক্ষা করছিলাম আমার সারপ্রাইজ এর অন্য। ১২ট বেজে গেলে ছেলে মেয়ে আমাকে উইশ করলো। আর নাঈমা আমাকে অবাক করে দিলো আমার জন্য আনা উপহার দিয়ে। আমার জন্য খুব সুন্দর একটা ঘড়ি কিনে এনেছে। হাতঘটি। অনেকদিন থেকেই আমার একটা ঘড়ির শখ ছিল। নাঈমা সেটা পূরণ করে দিলো। আমার আগের ঘড়িটাও ওরই কিনে দেয়া এবং সেটা ২০১৬ এর জন্মদিন উপলক্ষ্যেই দেয়া ছিল। এবারের ঘড়িটাও ভীষণ সুন্দর। ডায়ালের জায়গাটা ময়ূরকন্ঠী নীল রঙ এর। হঠাৎ দেখলে কালো মনে হলেও আসলে ময়ূরকন্ঠী নীল। সেই ঘড়িটাই এখন পরছি। ছেলে এসে আমার গালে চুমু দিয়ে বললো, হ্যাপি বার্থডে আব্বু! মেয়ে একটু মুখচোরা ধরণের। সে কিছু বললো না। মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো আর ইংলিশ গ্রামারে চোখা বুলাতে লাগলো। ছেলে অভিযোগ করে বসলো, আব্বু কেক কোথায়? ওকে অনেক বয়ে কয়ে আস্বস্ত করা হলো যে, কেক দিনের বেলায় আনা হবে। সে খুশিমনে গাড়ি দিয়ে খেলতে লাগলো।
দিনের বেলা অফিস। তিনটা ক্লাস! নতুন সেমিস্টার। নতুন পড়া মাত্র শুরু হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে আমার জন্ম তারিখ সরিয়ে দেয়াতে একটা লাভ হয়েছে। জন্মদিনের শুভেচ্ছার স্রোতে ভাসতে হচ্ছে না। মোটামুটি সবাই ভুলে গেছে! এটা এমন কিছু না যে মনে রাখতে হবে। শুভেচ্ছা দিতে হবে। তবুও কেউ যদি মনে রেখে উইশ করে তাহলে একটু স্পেশাল ফিল হয়। ভালই লাগে যে আমাকে মনে রেখেছে। এই মধ্য বয়সে এসেও সেটা বোধ করি। অবশ্য এতে কিছু যায় আসে না। আমাকে নাঈমা ও বাচ্চারা উইশ করেছে। আর সেই সাথে জন্মদিন ব্যাপি যাদের উইশ পেয়েছি তারা হলো- শুভ, সারিয়া, তাকিয়া, জেনী, রাদিত, রিনতি, সৌরভ অধিকারী, সৌরভ শাওন, খেয়া, আরিফ, সুদীপা, আলামিন, প্রমি, কিম! সবাইকে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে দোয়া ও ভালবাসা আমার জন্মদিন মনে করে উইশ করার জন্য।
জন্মদিনে উপহার পেলে মনে হয় আনন্দের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়! মানুষের দোয়া ও ভালবাসাই সবচেয়ে বড় উপহার। এর কোন তুলনা করা যায় না। আমি সেটা পেয়েছি সবার কাছেই। তবে আমি চারটা স্পেশাল গিফট ও পেয়েছি। পত্রমিতা সৌরভ শাওন আমাকে দিয়েছে বই “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রেষ্ঠ চিঠিপত্র” (বাতিঘর প্রকাশনী), আমার জন্মদিনের দুইদিন আগেই। আমার এলাকায় এসে আমার সাথে প্রথমবার দেখা করে গেল আর আমাকে এই বইটি দিয়ে রীতিমত চমকে দিলো। জন্মদিনের প্রারম্ভে নাঈমা দিল ক্রিডেন্স এর অসাধারণ ঘড়িটা। ঘড়িটা সে কয়দিন আগেই কিনে রেখেছে কিন্তু আমাকে জানতে দেয়নি। এমন আরও আরও গিফট চাই নাঈমার কাছ থেকে আমি। পেয়ে আসছি বিয়ের পর থেকেই। এরপর সারিয়া দিয়েছে অসাধারণ একটা পারফিউম (Guess), যা আমার অনেক পছন্দের। শুভ দিয়েছে আমাকে লেদারের ওয়ালেট। এটাও আমার অনেক পছন্দের জিনিস। যখন থেকে ওয়ালেট ব্যবহার করছি, তখন থেকে লেদার ওয়ালেটই আমার একমাত্র পছন্দ! রাদিত বলে রেখেছে ঢাকা এসে আমাকে গিফট দেবে। আমি অপেক্ষায় আছি। দাবী ছাড়াছাড়ি নাই! আমার যা যা পছন্দ আমি সেগুলোই গিফট পেয়েছি। অফিসে গিয়ে পেয়েছি ৬ টি চিঠি দেশ ও বিদেশের পত্রবন্ধুদের কাছ থেকে। জন্মদিনের আনন্দ বাড়িয়ে দিতে যেগুলোর জুড়ি ছিল না। নেদারল্যান্ড থেকে পাঠানো চিঠিতে পত্রবন্ধু আমাকে ১৮ টি নানা রকমের কয়েন গিফট করেছে।
অফিস থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত বেজে গেছিলো প্রায় ৭.৪৫! এশার আজানের কিছুক্ষণ আগে। সারা বাসা গন্ধে ম ম করছে। নাঈমা তার প্রতিশ্রুত ইলিশ পোলাও রান্না করেছে যা আমাদের সবার অনেক প্রিয়! পেটে ক্ষুদা চাগাল দিয়ে উঠলো। অফিসে শুধু দুই কাপ কফি খেয়েছিলাম। ফ্রেশ হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন শুভ সারিয়া আসবে! ওদের সাথে ডিনারে বসতে হবে যে! ততক্ষণে ওরাও অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। মোটামুটি ১০.৩০ এর দিকে ওরা এলো। নাঈমা কাঁচা আমের ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক বানিয়ে রেখেছিল। সেটা খেয়ে আমরা আর দেরী করলাম না। ডিনারে বসে গেলাম। নানা রকম আড্ডা আর গল্পে গল্পে ডিনার সারা হলো ইলিশ পোলাও দিয়ে। সাথে মুরগির মাংশ আর ডিমও ছিল। আর ছিল কাস্টার্ড। তাকিয়া এসেছিল কেক নিয়ে। ডিনার করে এরপর কেক কাটা হলো। ছবি তোলা হল। ফেসবুকে অ্যালবাম করে রেখেছি ছবিগুলো। ছেলে অনিন্দ্য আমাকে কেক খাইয়ে দিলো। মেয়ে আমাকে খাওয়াবে না, তাকে আমার খাইয়ে দিয়ে হবে! মুখের সামনে ধরা কেকের অর্ধেকটা এক কামড়ে খেয়ে নিলো জুওয়াইরিয়া। নাঈমা কে কেক দুইবার খাওয়াতে হলো কারণ তাকিয়া প্রথমবার ছবি নিতে পারে নি। এইভাবেই কেটে গেল ডিনারের সময়ট। তাকিয়া এরপর বাসায় চলে যায়। তখন প্রায় রাত ১১.৩০ বেজে গেছে। এরপর আমরা শুভ আর সারিয়া’র সাথে আড্ডা দিলাম আরও কিছুক্ষণ আর চা খেলাম। সাথে সাথে আমরা ছোট খাটো কিছু ঘোরার ব্যাপারে আলাপ করলাম। সেগুলো সম্পর্কে না হয় হয় পরে বলবো। আজ এই পর্যন্তই। এভাবেই কাটলো আমার জন্মদিনের সময়গুলো। স্মৃতির খাতায় তুলে রাখলাম।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ
এভাবেই চেষ্টা করবো এখন থেকে জীবনের বাকী দিনগুলোতে উদযাপিত আমার জন্মদিন গুলোর কথা লিখতে রাখতে। ৪০ হবার পরে লেখা শুরু করলাম স্মৃতি থেকে নিয়ে। যতটুকু মনে ছিল লিখেছি। অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা পেয়েছি সবার। আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ। যেই বছরের পর থেকে আর ৬ জুন নিয়ে কোন লেখা পাবেন না, বুঝে নিবেন আমি মারা গেছি। আমার জন্মদিন ধারাবাহিকতাও লেখা শেষ হয়ে গেল। সেটা যদি বুঝতে পারেন তাহলে আমার জন্য দোয়া করে দিয়েন। সেটাই আমার কাজে লাগবে।