আমার ইদানিং খুব গ্রামে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমার আসলে গ্রাম বলে কিছু নেই। হয়ত ছিল কোন এক কালে কিন্তু এখন আর গ্রাম বলে কিছু নেই। গ্রামের সাথে সম্পর্কের সব সুতো ছিড়ে গেছে। যে মানুষগুলোর সাথে গ্রামের সম্পর্ক ছিল সেগুলোই নেই। মানুষের শরীরে টিকে থাকলেও সম্পর্ক নামক কোন কিছু আর তাঁরা যখন বাকী রাখেনি তখন আমার তরফ থেকেও সেটাকে টিকিয়ে রাখার আর কোন দরকার মনে করি না। সম্পর্কগুলো এখন আর নেই তবে মনে পড়ে। আর সেই যে গ্রামে যেতাম, সেগুলাও মনে পড়ে। সোশ্যাল মিডিয়াতে যখন দেখি মানুষ গ্রামে যায়, গ্রামের ছবি দেয়, তখন আমার মনে পড়ে এমন একটা গ্রাম হয়ত এককালে আমারও ছিল। চাইলেই যেহেতু স্মৃতি মুছে ফেলতে পারছি না সেহেতু মনে তো পড়েই। আর মনে পড়ে বলেই খারাপও লাগে আর কি। এটাকে কাড়িয়ে উঠতে হবে। একটু সময় লাগছে আর কি। আমার গ্রামে যাবার আকুতির কথা শুনে অনেকেই আমাকে তাদের গ্রামে গিয়ে ঘুরে আসতে বলে। তাদের সবার প্রতি আমি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। বহু বছর ধরে নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিন এর অনেক লেখাতেই দেশের প্রতি যে আকুতি ফুটে ওঠে সেটা যে কতখানিক জ্বালা ধরায় মনে বা কতখানিক মনে কষ্ট নিয়ে উনি লেখেন সেটা আমি বুঝতে পারি।
এখন মাঝে মাঝে আফসোস লাগে কেন প্রবাস জীবন ছেড়ে চলে এসেছিলাম। দেশের প্রতি যে ভয়ঙ্কর মায়া কাজ করতো তখন সেই মোহে পোড়ে দেশে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেই মোহ কাটতে আমার বেশী সময় লাগেনি। সময় লাগবে কেন যখন দেখেছি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্বয়ং জন্মদাতাই? আমারও সময় লাগেনি বুঝতে। তবে সেখান থেকে মুক্তি পেতে সময়টা অনেক বেশীই লেগে গেছে। কিছু করার ছিল না আসলে। আমি পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছি বারবার। আর আমার সরলতার সুযোগ নিয়েছে এই চালাক মানুষটা। এখন সেই সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে যাওয়াতে আমি একরকম মুক্তির স্বাদ পেয়েছি। এজন্য আমার জীবন থেকে অনেক কিছু চলে গেলেও আমি স্বস্তি পেয়েছি। নিজের মত করে এই যে লিখতে পারছি, সেটাও আমার মুক্তিরই অংশ। আবদ্ধ পরিবেশে থেকে যেমন বড় হওয়া যায় না, মন মানসিকতা সংকীর্ণই থেকে যায়, আমার ক্ষেত্রেও তাইই হয়েছিল। সেই মোহজাল থেকে বের হতে পেরে আমি প্রকৃতই মুক্ত। অন্তত ভেবে নিতে তো দোষ নেই। যতক্ষণ এই পার্থিব জীবনে মুক্ত থাকা যায় ততই ভাল আমাদের জন্য।
গ্রামের মাটির চুলা আর সেই চুলায় রান্না করা আমার দেখতে বেশ ভালই লাগে। ছোট বেলায় যখন গ্রামে যেতাম তখন গভীর মনোযোগ দিয়ে আমি চুলায় জ্বাল বাড়ানো দেখলাম আর জ্বালানীর ছিদ্র দিয়ে এটা ওটা দেয়া দেখতাম। আমি নিজেও এটা ওটা দিয়ে চুলার আগুন ধরে রাখার চেষ্টা করতাম। কখনও কখনও চুলা থেকে বেরিয়ে আসা ধোঁয়া চোখে জ্বালা ধরালেও আমার ভাল লাগতো। শহরের বাসাবাড়িতে গ্যাসের আগুনে তো আর ধোঁয়া হয় না। দুইটা দুই ধরণের আগুন! গ্রামের ওই স্বল্পদিনের ভ্রমনে আমার তো সেই মাটির চুলা আর সেই চুলার রান্না বিস্ময়ের লাগবেই! তখন ওটা দেখলেই আমার কাছে মনে হত পিকনিকের কথা। কারণ আমাদের কাছে পিকনিক মানেই ছিল মাটির চুলায় রান্না করে খাওয়া। ছোটবেলায় সেটাই বুঝতাম। মাটির চুলা বা ইট দিয়ে বানানো চুলায় লাকড়ি দিয়ে রান্না হবে। এটাই ছিল পিকনিক। পরে গ্রামে দেখতাম ঘরে ঘরে মাটির চুলায় রান্না হচ্ছে। তখন আমার মনে হত গ্রামের মানুষের কত মজা! এদের তো দেখি প্রতিদিনই পিকনিক! আহা আমি যদি সবসময় গ্রামে থাকতে পারতাম, তাহলে আমি প্রতিদিনই পিকনিক খেতে পারতাম! আমার কাছে তখন এমনই মনে হতো!
এখন নামমাত্র শীতকাল চলছে ঢাকায়। নামমাত্র এজন্য বললাম যে ঢাকার এই শীত আমাকে এখনও গায়ে চাদর পরতে বাধ্য করতে পারেনি। আমার চাদর পরতে অনেক ভাল লাগে কিন্তু ঢাকার শীত এখনও এত তীব্র হয়নি যে আমি চাদর পরে ঘুরে বেড়াবো। এইত মাত্র দুইদিন আগেই কুয়াকাটার রাখাইন পল্লী থেকে তাতের আরও একটা চাদর কিনে নিয়ে আসলাম! আমার তিনটা চাদর আছে আগে থেকেই। এটা দেখেও লোভ সামলাতে পারলাম না। মাত্র আড়াইশ টাকায় এত সুন্দর একটা চাদর পেয়ে যাবো আমি ভাবতেও পারিনি! অসাধারণ সুন্দর। দেখা মাত্রই কিনে ফেলেছি। কিনে ঘরে রেখে দিয়েছি। অপেক্ষা করছি শীত বাড়লে পরতে পারবো। উত্তরবঙ্গে অনেক শীত পড়ে। কিন্তু আমরা তো আর উত্তরবঙ্গে থাকি না। শীত ভালমত পড়ে না বলে আমি চাদর, জ্যাকেট, হুডি কিছুই পরতে পারি না। একটা লেদার জ্যাকেট কেনাও হলো না কোনদিন এই শীতের অপ্রতুলতার কারণে। ঢাকায় লেদার জ্যাকেট পরার মত শীত নেই কোথাও। আমি শীতের জন্য অপেক্ষা করছি। আর অপেক্ষা করছি একটা গ্রাম ঘুরে দেখার। আমার অনেক গ্রাম দেখতে ইচ্ছে করছে। গ্রামের রাস্তায় একটু হাঁটতে ইচ্ছে করছে।