৫ ডিসেম্বর ২০২১

আজকের কিছু টুকরো কথা আমার এই লেখায় তোলা থাকুক। আবার যদি কখনও পড়ি তখন যেন আমার আবার এটা মনে পড়ে। কুয়াকাটায় সংক্ষিপ্ত ভ্রমন শেষ করে আজকে সকাল ১১ টার দিকে বাসায় এসে পৌছালাম। মেয়ের আজকে ফাইনাল পরীক্ষার শেষটা ছিল। পরীক্ষার সময় ৯ টা থেকে ১০.৩০ পর্যন্ত। আমরা তখনও বাসে। স্কুল থেকে শিক্ষক মহোদয় একজন মেয়ের মা কে ফোন করে জিজ্ঞাসা করলো মেয়ের কথা। যখন শুনলো আমরা রাস্তায় আছি, তখন আমাদের কে এই সুযোগ দিলেন যে আমরা বাসায় এসে এরপর মেয়েকে নিয়ে স্কুলে নিয়ে গেলেও উনারা পরীক্ষা নিয়ে নেবেন। আমি নিজেও একজন শিক্ষক হয়েও মেয়ের সন্মানিত স্কুলের শিক্ষকগণের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে এলো। এত ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁরা আমার মেয়েটিকে আলাদা করে মনে রেখেছেন এবং ছাত্রীটি কেন পরীক্ষায় এলো না সেটাও তাঁরা জানতে চেয়েছেন এবং বিলম্বে পরীক্ষা নেয়ারও ব্যবস্থা করে নিয়েছেন! শিক্ষকের আদর্শ যারা নিজের মধ্যে ধারণ করেণ, তাঁরা যে কতটা মহান হতে পারেন, সেটা আজকে আবারও বুঝতে পারলাম। আমি নিজেও এ থেকে শিক্ষা নিয়ে নিয়ে নিলাম। বলতে পারি, নতুন করে দীক্ষা পেলাম শিক্ষক হবার।

 

মেয়েকে স্কুলে দিয়ে কি করবো? ঘন্টা খানেকের অপেক্ষার পালা। রাস্তার এপাশ ওপাশ ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। স্কুলের সামনেই একটা ছোট খাবারের রেস্তরাঁ। মহল্লার মধ্যে যেমন হয় আর কি! ছাপড়ার রেস্তরাঁ। গিয়ে একটু বসলাম। ওখানে মিনি সিঙ্গাড়া পাওয়া যায়। প্রতিটা তিন টাকা দাম। ৭ টা নিলে এক টাকা ডিসকাউন্টে ২০ টাকায় খাওয়া চলে। কি আর করা! সিঙ্গাড়া দেখলে তো একটু খেতে মন চায়ই। দিলাম ওর্ডার। কিন্তু খেতে গিয়ে একটা দৃশ্যে আমার চোখে আটকে গেল। ওখানে জিলাপিও ভাঁজছিল। আমি সেটা দেখছিলাম আর সিঙ্গাড়া খাচ্ছিলাম। তখন দেখলাম দোকানের বাইরে একটা ৬-৭ বছরের ছেলে, লাল রঙের জামা পরা, খুব মনোযোগ দিয়ে গরম জিলাপি গুলা শিরা থেকে ওঠানো দেখছে। ভাজা লাল লাল জিলাপি গুলা আমার কাছে তেমন কোন আকর্ষনীয় কিছু না হলেও ঐ ছেলেটার কাছে যে অনেক আকর্ষণীয়ই ছিল। হাতে হয়ত টাকা ছিল না, কাউকে কিছু বলতেও পারছিলো না। ছেলেটিও ভিক্ষুকও নয় যে হাত পেতে কিছু চাইবে। ক্ষুধার্ত ছেলেটির কাছে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। রেস্তরাঁ ওয়ালারাও কেনই বা তাকে দয়া করতে যাবে যেখাবে এক পিস জিলাপি ৫ টাকায় বিক্রি হয়?

 

আমি দৃশ্যটা বেশীক্ষণ দেখতে পারলাম না। রেস্তরাঁ এর যে ছেলেটি আমাকে পরিবেশন করেছিল, ওকে ডেকে বললাম, ঐ ছেলেটিকে জিলাপি দাও। দাম আমি দিয়ে দিচ্ছি। পরে ও গিয়ে হোটেলে বললে, এক টুকরা কাগজে মুড়ে একটা ফরম জিলাপি ছেলেটার হাতে দিয়ে দিলো। জিলাপিটা হাতে পেয়ে ছেলেটি আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায়নি। সাথে সাথেই সেখান থেকে চলে গেল। ওর ওই প্রস্থান দেখেই আমি বুঝে নিয়েছিলাম, একটু জিলাপি খাবার জন্য ছেলেটার মন কেমন জানি করছিলো। মনে মনে দোয়া করলাম, আর কোন সন্তান যেন এমন না হয়। সামান্য একটু খাবারের জন্য এমন অসহায় চোখে যেন তাকিয়ে থাকতে না হয়। ছেলেটির জায়গায় আমি আমার নিজের বাচ্চাদের কল্পনা করলাম। আল্লাহ না করুণ, এমন একটা দৃশ্যে যদি আমার বাচ্চারা থাকতো, আর কেউ যদি ওদের জিলাপি না দিয়ে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতো, তাহলে সমাজের গায়ে যে অভিশাপ লেগে যেত, সেটা কিন্তু কোন কিছু দিয়েই দূর করা যেত না। এই অভিশাপ আমাদের সবার। এই অভিশাপ আমরাই লালন করেছি আমার লোভে। এই পরিস্থিতির জন্য আমরাই দায়ী। আমাদের বাচ্চাদের সামান্য একটা জিলাপির দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকতে হয় কেন?

 

 

এমন দুটা অসহায় চোখ একসময় আমারও ছিল। ক্ষুধা পেট নিয়ে সুপার শপে নানা রকমের খাবারের জিনিস হাতে নেড়েচেড়ে আবার রেখে দিতাম। এরপর কামরায় এসে খুচরা পয়সা গুলা গুনতে বসতাম। কত টাকা হলো? যা জমেছে, তা দিয়ে কি এক বেলার বাত তরকারী কিনে খেতে পারবো? পাউরুটি খেয়ে আর কতদিন? কবে আবার একটু ভাত খাবো? কই এতদিন হয়ে গেল, আমার বাবা মা কেউ তো ফোন দিয়ে একবার জিজ্ঞাসাও করলো না, কেমন আছি, কি খাচ্ছি?   

View shawon1982's Full Portfolio