ঘড়ি ছাড়া পরীক্ষা দেয়ার কথা আমি চিন্তা করতেই পারি না। পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে সেই ছোটবেলা থেকেই ঘড়ি ধরে লেখার অভ্যাস ছিল। সেই হিসাবে স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে সমস্ত পরীক্ষাতেই আমার হাতে একটা হাতঘড়ি অবশ্যই থাকতো। প্রশ্ন পড়ার পরে কয় মিনিট পার হয়েছে সেটা দেখে লেখা শুরু করতাম আর প্রতি প্রশ্নের উত্তর লেখার সাথে সাথে আবার ঘড়ির দিকে অটোমেটিক চোখ চলে যেত। এখনও কোন কাজে বাইরে বের হলে একটু একটু পরপর ঘড়ি দেখার অভ্যাস। পকেটে মোবাইল ফোন থাকুক আর যাই থাকুক না কেন, বাইরে বের হলে হাতে ঘড়ি পরতেই হবে। অভ্যাসটা এমনই হয়ে গেছে। সেই হিসাবে আমার নিজেকে এটা ভেবে সৌভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছে যে আমার প্রতিটি পরীক্ষায় আমি ঘড়ি সহকারে পরীক্ষা দিতে পেরেছি। আমাদের সময়ে কোন ভর্তি পরীক্ষাতেই ঘড়ির ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল না। কাজেই আমার কোন অসুবিধা হয়নি। কিন্তু বর্তমান সময়ে শুনছি এবং দেখছি কোন কোন পরীক্ষায় ঘড়ি পরতে দেয়া হচ্ছে না। আমি বুঝলাম ডিজিটাল বা স্মার্ট ওয়াচে উল্টা পালটা করার সুযোগ থাকে, কিন্তু একটা কাঁটা ঘড়ি পরলে সমস্যা কোথায়? কোন ঘড়িই নাকি করতে দেয়া হবে না। যাদের আমার মত একটু একটু পরপর ঘড়ির দিকে তাকানোর অভ্যাস, তাদের যে কি দুর্গতি হবে সেটা আল্লাহ ভাল জানেন। পরীক্ষার হলের দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকানোটাও আমার জন্য কিছুটা বিরক্তিকরই বটে। কারণ নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশে চোখ তো অভ্যস্ত হতেও সময় লাগে। যাই হোক, ঘড়ি নিতে না দেয়ার ব্যাপারটায় আমার মন সায় দেয় না। আমার মনে হয় এটা কোন নিয়ম হতে পারে না। স্মার্ট ওয়াচ বা ডিজিটাল গুলার ব্যাপারে আপত্তি গ্রহনযোগ্য হলেও কাঁটা ঘড়ি কি দোষ করে ফেললো সেটা আমার বোধগম্য নয়। একের দোষে গণহারে সবাই শাস্তি পাবার মত অবস্থা আর কি।
আজকেই সকালে ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখলাম। রাস্তার পাশে একটা ছোট কার্টে দেখলাম আটার রুটি বানিয়ে বিক্রি করছে। তা ভাবলাম বাসার সবাই আটার রুটি পছন্দ করে। কিছু কিনে যাই। পরাটা জিনিসটা আমি নিজেই তেমন পছন্দ করি না। আমার শুকনা আটার রুটি বা তন্দুর রুটিই পছন্দ। আমার রুটিগুলো যখন দোকানদার সেঁকে দিছিলো তখন দেখি ওখানে অনেক অল্পবয়সী ছেকে ফাইল হাতে, নানা রকমের নোট পড়ছে। হাতে নানা রকম কলম ভরা ফাইল। দেখেই বুঝতে পারলাম ওরা পরিক্ষার্থী।
একজনকে দেখলাম রচনা নিয়ে আলাপ করছে। পাশের জনকে বলছে, ভাই ৫০ টা রচনা মুখস্ত করেও লাভ কি? দেখবেন কমন পড়ে নাই। রচনা কমন পড়ার কোন গ্যারান্টি নেই! আমার বেশ হাসি পেল ওর কথা শুনে। এক ঝটকায় চলে গেলাম ২৮ বছর আগের আমার স্কুলের দিনগুলোতে যখন আমাদের কে জোর করে করে নানা রকমের রচনা গেলানো হত। গেলানো মানে মুখস্ত করানো হতো। শুধু রচনা কেন? নানা রকমের প্যাসেজ, ভাব সম্প্রসারণ, সারাংশ, ব্রড কোশ্চেন, ব্যাখ্যা এগুলোর উচ্চমার্গীয় নোট মুখস্ত করানো হতো এবং এগুলোর ব্যাপারে ব্যাপক ধড়পাকড় করা হতো।
আমি মুখস্ত নিয়তে বেশ আতঙ্কিত থাকতাম যদিও আমার মুখস্ত বিদ্যা ব্যাপারটা খারাপ না। যে কোন পরীক্ষার আগে আমার মা এসে নিয়মিত আমাকে জিজ্ঞাসা করতো, রচনা মুখস্ত হইসে? আমার জানামতে উনি এই প্রশ্নটাই আমাকে আমার শিক্ষা জীবনে সবচেয়ে বেশীবার করেছেন। প্রতিবার আমার উত্তর হতো, হ্যাঁ হইসে! কোন রচনা আর কি নিয়ে রচনা সেটা কোন ইস্যু না। রচনা মুখস্ত হইসে সেটাই বড় কথা। গরু থেকে শুরু করে village market কি কি সবই না আমাদের কে গিলতে বাধ্য করা হতো! অথচ, রচনা লেখা কত মজার একটা জিনিস! একজন কে কোন একটা বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে সে তো প্রবন্ধ বা রচনা তার বয়স আর শিক্ষা অনুযায়ী সুন্দর করেই লিখতে পারে। এজন্য তো অন্যের লেখা প্রবন্ধ মুখস্ত করা লাগে না। লাগে একটু পাঠাভ্যাস আর একটু চর্চা। এই যে আমি এখন আমার অভিজ্ঞতার কথা লিখছি, এটা কি কোন কিছু মুখস্ত করার পরিণাম নাকি আমার ভেতর থেকে উঠে আসা কথামালা? পাঠক মাত্রই বুঝতে পারছেন আমি কি বলতে চাইলাম।
আমি তখন একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম কি পরীক্ষা? আমাকে উত্তর দিলো BCS এর লিখিত পরীক্ষা। আজকে ইংলিশ হবে। আর পরীক্ষাটা হবে ২০০ মার্ক এর আর সময়সীমা ৪ ঘন্টা। আমি মোটামুটি ভিমরি খেলাম। ৪ ঘন্টার পরীক্ষা? আমি সর্বোচ্চ ৩ ঘন্টার পরীক্ষা দিয়েছি। তাতেই আমার দম বন্ধ হবার জোগাড় হত। এখন বিসিএস এ চার ঘন্টার পরীক্ষা? তার উপরে এমন বীভৎস প্রতিযোগিতা আর ফলাফলের এমন ভয়াবহ দুষ্প্রাপ্যতা? আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলাম যে আমার লেখা পরার ধারাবাহিকতায় আমাকে এই পরিস্থিতিতে যেতে হয়নি। নিজের লেখাপড়ার ব্যাপারে আমি কিছুটা একরোখাই ছিলাম। প্রতিষ্ঠান এবং সাবজেক্ট আমার একক সিদ্ধান্তেই আমি পড়েছি। এ ব্যাপারে অন্যের পরামর্শ শুনলেও কারও রক্তচক্ষুর পরওয়া করিনি। আর আমার সময়ে কেন জানি কখনই আমি “বিসিএস” জাতীয় কিছু শুনি নাই। আর শুনলেও কি জিনিসটা বুঝি নাই আর বোঝার চেষ্টাও করিনি। এখনও বোঝার চেষ্টা করছি না। আমি আদার ব্যাপারী তাই আদা নিয়েই থাকতে পছন্দ করি। এখন যদি কোন বিসিএস ধারী আমাকে বলেন ‘আঙ্গুর ফল টক’ লাগে বলে আমি এসব বলছি কারণ আমি তো বিসিএস ধারী নই, তাহলেও আমি নত মস্তকে স্বীকার করেই নেব, জ্বী আমার জন্য বিসিএস এর আঙ্গুর ফল টকই কারণ আমি এর যোগ্যই ছিলাম না কোনও কালে। যদি যোগ্য হতাম তাহলে আল্লাহ তো কোন না কোন ভাবে নিতেনই আমাকে। নিলেন না। কারণ সবার জন্য সব না। কারও কারও জন্য আঙ্গু রফলটা টক থাকাই তার জন্য মঙ্গলজনক। যারা যারা বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছে, সবার জন্য আমার মন থেকে শুভ কামনা রইলো।
শেষের আর একটু স্মৃতিচারণ করে নেই। আমি যার কাছ থেকে রুটি নিচ্ছিলাম, ওখানেই আরও দুটো বিসিএস পরীক্ষার্থী একটা টুলের উপরে বসে নাস্তা করছিল। আটার রুটি আর ছোলার ডাল ভাজি দিয়ে। আমার অনেক মায়া লাগছিলো ওদের দেখে। পরীক্ষা বলে কথা! যত যাই হোক না কেন, পরীক্ষার একটা টেনশন তো কাজ করেই। এর মধ্যে দোকানদার করে ফেললো আরেক কাজ। ডালের হাড়ির ঢাকনা উঠিয়ে ডাল নাড়াতে গিয়ে, বুঝতে পারেনি জোরে নাড়া দিয়েছিল আর তার ফলে ছলাক করে খানিকটা ডালের ঝোল পাশেই বসে খেতে থাকা বিসিএস পরীক্ষার্থীর সোয়েটারে লাগলো। আমি আঁতকে উঠলাম। গরম হাড়ির ঝোল! ছেলেটার আবার কিছু হলো না তো? ছেলেটা বেশ হাসিখুশি। এমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। প্রথমে টিস্যু দিয়ে মুছলো এরপর দোকানদারের একটা গামছা দিয়ে মুছে ফেললো। পরে আমার হাতে ঘড়ি পরা দেখে বললো, ভাই কত বাজে? আমি বললাম, ৯ টা ১০। আপনার কাছে ঘড়ি নেই? ছেলেটা হেসে দিয়ে বললো, আমাদের তো ঘড়ি নেয়া নিষেধ!
আমি মনে মনে বললাম আহারে! সেন্টার পড়েছে পাশেই স্কুলে। ততক্ষণে আমার অর্ডার দেয়া রুটি প্যাক করা হয়ে গেছে। দাম মিটিয়ে দিয়ে আমি ছেলেটার উদ্দেশ্যে বললাম, গুড লাক ভাই! ছেলেটাও আমার দিকে পালটা হাসি দিল। জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম ছেলেটি আর্টস নিয়ে লেখাপড়া করেছে। শুভ কামনা রইলো নাম না জানা বিসিএস পরীক্ষার্থী এই ছেলেটির জন্য। যার হাতে ঘড়ি না দেখে আমার এই লেখার অবতারণা করলাম।