শহুরে শীত আর গ্রাম্য শীতের পার্থক্য বেশ প্রকট। ঢাকা শহরে যারা বসবার করছেন, তারা হয়ত অনুভব করছনে যে শীত নামক কিছু একটা তাত্ত্বিক বা থিওরিটিক্যালি চলে এসেছে প্রকৃতিতে কিন্তু তার আবেশ এখনও পুরোপুরি পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, উত্তরবঙ্গে তো ইতিমধ্যেই ভালমাত্রার শীতে নেমে গেছে বলেই আমার ধারণা। সেই তুলনায় ঢাকার শীত বলতে গেলে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। প্রকৃতি অনেক রুক্ষ্ম হয়ে গেছে। সেটা অবশ্য নতুন কিছু না। আগে থেকেই ঢাকার প্রকৃতি বেশ বিরুপ হয়েই আছে। এটা আমাদের দোষেই হচ্ছে। সমস্ত গাছ কেটে আমরা বিল্ডিং উঠাবো, কলকারখানা বানাবো, পাকা রাস্তা করবো, ঘরে ঘরে এয়ার কন্ডিশনার লাগাবো, আবার চাইবো প্রকৃতি আমাদের উপরে সদয় থাকুক? এমনটা ভাবা আর দূরাশা একই জিনিস।
ন্যাচার বা প্রকৃতির কিছু কিছু ব্যাপার তো পুরা আমাদের মানুষের মতই। কেমন জানেন? একজন সহজ সরল মানুষের কথা চিন্তা করে দেখেন। প্রবাদের ভাষা মতে এমন একজন মানুষ যার কিনা ‘সাত চড়েও রা কাড়ে না’ টাইপ অবস্থা। এমন মানুষ কিন্তু সমাজের জিহ্বাধারী মানুষগুলোর কাছে অনেক পছন্দের। কারণ নরম টাইপের এই মানুষ গুলো আটার খামিরের মত। এদের ইচ্ছামত গালি দেয়া যায়, কথা শোনানো যায়, পিঠ পিছে কথা শোনালেও কিছু বলতে পারে না, এরা প্রতিবাদ করে না, এরা ঝামেলা এড়িয়ে চলে, এরা প্রতিশোধ নেয় না। ভাবদৃষ্টে কখনও কখনও মনে হয় এদের মনে হয় জিহ্বা বলেই কিছু নেই। সুকুমার রায়ের ছড়ার সেই সাপের মত। শিং নেই, নখ নেই, দাঁত নেই। ফোসফাস করে না, ঢুসঢাস দেয় না এমন। তবে নরম মনের মানুষগুলোর উপরে জিহ্বা ও দাঁতধারীরা নিয়মিত তাদের দন্ত্যসুখ আর মুখের সুখ নিতে অভ্যস্ত। এমন পেয়ে পেয়ে এরাও লাই পেয়ে গেছে। মনে করেছে নরম এই মানুষগুলোকে যা খুশি তাই বলে দেয়া যায়। এদের কে ইচ্ছামত ইনসাল্ট করো, সোশ্যাল মিডিয়াতে এদের নামে যা খুশি বলে হেয় কর, তুচ্ছ করো, অপমান করো, কোন অসুবিধা নেই।
আমরা আমাদের ধারণা এমনটাই বানিয়ে নিয়েছি। কিন্তু সবকিছুর একটা সীমা আছে। এ কথা সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অনেক সইতে সইতে এই নরম মনের মানুষগুলাও একসময় মুখ ফিরিয়ে নেয়। প্রতিবাদ করে। গর্জে ওঠে। শান্ত স্বভাবের মানুষগুলো যখন অশান্ত হয়ে যায়, তখন কিন্তু ঐ অগ্নিজিহ্বাধারীরা আর সামাল দিতে পারেন না। তখন কিন্তু সবই অন্যরকম হয়ে যায়। ঠিক তেমনি আমাদের শান্ত প্রকৃতিও তেমন প্রতিশোধ নেয়। অনেক সহ্য করে কিন্তু একসময় রুখে দাঁড়ায়। প্রকৃতি যখন আমাদের উপরে প্রতিশোধ নেয়া শুরু করে তখন আমরা সামাল দিতে পারি না। আমাদের ক্ষমতা আমাদের ‘জিহ্বার মধ্যে’ আর ‘ফেসবুকে জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস’ দেয়ার মধ্যেই সেঁধিয়ে যায়।
শীত যে আসছে সেটা আমি শহরে বসে খুব একটা টের পাই না। কারণ আমি মনে হয় শীত সহ্য করার অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছি। শীত আমাকে তেমন একটা কাবু কখনই করতে পারে না। বাংলাদেশের একবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রার মধ্যেও আমি আমার ভার্সিটির ক্যাম্পাসে অনেকগুলো অবাক চোখের সামনে শুধু হাওয়াই শার্ট আর গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার তেমন কিছুই হয়নি। শীতের প্রলেপটুকু গায়ে মেখে উপভোগ করতে জানি অনেক আগে থেকেই। কিন্তু এবারের কথা যদি বলি, শীতের এই সময়েও বাইরে বের হলে গরমের প্রলেপ মেখেই বের হতে হচ্ছে। বাইরে বের হলে এখনও গরমে হাঁসফাঁস লাগে। হাঁটাহাঁটি করলেই ঘেমে নেয়ে উঠছি। সন্ধ্যা এমনকি রাতেও দেখা যাচ্ছে ঘরে ফ্যান চালাতে হচ্ছে। ফ্যান না দিলে বাচ্চারা গরমে ঘুমাতে পারছে না। এই হলো ঢাকার বর্তমানের শীতের অবস্থা।
তবে শীতকাল যে চলছে, সেটা আমি বুঝি আমার ফাটা ঠোঁট দেখে। ঠোঁটের চামড়া উঠে চৌচির হয়ে গেলে আমি বুঝি শীত এসেছে শহরে। তখন ঠোঁটে নিয়মিত পেট্রোলিয়াম জেলী জাতীয় কিছু দিয়ে রাখতে হয়। এই হলো আমার শীত উদযাপন। শীতের কাপড় সব বের করা আছে। চাদর, মাফলার, হুডি, জ্যাকেট সবই আছে। ওসব পরে কেউ যখন বাইরে বের হয় তখন আমি তৃষ্ণার্ত চোখে তাকায়ে দেখি কারণ ওগুলো পরার মত শীত ঢাকার কোথায়? আমার কাছে আর কি! একটা লেদার জ্যাকেটের প্রতি আমার আগ্রহ অনেক কাল থেকেই আছে। কিন্তু সেই শখ পূরণ হবে কি করে? লেদার জ্যাকেট পরার মত শীত কি ঢাকায় আসে কখনও? ঢাকার শীত মানেই হল ঠোঁটে একটু “লিপ-চ্যাপ” লাগানো শীত।
রাজধানীর রাস্তার আরও একটা জিনিস আমার বেশ ভাল লাগে। তা হল রাস্তায় বসা হকার্স মার্কেট গুলো। রাস্তা জুড়ে, ফুটপাথ দখন করে কত রকমের জিনিসের পশরা বসিয়ে হকাররা বসে। কিছু করার তো নেই। এদের মেনে নিয়েই রাস্তা দিয়ে চলতে হচ্ছে। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় আমি এসব ভাল করে লক্ষ্য করি। অনেক সস্তায় এখানে জিনিস বিক্রি হয়। উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত কেউই বাদ যায় না। আমি সব ধরনের মানুষের আনাগোনা দেখেছি এখানে। এখানে সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জিনিস পত্র দেখে। যা দাম চাওয়া হয় তার থেকেও অবিশ্বাস্য কম বলে দামাদামি শুরু হয়। হকার্স মার্কেটগুলোর প্রধান ক্রেতা হল বর্তমানের যুব সমাজ। বিশেষ করে ছাত্ররা। ওরা ওদের শখের বা পছন্দের জিনিসগুলো কিছুটা কমের মধ্যে এখানে পেয়ে যায়। মার্কেট বিল্ডিং এর ভেতর থেকে ওই জিনিস কিনতে গেলে হয়ত দাম বেশী পড়ে যায়। ছেলেপেলেগুলো এটা ওটা কেনে এরপর হাসিমুখে চলে যায়। কেউ কেউ নিরাসক্ত থাকে। আমার দেখতে ভাল লাগে। সবচেয়ে ভাল লাগে ঈদের আগে। পিঠে ব্যাগপ্যাক ঝুলিয়ে আমি অনেক ছাত্রকে দেখেছি প্যান্ট শার্ট এটা ওটা কিনছে। কেউ কেউ শার্ট ট্রায়াল দিচ্ছে রাস্তার উপরেই। এরপর কেনা হয়ে গেলে সেটা ব্যাগে ঢুকিয়ে চলে যাচ্ছে গাবতলীর দিকে। মনে মনে হয়ত ভাবছে ঈদের দিন এটা পরে একটা সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড দিবে! মনে মনে কত স্বপ্ন। স্বপ্ন নিয়েই তো বেঁচে থাকি আমরা। বেঁচে থাকুক আমাদের এই প্রজন্ম। ওরা আনন্দ নিয়ে বড় হোক। ওদের স্বপ্নগুলো সাকার হোক।