‘জ্বালামুখ’ কি জিনিস সে সম্পর্কে জেনেছিলাম স্কুলে পড়ার দিনগুলোতেই। পৃথিবীর অভ্যন্তরের অতি উত্তপ্ত গলিত লাভা আগ্নেয়গিরির যে অংশ দিয়ে বেরিয়ে আসে বাইরে তাকেই মূলত জ্বালামুখ বলে। বর্তমানের প্রযুক্তির যুগে ইউটিউবের সুবাদে অনেক জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আর জ্বালামুখের ভিডিও দেখে ফেললাম। ব্যাপারটা কত ভয়াবহ হতে পারে সেটা ভিডিও দেখে আমার মনে হয় না। আরও ভয়াবহ জিনিস দেখলাম গতকাল। সেটা হল ইউটিউবে রিলাক্সিং মিউজিক বলে কিছু লম্বা লম্বা ভিডিও আছে। যেগুলা মাঝে মাঝে গল্প উপন্যাস পড়ার সময় আমিও ছেড়ে দিয়ে রাখি। টুংটাং হালকা মিউজিকের সাথে সাথে পড়ি। ভালই লাগে। কারণ আমি আবার একদম চুপচাপ লেখাপড়া করতে পারি না। আমার কিছু না কিছু শব্দ লাগে আশেপাশে। গতকালের সেই রিলাক্সিং ভিডিও তে দেখলাম একটা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি থেকে লাভা বেরিয়ে সে নদীর স্রোতের মত গলিত আগুন প্রবাহিত হচ্ছে। প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে সেই ভিডিওর সাথে মিউজিক দিয়ে রিলাক্সিং ভিডিও বানানো হয়েছে। মানুষ সমুদ্র, ঝর্ণা, ফুল, পাখি এসব দেখে রিল্যাক্স করতে পারে সেটা হতেই পারে, কিন্তু আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত দেখেও কেউ আমোদিত হতে পারে ঘন্টাখানেক ধরে সেটা গতকালই প্রথম জানলাম। জানার তো শেষ নেই আসলে।
জ্বালামুখ নিয়ে আসল কথায় এখনও আসিনি। অনেক কিছুই বলার আছে। সেগুলোতে পরে আসছি। একবার গ্রামে গিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ‘মহানাম যজ্ঞ’ অনুষ্ঠান দেখেছিলাম কিছুটা। ‘যজ্ঞ’ আসলে কি আমার ঠিকঠাক ধারণা ছিল না। কীর্তণ শুনছিলাম, এমন সময় একজন এসে বললো, যজ্ঞ দেখেছেন? আমি বললাম আমি তো চিনি না! উনি তখন আমাকে বললেন আসুন দেখবেন। আমাকে লাল কাপড় দিয়ে ঘেরা একটা অংশে নিয়ে গেল। বললেন এই যে দেখুন! আমি দেখলাম মাটিতে একটু গর্ত করা সেখানে কয়লা বা তেমন কিছু দিয়ে খানিকটা আগুন জ্বালানো আছে। ছোটখাট একটা মাটির চুলার মত! উনি আমাকে বললেন, এই নামগান চলবে চব্বিশ প্রহর (৭২ ঘন্টা একটানা), ততক্ষণ এই আগুনও জ্বালানো থাকবে। এটাই হল সেই যজ্ঞ!
পরবর্তীতে পূজার অন্যতম আনুসঙ্গ হিসেবে দেখেছিলাম যে যজ্ঞে আহুতি দেয়া হয়। অর্থাৎ বিভিন্ন জিনিস নিবেদন করা হয় একের পর এক। আর আগুন তার স্বভাবানুসারে সবকিছু জ্বালিয়ে মুহুর্তে ছাই করে দেয়। এটাই যজ্ঞাহুতি, যা পূজার একটা অন্যতম অনুসঙ্গ এবং এর সাথে ধর্মীয় বিশ্বাস তো আছেই। জ্বালামুখ গুলার ভিডিও দেখলেও ঠিক তেমন কিছু যজ্ঞ বলেই মনে হয়। যেগুলো পৃথিবী তার আপন খেয়ালে কখনও কখনও জ্বালিয়ে দেয়। তবে পৃথিবীর যজ্ঞে কোন আহুতি দেয়া হয় না। কে দেবে সেখানে আহুতি? এত বড় যজ্ঞের সামনে আমাদের আয়োজন সবই যে বড় ক্ষুদ্র বলে মনে হয়। পৃথিবী কারও আহুতি চায়ও না। দরকার নেই যে। কবিগুরুর একটা গানের কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে-
‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’
ছোটবেলায় পড়া জ্বালামুখ এর বাস্তব রূপ এখন প্রতিনিয়তই দেখি। এই জ্বালামুখ হচ্ছে আমাদের আশেপাশের কিছু মানুষ। কেউ কেউ আমাদের অতি নিকটেই থাকে। পৃথিবীর মতই এদের ভেতরটাও অতি উত্তপ্ত লাভা দিয়ে ভর্তি। এদের মুখটাই হচ্ছে সেই ভয়াবহ জ্বালামুখ। এরা সময়ে সময়ে সেখানে থেকে লাভা নির্গমন করবে। পৃথিবী থেকে যখন লাভা বেরিয়ে আসে, তখন মানুষের নিরাপদ দূরত্বে সরে যাবার সুযোগ থাকে। কিন্তু জ্বালামুখী মানুষের মুখ দিয়ে যে লাভা বেরিয়ে আসে, তা থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই। সামনে না থাকলেও অন্যের কাছে গিয়ে লাভা এমনভাবে উগরে দিয়ে আসবে যে আপনি যেখানেই থাকুক না কেন, সেই লাভার আঁচ ঠিকই আপনার আদ্যোপান্ত জ্বালিয়ে দেবে। সেটা না পারলে সোশ্যাল মিডিয়া আছে। সেখানেও আপনাকে ভস্ম করে ফেলার আরও মহাস্ত্র মহাযজ্ঞ আছে। সেখানে অন্যদের কে দর্শক বানিয়ে আপনাকে যজ্ঞাহুতি দেয়া হবে। অন্যরা মজা নিবে আর আপনি জ্বালামুখীর অনলে আহুতি হবেন। দূরে গিয়েও নিষ্কৃতি পাবেন না কিছুই। জ্বালামুখী মানুষগুলো কিছুতেই ছাড়ে না। এদের কাজই হলো সবকিছু জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়া।
আপনার ভাল থাকা এদের ভাল লাগে না, এদের জন্য কিছু করলেও ওদের ভাল লাগে না। ওরা কিছু মনে রাখে না। আর রাখবেই বা কিভাবে? আপনি জ্বলন্ত আগুনের উপরে কাগজের কয়েকটা টুকরা রেখে যদি বলেন, কিছুক্ষণ রাখো, আমি এসে আবার নিয়ে যাচ্ছি, তো কেমন হবে? আগুন ফেরত দেবে আপনাকে সেই জিনিস? ছাইটুকুও তো রাখে না পারলে। ঠিক তেমনি জ্বালামুখী মানুষগুলোর সামনে যদি নিজের স্বর্বস্বও দিয়ে দেন, কোন লাভ নেই। মুহূর্তেই সব শেষ হয়ে যাবে। পূজায় যজ্ঞাহুতি দিয়ে সত্যিকারের ইশ্বরকে খুশি করা যায় কিনা সেটা বিশ্বাসের ব্যাপার। কিন্তু মানুষরূপী জ্বালামুখী ইশ্বরগুলাকে আপনি কোন যজ্ঞাহুতি দিয়েই সন্তুষ্ট করতে পারবেন না। এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়।
এবার অন্য কিছু প্রসঙ্গে আসি। আমার নিজের জীবনের কিছু কথা। ভ্রমন করতে আমার সবসময়ই ভাল লাগে। আর সেটা যদি অন্য দেশে হয়, তাহলে আনন্দের মাত্রা কত বেশী হতে পারে তা বলাই বাহুল্য! আমার প্রবাসের দিনগুলোতে একবার সুযোগ এসেছিল আমেরিকাতে একতা সেমিনারে যাবার। আমার ডক্টরাল থিসিসের অনুসঙ্গ হিসেবে সেই সেমিনার। তখন তো বয়স কেবল ২৮ বছর। তখনকার দিনের সেই মনের উত্তেজনা, নতুন দেশ ঘোরার উন্মাদনা বর্তমানের সাথে কখনই তুলনীয় নয়। অল্পবয়সে যে সব জিনিসের জন মন উতলা হয়ে থাকে, সেগুলোই এই চল্লিশের দ্বারপ্রান্তে এসে খুব হাস্যকর বলে মনে হয়। এখন যদি আমি কোন দেশ ভ্রমনের কথা শুনে বাচ্চাদের মত লাফালাফি করতে থাকি, সেটা নিশ্চই আরও অনেক বেশী হাস্যকর হবে। অন্যদের কাছে যেমন তেমন আমার নিজের কাছেই হাস্যকর লাগবে। বয়সের সাথে সাথেই আমাদের চাহিদা, রুচি আর মানসিকতার অনেক পরিবর্তন হয়ে যায়।
যা বলছিলাম! আমেরিকা সেমিনার করতে যাবো মনে মনে ভেবেই আমি আর আমার স্ত্রী অনেকটাই উত্তেজনা বোধ করছিলাম। কারণ ঐ দেশে কিছু আত্মীয়স্বজনও থাকে। সুযোগ থাকলে তাদের সাথেও দেখা করা যেত। আমাদের সেইসব দিনগুলোতে আমেরিকার ভিসা পাওয়া অনেক সুবিধাজনক ছিল এবং মোটামুটি জানতাম যে আমার ভার্সিটির কাগজপত্র দিয়ে অ্যাপ্লাই করলেই আমরা ভিসা পেয়ে যাবো। ঘোরাও হল আবার সেমিনারও হয়ে গেল। সেই সাথে আমেরিকা দেখাও হয়ে গেল।
সে সময়ের পরে এক যুগ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে আমার। আমেরিকা যাওয়া আজও হয়নি। এখনও সেই সুযোগ আর আসেনি। আর এখন মনে হচ্ছে সেই বয়সও কিছুটা চলে এসেছে যখন ১২ বছর আগের উত্তেজনার কথা মনে পড়লে হাসিই আসে। এখন তো মাঝে মাঝে একটু রেস্ট নিতে পারলে আর মাঝে মাঝে একটু ঘর থেকে বের হতে পারলেই অনেক বেশী উত্তেজনা বোধ করি। ২৮ বছর বয়সের সেই আমেরিকা যাবার উন্মাতাল উন্মাদনা এখন এই প্রায় চল্লিশের প্রান্তে এসে, ঘরের চৌহদ্দি পেরনোর উন্মাদনার কাছে পরাস্ত হয়ে গেল।
আমেরিকা যাবো বা যেতে পারি বললেই তো হবে না; তার জন্য চাই বিপুল পরিমাণ টাকা। দুইজনের খরচ তো বহন করতে হবে। এজন্য তো বললেই যাওয়া যায় না। দীর্ঘদিন ধরে টাকা জমানোর একটা ব্যাপারতো থেকেই যায়। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে টাকা জমানো শুরু করেছিলাম। কতদিন জমাতে পেরেছিলাম জানেন? মাত্র দুই মাস! অতি অল্প হয়ে গেল তাই না? হ্যাঁ আমার তো ঠিকই মনে আছে। মাত্র দুই মাস। জানুয়ারী আর ফেব্রুয়ারী! ব্যাস এই দুই মাস। এরপর কি হল জানেন? জ্বালামুখী জ্বলে উঠলো। আমার জন্য যজ্ঞ সাজানো হলো। যজ্ঞে আহুতি দিতে হবে। এই পূজার যজ্ঞে একটাই নুসঙ্গ। সেটি হল টাকা! বাংলাদেশী টাকায় হোক আর সিঙ্গাপুরী ডলারে হোক, শুধু নোটগুলো একের পর এক আগুনে ছুড়ে দিতে হবে। এটাই হল এই পূজার যজ্ঞ। পূরাজী তৈরি, যজ্ঞ জ্বালানো হয়ে গেছে। এবার শুরু হলো আহুতির পালা। আমি বাধ্য হলাম জ্বালামুখী এক ইশ্বরকে বাধ্যতামূলক সন্তুষ্ট করার জন্য যজ্ঞে বসতে। শুরু হলো আহুতি দেবার পালা। একের পর এক আমার দেয়া আহুতি জ্বালামুখের আগুন গ্রাস করে নিলো।
আমি সেই যজ্ঞাহুতির পাশে পাশে আমার স্বপ্নেরও আহুতি দিয়ে দিলাম। প্রভু সন্তুষ্ট হলেন। আমাকে বর দিলেন এবং সর্বজনবিদিত ভাবে প্রচার করে দিলেন- “আমি কখনই কিছুই দেই নাই”।