আজকে মনে হচ্ছে নিজের কিছু প্যাঁচাল পাড়ি। সেই সাথে কিছু ভাললাগা আর কিছু মন্দলাগার কথাও থাকলো না হয়। সকাল বেলায় উঠেই দেখলাম কম্পিউটার বিকল হয়ে বসে আছে। পাওয়ার বাটন দাবায়ে দিলে ঘ্যাস ঘ্যাস শব্দ করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কাজ হচ্ছে না। অথচ গতরাত ৩ টা পর্যন্ত কাজ করলাম। এমন সমস্যা আগেও একবার হয়েছিল। মনটা হতাশায় ছেয়ে গেল। এখন এমন অবস্থা হয়ে গেছে যে কম্পিউটার ছাড়া নিজেকে অচলই লাগে। ‘অচল মুদ্রা’ না কিন্তু! কারণ অচল মূদ্রাও নিলামে ওঠে আর অনেক সময় লাখ লাখ টাকায় বিক্রিও হতে পারে। তবে পার্থক্য হলো, অচল মূদ্রা বিকোয়, অচল মানুষ না। এই আর কি!
বিকালের মধ্যে কম্পিউটার সারিয়ে আনলাম। এনেই এই লেখা লিখতে বসলাম। লেখার প্রবল ইচ্ছা জন্মেছিল সকাল বেলাতেই কিন্তু সকালে তো আর লেখা হলো না। কম্পিউটারে টাইপ করতে করতে অভ্যাস এমন হয়ে গেছে যে এখন আর কাগজ কলমে লেখাই হয়ে ওঠে না। কলম দিয়ে দুই লাইন লিখতে গেলেই ব্যথায় হাত টনটন করতে থাকে। হাতে লেখার অভ্যাস নষ্ট হয়ে গেছে। তবে টাইপ করে যত লিখতে ইচ্ছা করে বা লেখা যায় ততটা কি হাতে লিখতে পারতাম? আমার আগের দিনের ঐপন্যাসিকদের কথা মনে হয়। বিমল মিত্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এদের তো অনেক বড় বড় উপন্যাস আছে। এত বড় বড় উপন্যাস উনারা কিভাবে হাতে লিখে ফেললেন সেটা ভাবলেও অবাক লাগে। কতখানিক ধৈর্য আর নিষ্ঠা থাকলে এটা সম্ভব হতে পারে! এই মানুষগুলো আমার মনে সবসময় শ্রদ্ধার আসনেই আসীন থাকবেন।
গতকাল রাতে শেলফ থেকে পুরানো কিছু বই বের করে খাটে স্তুপ করে রেখে দিলাম। রাতে শোবার সময় ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসলেও ঘুমাই না। আগে স্তুপ থেকে একটা একটা বই বের করে পড়তে থাকি। এরপর যখন দেখি আর পারছি না, তখনই শুধু ঘুমাই। গত কয়েকদিন ধরে এমনটাই করছি আমি আমার সাথে। সেই সুবাদে অনেক পুরানো একটা বই হাতে উঠে এলো। সমরেশ মজুমদার এর ছোট দুইটি উপন্যাসের একটা সংকলন যেটা ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাদেশের “আর ইসলাম” প্রকাশনী থেকে। নাম ‘অহঙ্কার’। এই বইটি আমি কিনেছিলাম ফুটপাথের উপর থেকে। অনেক পুরানো বই। মলাটের কোনায় পোকামাকড় মনে হয় খাদ্যবস্তু মনে করে কিছুটা খেয়েও ফেলেছে। তবুও আমার কাছে বই তো বইই! নতুন হোক আর পুরানো হোক! পড়া গেলেই হলো। তাও যদি প্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদারের কোন বই হয় তো কথাই নেই। কোন রকম বিবেচনা না করেই শুধু নামের উপরেই আমি কিনে নিয়ে আসবো এরপর বুভুক্ষের মত পড়তে থাকবো।
পুরানো বইয়ের একটা বিশেষ মজা আছে। দেখা যায় এই বইগুলো অনেক আগে কারও ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল অথবা কেউ কাউকে অনেক আগ্রহ করে উপহার দিয়েছিল। এরপর যে বইগুলোর ভাগ্যে কি জুটেছিল সেই ইতিহাস আর কেউ মনে রাখে না। যেভাবেই হোক বইগুলোর স্থান হয় ফুটপাথের বই ব্যবসায়ীদের কাছে। এরপর অবিশ্বাস্য কম দামে বিকিয়ে যায় কোন না কোন পাঠকের হাতে। অনেক পুরানো বই আমি এমন পেয়েছি, যেগুলোর শুরুর খালি পাতায় অনেক সুন্দর সুন্দর শুভেচ্ছা বাণী দেয়া থাকে। লেখা থাকে অনেক আবেগ মিশ্রিত চিঠি কিংবা কবিতা। যেগুলো পড়লে আমার নিজের কাছেই ভীষণ ভাল লাগে। আর মনে হয়, আহারে! কে জানি কাকে কত আগ্রহ করে দিয়েছিল বইটি। মনের কত আবেগ মিশিয়ে লিখেছিল কথাগুলো। সেগুলো এখন ভাগ্যচক্রে আমার কাছে এসে পৌঁছেছে।
গতকাল আমার হাতে উঠে আসা ‘অহঙ্কার’ বইটাতে আমি পেয়ে গেলাম এমন সুন্দর একটা কিছু। একটা কবিতা। ১৯৯৬ সালের ১লা জানুয়ারীতে জনৈক ‘শওকত’ নামের এক ব্যক্তি তাঁর ‘লিপি খালা’কে ইংরেজী নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বইটি উপহার দিয়েছিক। ফাউন্টেন পেন দিয়ে কালো রঙের কালিতে সুন্দর করে লিখেছে এই কবিতা যা পড়েই আমার মনে হয়েছে, এটা আমার বৃশ্চিক অভিধানে থাকা উচিত। আমি তুলে দিচ্ছি ‘শওকত’ সাহেবের লেখা সেই কবিতাটি। উল্লেখ্য যে, আমি ঐ কবিতার কোন বানানের রদবদল করিনি। যেভাবে ছিল সেভাবেই টাইপ করে তুলে দিলাম-
“
ডায়েরির প্রথম পাথায়
চেনা কোন হাতের ছোঁয়ায়-
লিখা এক গান,
না কোন অভিমান ।।
দেখেছিলাম যাকে-
ধলেশ্বরী তীরে – সবুজের ভীড়ে
হয়ত সে নয়, হয়ত অন্য কেউ
অন্য কোন নাম।
ছবি হয়ে ভাসে, কিংবা
সত্যি জানিলাম।।
কচুরিপানার মত ভেসে
কোথা হতে কোথা –
কত স্মৃতি কথা !
পুরনো পৃথিবীর – পুরনো ব্যথা।।
নতুন দিনের আলো – মুছে ফেলে সব,
সেই চেনা গান-
সেই অভিমান, আর
স্বপ্নের পৃথিবীর হয় অবসান ।।।
শুভেচ্ছান্তে
শওকত
০১.০১.১৯৯৬ ইং ”