সন্তানের এপিটাফ

আমি আমার নিজের লেখাগুলো খুব একটা পড়ি না। আমার সন্তানের মতই আমার লেখাগুলো প্রিয়। কিন্তু আমি মনে হয় বাবা হিসেবে ভীষণ খারাপ। আমার সন্তানদের আমি কোন চর্চা করি না। সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকমত করি না। নিতান্ত অবহেলায় ওরা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। অনাদরে অবহেলায় ওরাও একসময় আমার স্মৃতি থেকে বিস্মৃতিতে রূপান্তরিত হয়। ভুলে যাই। কখনও যদি সেই অন্ধ ঘরে উঁকি দেই তখন সেখানে বিরাজ করে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। কেউ সাড়া দেয় না। ওরা সবাই অনাদরে আর অবহেলায় মনে হয় আজ মৃত। কেউ জানে না ওদের কথা। ওরাও মনে হয় রাগে ঘৃণায় আমাকে ভুলে গেছে। 


মাঝে মাঝে সৃষ্টিকর্তাকে বলি, প্রভু আমি প্রতিদিন সন্তান চাই। কিন্তু প্রতিদিন সন্তান পাই না। মাঝে মাঝে চাইতেও ভুলে যাই। সেটাও ভুলে যাই যে চাইতে ভুলে গিয়েছি প্রভুর কাছে। কালে ভদ্রে মনে পড়ে। তিনি দয়া করে দেন মাঝে মাঝে। নেই নিজের হাতে তুলে। পরক্ষণেই সেগুলোকে দাফন করে দিয়ে আসি সেই অন্ধকার কবরস্থানে। কেউ জানে না সেগুলোর হদিস। মাঝে মাঝে আমি যাই। দেখে আসি আমার মৃত সন্তানগুলোর এপিটাফ। কাউকে নাম দিতে পেরেছি, কাউকে পারিনি। নাম থাকুক বা নাই থাকুক, আমার সন্তান তো বটে!   


ওরা কারো কাছে স্বীকৃতি পেল না। না ঘরে না বাইরে! আমিও মনে হয় পারলাম না ওদের আলোর মুখ দেখাতে। তোমার সেই ‘নিয়নের আলোর নদী’তে ওদের নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। মনে হয় ওদের সাথে আমিও একটু অবগাহন করে আসি। কোন এক নির্জন রাতে বেরিয়ে পড়ি সেই নদীর সন্ধানে। যে রাতের নির্জনে হয়ত ভ্রষ্টাচারিতার আদান প্রদান হবে, কিন্তু কোন ভালবাসার গুঞ্জন সেখানে থাকবে না। মানুষ যেখানে মানুষের খোলসের আড়ালের ইতিবৃত্ত রচনায় সদা তৎপর, সেখানে ভালবাসার অবস্থান কোথায়? ভালবাসার কোন জায়গা নেই। কোথাও নেই। ঘরে নেই বাইরে নেই। সব কিছুই আমার কাছে অলীক মনে হয়। 


ভালবাসার কথা মনে হলেই আমি আকাশের কাছে আশ্রয় খুঁজি। আমার মনে হয় আকাশ আমাকে বলতে থাকে, এখনও সময় হয়নি। আরেকটু অপেক্ষা কর। আমি অপেক্ষা করি। মাঝে মাঝে মনে পড়ে আমার প্রবাস জীবনের টুকরো টুকরো কত কথা! সেখানে আমি দেখেছিলাম সেই নিয়ন আলোর নদীর সন্ধান। একবার না বহুবার। পেটে যখন ক্ষুধা থাকে, তখন অন্ধকারে স্বর্ণের টুকরোকেও খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। আমারো করেছিল। কত কিছু মনে হয়েছিল। একবার পিছিয়ে গিয়েছি ত আবার সামনে এগিয়ে গেছি। নিজের মত করে। সেখানেও আমার কিছু সন্তান এসেছিল। আমি ওদের কে অনেক অবহেলা করেছি। ওরা কি এখনও আমাকে অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে? আমি জানি না। যদি অভিশাপ নাই দেবে, তাহলে এখন কেন ওদের দেখা পাই না সহসা? কেন তাহলে ওদের প্রকাশে আমার চিরচেনা ঘর মিথ্যে হয়ে গেল। সব হিসেব মেলে না। মেলার দরকার নেই। জীবনের অঙ্কের সমাধান সবার ভাগ্যে সয় না। আমারো সয়নি। আমি নতুন হিসেবের খাতা খুলে নিয়ে বসেছি। ‘শুভ হালখাতা’ কি হল তবে? কাকে কাকে আমি নিমন্ত্রণ জানাবো? কার কাছে আমার দেনা পাওনা বাকী আছে? আমি দরজায় খটখট শব্ধ শুনতে পাচ্ছি! ওরা কি তবে জীবন ফিরে পেয়েছে?

Author's Notes/Comments: 

২৯ জুলাই ২০২০ তে ফেসবুকে প্রকাশিত

View shawon1982's Full Portfolio