অবশ এক রজনীর কথা

গতকাল নতুন কিছু অভিজ্ঞতা হয়ে গেল। দুপুর বেলা থেকেই কিছু একটা শোনার পরে থেকেই মনে হলো আমার মন এটা মেনে নিতে পারছে না। কিছুই না। খুবই সাধারণ কিছু। পাত্তা দেয়ার মত না। কিন্তু আমার মন যেখানে অনেক কিছুতেই অযথা লজিক খুঁজে বেড়ায়, সে লজিক খুজতে গেল। কিছু লজিক মন তার নিজের মত করে দাঁড় করিয়ে ফেললো। আমি টের পাচ্ছিলাম। গতকাল এই মজার জিনিসটা খেয়াল করলাম যে, মনের উপরে লাগাম দিতে চাইলেও সব সময় লাগাম দেয়া যায় না। আমার মনের ভেতরে কাল যে অনুভুতি গুলো হচ্ছিলো, তার প্রভাব আমি শরীরে টের পাচ্ছিলাম কিন্তু কিছু করতে পারছিলাম না।

 

সকাল থেকে টেপ্র পাচ্ছিলাম হাত পা কেমন যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছে। ভাবলাম দুপুরে একটু ঘুমাই, ঠিক হয়ে যাবে। ঘুম এলো না। শুয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। প্রিয় কোন বেতার নাটক শুনতে চেষ্টা করলাম। দেখলাম কোন কথাই কানের ভেতরে যাচ্ছে না। তার মানে আমার কানও আমার পছন্দের শব্দ গ্রহন করতে পারছে না। আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলাম। ভাবলাম বিকালে ভাল হয়ে যায় কি না! ভুল ভেবেছিলাম। সন্ধ্যার দিকে প্রভাবটা বেড়ে গেল। দুই একজন এর সাথে আলাপ করলাম। কি করলে আমার এই খারাপ লাগা কমতে পারে। ওরা কিছু পরামর্শ দিলো। মানতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু খারাপ লাগার অনুভুতি তাড়াতে পারলাম না। একটু পরে দেখি সত্যিই আমার পা কেমন যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। এরপর হাত।

 

আর বসে থাকতে পারলাম না। গিয়ে শুয়ে পড়লাম। নাঈমা অতি উতসাহী হয়ে ওর ছোট ভাই কে ডেকে আনলো। সে তার বাসার হ্যান্ড-কিটস গুলো এনে আমার প্রেসার, সুগার সব মেপে দেখলো। কোনটাই সমস্যা নেই। সব কিছুই তো মিটারে নরমাল শো করছে। তবুও হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে! ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং! সব দোষ গিয়ে পড়লো আমার ঘুমের উপরে। রাতে আমার ঘুম কম হইসে! আমার ঘুম কি বুঝলো জানি না, আমার পা অবশ ভাব একটু হলেও বেড়ে গেলো। কারণ আমি মনের ভেতরে শুরু হওয়া ক্ষতগুলো সারাতে পারছিলাম না।

 

একটু পরে এক ডাক্তারের পরামর্শে জীবনের প্রথম ঘুমের ওষুধ খেলাম। জীবনে এই প্রথম। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুম! নতুন অভিজ্ঞতা হলো। রোবটের মত আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু কাজ করতে হলো। যা কখনও করি না, সেগুলা করতে হলো। আমি করলাম আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। নাঈমাকে খুশি করতেই করলাম এগুলো। আমি ইচ্ছা করলে নাও করতে পারতাম। করলাম শুধু নাঈমাকে খুশি করতে। কারণ নাঈমা আমার বাইরের কষ্টগুলো দেখে বিচলিত হয়ে যাচ্ছে। ভেতরের দহন দেখতে পাচ্ছে না। ওর কথামত গরম পানি দিয়ে গোসল করলাম। এতে কি হল জানি না, তবুও করলাম। আমি পূর্ণ শীতেও কখনও গরম পানি দিয়ে গোসল করি না। আমার ভাল লাগে না। কাল করলাম। শেষ কবে গরম পানি দিয়ে গোসল করেছিলাম জানি না। ভাল লাগেনি আমার একটুও।

 

এখানেই শেষ না। আমাকে এক গ্লাস গরম গরুর দুধ খেতে হল। দুধ যে অপছন্দ করি না তা। অন্য সময় হলে আমি এই দুধের মধ্যে এক চামুচ কফি মিশায়ে নিতাম। চিনি খাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছি। সুগার মাপার জন্য রক্ত বনের করতে আমার আঙ্গুলে যখন সুই ফোটালো, তখন একটা চিনচিনে অনুভুতি হচ্ছিলো। সুইয়ের খোচার ব্যাথা টের পেলাম তবুও মনে হচ্ছিলো হাতে পায়ের বল নেই। সুগার লেভেল আসলো ৬.১। আহামরি কি? মনে আশা ছিল, চিনির মাত্রা খুব একটা আশার কথা তো নয়। চিনি খাওয়া বাদ দিয়েছি। কার্বোহাইড্রেট ও কমিয়ে দিয়েছি। যা খুশি হোক। হাত, পায়ের যা খুশি যেদিকে খুশি যাক! কতক্ষণ আর নিয়ন্ত্রণ করবো।

 

ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিলাম। ছোট ভাই মইনকে জানালাম। জীবনের প্রথম ঘুমের ওষুধ খাচ্ছি ভাই। ও জিজ্ঞাসা করলো, একটাই খাইসেন তো ভাই? আমি বিললাম ভয় পেও না। আমি মরবো না। মরার জন্য ওষুধ খাচ্ছি না। মাত্র একটাই খাইসি। দেখি ঘুম আসে কি না। আমি জানতাম আমি শুয়ে পড়লেই ঘুম আসবে। তবুও ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিলাম। কেন নিলাম? আমার আশে পাশের মানুষগুলোকে খুশী করতে। ওরা নিশ্চিন্ত থাকুক, আমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছি। প্রচন্ড জ্বরেও আমি যেখানে প্যারাসিটামল খাই না, সেখানে আমার অবশ হাত পায়ের ‘বশ’ ফেরাতে আমাকে ঘুমের ওষুধ খেতে হল। খেলাম! 

 

একটু পরে ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্ন দেখলাম না। সাধারণ ভাবে ঘুমালে হয়ত দেখতাম। তবে আমি স্বপ্ন একটু কমই দেখি। যা দেখি আমার সবই প্রায় মনে থাকে। ঘুমের ওষুধ কি আমার স্বপ্নের নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নিয়েছিল নাকি? আচ্ছা, এমন কোন ওষুধ নেই, যা মন থেকে মনের দূরত্ব কমিয়ে দেবে? দুটো স্কিউড লাইনকে কাছে আনার চেষ্টা করে দেবে? মনের ভেতরে যে সব যন্ত্রণা একটু একটু শেষ করে দেয় সেগুলো কমিয়ে আনবে? হাত পা অবশ করে না দিয়ে, যন্ত্রণাগুলো একটু কমিয়ে আনবে? আছে কি এমন কিছু?

 

নতুন আশা ভরসা নিয়ে সকাল ঘুম থেকে উঠলাম। ওষুধ না খেলেও এই সময়েই উঠতাম। ঘুমের এখন আর কোন রেশ টের পাচ্ছি না। আমাকে তীব্র ভাবে টানছে একটা বই। একটা বই পড়তে হবে। হাত পা অসাড় হয়ে গেলেও আমাকে একটা বই পড়তে হবে। আমার নিজেকে ভুলে থাকতে হবে। নিজেকে অন্য এক জগতে নিয়ে যেতে হবে। আমাকে কিছুক্ষণের জন্য পালাতে হবে। কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে ভাল থাকার অভিনয় করতে হবে। সবাইকে জানাতে হবে, আমি ভাল আছি। আমার হাত পা নাড়তে পারছি। আমি এখনও প্যারালাইজড হয়ে যাইনি। আমার ভাল থাকায় কি কারো কিছু যায় আসবে? আগে হয়তো অনেক কিছু যায় আসতো। এখন চাইছি মনটাও প্যারালাইজড হয়ে যাক। আমার অতি প্রিয় কাছের ভালবাসার মানুষগুলো আমার বাহ্যিক অভিনয় দেখবে। আমার মন পুড়ে যাওয়া দেখবে না। আর দেখবে কেন? মন পুড়ে যাওয়া যদি দেখতে পেতো তাহলে নিজেরাই বুঝতো, মনটা প্রতিনিয়ত তারাই পুড়িয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে জ্বালানী দিতে। আমার অতীত নয়, আমার বর্তমানই আমাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে।    

Author's Notes/Comments: 

২১ জুন ২০২১

View shawon1982's Full Portfolio