রেডিও তে নাটক শোনার অভ্যাস আমার অনেক আগের দিনের। পার্থক্য হলো এখন আর রেডিও আলাদা করে ঘরে থাকা লাগে না। ইউটিউবে সার্চ দিলেই অনেক অনেক বেতার নাটক পেয়ে যাই। বেতার নাটক শুনতে শুনতে কাহিনীর দৃশ্যায়ন কল্পনা করে নেয়া আমার অনেক প্রিয় একটা শখ। সেই সুত্র ধরে ‘অডিও’ বই শোনার অভ্যাস ও করে ফেলেছি। যখন বই পড়তে ইচ্ছা করে না, বা একটু শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে তখনও আমি হয়তো হেডফোন দিয়ে কোন না কোন বই পাঠ, গল্প পাঠ এসব শুনছি। আমার মনোযোগ কতখানিক ছিল সেটিও পরীক্ষা করে দেখেছি। শোনা বইটা আবার হার্ড কপিতে বা সফট কপিতে ডাউনলোড করে র্যান্ডম নানা পাতা উলটে দেখেছি যে লাইনগুলো পরিচিত লাগছে কিনা! আমি নিরাশ হইনি। কাজেই আমার জন্য মনোযোগ দিয়ে বই পাঠ শোনা আর নিজে বই পড়া অনেকটা একই রকম। অবশ্য পাঠকের ধরণ ভেদে ব্যাপারটার অনুভুতি অন্যরকমও হতে পারে।
কিছুদিন আগে কল্লোল নামের এক তরুণের কন্ঠে পাঠ শুনলাম ২০২১ এর বইমেলায় প্রকাশিত নতুন বই, মোহাম্মদ সাইফের লেখা, নাম ‘তার চোখে মেঘ ছিল, জল ছিল না’। লেখক বেশ মজা করেই বইটা লিখেছেন। এমনভাবে বইটি লেখা, এবং কল্লোলের পাঠ এতটাই সুন্দর ছিল যে পুরো বইটা শুনে ফেলতে আমার একটুও খারাপ লাগেনি। বরং চারটি অডিও ক্লিপে পাঠ করা পুরো গল্পটাই আমি অনেক মন দিয়ে শুনেছি। বেশ ভাল লেগেছে। বইটি শোনার এক পর্যায়ে আমি জনপ্রিয় ভারতীয় অভিনেতা সঞ্জীব কুমার এবং অভিনেত্রী সুলক্ষণা পন্ডিত সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে পারি। পরে আমি ইন্টারনেট ঘেটে, বইতে বলা কথাগুলোর সত্যতা যাচাই করেছি এবং চমৎকৃত হয়েছি। ফিল্ম জগতের তারকাদের জীবন নিয়ে খুব একটা ঘাটাঘাটি করি না। কিন্তু পছন্দের তারকা হলে, কিছু না কিছু জানতে ইচ্ছে করেই। সঞ্জীব কুমার আর সুলক্ষণা পন্ডিতের যে কথাগুলো জানতে পেরেছি, সেগুলো ইতিপূর্বে আমার জানা ছিল না।
সঞ্জীব কুমার মাত্র ৪৭ বয়সে হার্ট অ্যাটাক করে মারা জান। উনি চিরকুমার ছিলেন। বইয়ের ভাষ্য অনুসারে, উনার বিশ্বাস ছিল উনি বেশীদিন বাঁচবেন না। এজন্য উনি বিয়ে থা করেন নি। উনার সমসাময়িক ডাকসাইটে অভিনেত্রী সুলক্ষণা পন্ডিত তাকে ভালবেসে ফেলেন এবং বিয়ের প্রস্তাব দেন। সঞ্জীব কুমার সুলক্ষণা’র প্রস্তাবকে ফিরিয়ে দেন। উনার একসাথে কয়েকটি ফিল্ম এ একত্রে কাজ করলেও আর বিয়ে থা করেন নি। সঞ্জীব কুমারের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে, সুলক্ষণা পন্ডিতও সারা জীবন কুমারী থাকার সিদ্ধান নেন এবং সিদ্ধান্তে বহাল থাকেন। সঞ্জীব কুমার ১৯৮৫ সালে মারা গেছেন। সুলক্ষণা পন্ডিত এখনও বেঁচে আছেন। সুলক্ষণা পন্ডিতের পরিবারের প্রায় সবাইই সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পী। দুই ভাই যতীন পন্ডিত আর ললিত পন্ডিত ‘যতীন-ললিত’ নামের প্রোথিতযশা সুরকার। বোন বিজেতা পন্ডিত নিজেও একজন অভিনেত্রী ও সঙ্গীত শিল্পী। সঙ্গীতে অনন্য কৃতিত্বের জন্য সুলক্ষণা পন্ডিত ‘ফিল্মফেয়ার’ পুরষ্কারেও ভূষিত হন।
উনাদের জীবনী তো ইন্টারনেট ঘাটলে কতই পাওয়া যাবে। আমার আগ্রহ লেগেছে ভালবাসা বা প্রেমের মূল্যায়নকে। সুলক্ষণা তার ভালবাসাকে এতখানিক দাম দিয়েছিলেন যে, সেই ভালবাসার স্থানে উনি সঞ্জীবকে ছাড়া আর কাউকে মেনে নিতে পারেননি। এমন ঘটনা কিন্তু আমাদের সমাজে যে খুব অপ্রতুল আমি সেটা অবশ্যই বলবো না। এমন ঘটনা অনেকেই ঘটিয়েছেন। কিন্তু সেসব কথা তো আর কোথাও তেমন লেখা হয় না। সঞ্জীব আর সুলক্ষণা নামকরা তারকা শিল্পী ছিলেন, তাই তাদের কথা সহজে মানুষ জেনে ফেলেছে এবং কেউ কেউ যতই কুৎসা রটনা করুন না কেন, কেউ কেউ অবশ্যই চমৎকৃত হয়েছে, যেমন আমি! আমার ভাল লেগেছে সুলক্ষণার আত্মত্যাগ টুকু! সারাজীবন কুমারী থাকা তার কাছে সহজ ছিল তথাপি ভালবাসার মানুষের জায়গায় অন্য কাউকে বসান নি। ভালবাসা পরিবর্তন করেননি। নতুন করে ভালবাসতে চাননি! উনি ভাল করেছেন না মন্দ করেছেন, সেই বিচারের ভার আমার মত নগন্য মানুষের নয়। এজন্য উনার কুমারী থাকার সিদ্ধান্তকে আমি কোন মানদন্ডেই মাপতে যাবো না। তবুও বলি, উনার এই ত্যাগ আমার ভাল লেগেছে। আমি বুঝতে পেরেছি, মানুষ চাইলেও এমন একাকীত্ব স্বেচ্ছায় বরণ করে নিতেও পারে।
আমাদের আশেপাশের নানা রকম সম্পর্কগুলো নানা ধরনের ভালবাসার গন্ডি দিয়ে ঘেরা থাকে। ভালবাসা না থাকলে কিন্তু কোন সম্পর্কই টেকে না। এক বন্ধুর সাথে আরেক বন্ধুর যে টান সেটাও ভালবাসা! ভাইয়ের জন্য বোনের যে দরদ, সেটাও ভালবাসা! সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের নির্ঘুম রাত কাটানো, সেটাও ভালবাসা। প্রেমিকার জন্য প্রেমিকের সময়জ্ঞান লোপ পাওয়া, সেটিও কিন্তু ভালবাসা! আমাদের এক জীবনে আমাদের এমন বহুমাত্রিক ভালবাসার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। আদর্শ ভাল মানুষ মনে হয় সেই যে এই সবগুলো ভালবাসাকে সুন্দর একটা সমন্বয় করে চলতে পারে। কাজটা কিন্তু সহজ নয়। তবে অসম্ভব অসাধ্যও কিছু নয়।
আমি কিন্তু সবাইকে সমান খুশী করতে বলিনি! আমি বলেছি শুধু ব্যক্তি বিশেষের নিজের অবস্থান থেকে, সবগুলো সম্পর্ককে যার যার অবস্থানে রেখে মূল্যায়ন করা। কোন সম্পর্কের মোহে বেশী জড়িয়ে বাকী সম্পর্কের সুতোগুলো ছিঁড়ে ফেলা নয়। অথচ নিজের চোখেই এমন অনেক কিছুই দেখেছি। দুই একটি সম্পর্কের মোহে এমনভাবে কেউ কেউ নিজেকে মিশিয়ে ফেলে, যার ফলশ্রুতিতে অন্য সম্পর্কগুলো সম্পূর্ণ নষ্ট করে দিতেও অনেকে ডানে বায়ে চায় না। তাতে সম্পর্কের অন্যপাশে থাকা মানুষটার যত কষ্টই হোক না কেন।
নিজের চোখে যদি না দেখতাম তাহলে হয়ত আজকের লেখার এই অবতারণা করতামই না। সব মানুষকে এক পাল্লায় বিবেচনা করার মত অবিবেচক আমি নই কখনই। তবে নিজের চোখে উদাহরণও কম দেখিনি। ভুক্তভোগী নিজেও হয়েছি অনেকবার। নতুন নতুন প্রেমিকা যখন জুটে গেছে তখন বন্ধুর দরকার ফুরিয়ে গেছে। ভাইয়ের স্নেহ মততা ধুলিস্মাৎ হয়ে গেছে। আগে যেই সম্পর্কগুলো নতুন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা দিত, নতুন নতুন স্বপ্ন দেখাতো, সেখানে নতুন আমদানী হওয়া ‘প্রেমিকা’র প্রেম এত গভীরে নিয়ে যায় কিছু ছেলেকে (হয়ত মেয়েদেরও) যে, সেই নতুন প্রেমের জোয়ারে আগের সব সম্পর্ক বাতাসে উড়ে যায়। ভুক্তভোগী না হলেও বলতাম, আমি এমন সম্পর্কের অবমূল্যায়ন যারা করে, সম্পর্কের মূল্য যারা দিতে জানে না, তাদের মানসিক বৈকল্যে আমার করুনা হয়, আমার ঘৃণা হয়।
আমি নিজেও জানি কারণটা কি! তারা কেন এমন করে! আমি যাদের কে আমার সমমনা মনে করেছি, তাদের কারও কারও সাথে আমি বিষয়টা নিয়ে আলাপ করেছি। কেন প্রেমিকা’র প্রেম পেয়ে গেলে কিছু কিছু ছেলে অন্য সব সম্পর্ককে এমন ধুলায় মিটিয়ে দেয়? আমি যে সব উত্তরগুলো পেয়েছি, সেগুলো আমার ধারণার সাথে সম্পূর্ণ মিলে গেছে। আমি যদি এখন সেগুলো লিখতে চাই, তাহলে আমাকে এমন কিছু কঠিন ভাষা প্রয়োগ করতে হবে যার কারণে হয়ত মনটা আবার বিষিয়ে উঠবে। সেটা আর চাচ্ছি না। কিছু কিছু তিক্ত ব্যাখ্যা, যা শুধু আমার একার নয়, এখন আর লিখতে চাই না। তোলা থাকুক। পরে যদি কখনও আবার ইচ্ছে হয় লিখবো।