বাচ্চাদের ভেতর সুখস্মৃতি তৈরী করা

কিছুদিন আগে একজন সাইকোলজিস্ট এর সাথে আমরা একান্তে আলাপ হল। উনার সাথে অনেক অনেক কথা প্রসঙ্গে অবধারিত ভাবে আমার দুই বাচ্চার ব্যাপারে আলাপ করলাম। বাচ্চাদের সাথে আমাদের ‘মেন্টাল বন্ডিং’ বা ‘মানসিক বন্ধন’ তথা সখ্যতা কি করে আরো সুদৃঢ় করা যায় এসব নিয়ে আমরা কিছুক্ষণ আলাপ করেছি। আমাদের আলাপ চারিতায় উঠে এসেছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা। ঐ ভাই আমাকে আর আমার স্ত্রীকে কাগজে ছক করে চারটি সময়ের কথা উল্লেখ করে বললেন, এই চার সময়ে আপনারা স্বামী স্ত্রী দুইজন ভাগ করে নিবেন। এই চার সময়ে বাচ্চাদের সাথে কিছু কাজ করতে হবে। এর দ্বারা ওদের মধ্যে বাবা-মা সম্পর্কে খুব সুন্দর কিছু ‘মেমোরি’ বা স্মৃতি তৈরী হবে এবং এর ফলে সন্তানের সাথে বাবা-মায়ের মানসিক বন্ধন আরো দৃঢ় হয়।

 

এই চারটি কাজ বাবা-মা কে ভাগাভাগি কিরে করতে হবে। এমন নয় যে শুধু মা একা করবেন। ব্যাপারটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। বাবা যদি প্রবাসে থাকে, তাহলে মায়ের পাশাপাশি, পরিবারের সিনিয়র কাউকে এই কাজগুলো গুরুত্বের সাথে করা উচিত। এর ফলে আশা করা যায়, বাচ্চার মনে ওই মানুষগুলো সম্পর্কে সারাজীবন ভাল ধারণা তৈরী হবে। আমি ঐ চারটি সময় এবং কাজগুলো উল্লেখ করতে চেষ্টা করছি। প্রতিটি কাজে ১০ থেকে ১৫ মিনিট ব্যয় করাই যথেষ্ট। সন্তানের জন্য এইটুকুই তো করাই যায়। নয় কি?

 

১। ঘুম থেকে ওঠানোর সময়ঃ


এই ব্যাপারটা বেশী করে খেয়াল রাখতে হবে যেসব বাচ্চাকে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠিয়ে স্কুলে নিয়ে যেতে হয় তাদের ক্ষেত্রে। যেহেতু বাচ্চাকে স্কুলে যেতেই হয় প্রায় প্রতিদিন, এবং অনেক বাচ্চাই ঘুম থেকে উঠতে গড়িমসি করতে থাকে। অনেক মা’কেই দেখেছি কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে এরপর ধৈর্য হারিয়ে বকাবকি করে ফেলেন। নিজেকে এই ব্যাপারে সংযত করতে হবে। হাতে অন্তত ১০ মিনিট সময় নিয়ে ঘুমন্ত বাচ্চার পাশে বসে, কিছু আদুরে কথা বলা উচিত। এরপর বাচ্চাকে একটু একটু আলতো করে ছুঁয়ে ডাকা, কপালে চোখে একটু একটু আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে ডাকা। দরকার হলে একটু সুড়ডুড়ি দিয়ে বাচ্চাকে হাসানো যেতে পারে। এভাবে একটু একটু করে বাচ্চার ঘুমের রেশ কাটানো উচিত। এতে করে বাচ্চা প্রফুল্ল মনে ঘুম থেকে উঠবে এবং পরবর্তী কাজের জন্য মন থেকে তৈরী হবে।

 

২। স্কুল থেকে ফেরার পরেঃ


এই সময়টা বাচ্চার স্কুলের খোজ খবর নেয়া প্রসন্ন মনে। ওর বন্ধুদের খোঁজ খবর নেয়া। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে আলাপ চারিতা যেন ইন্টারভিউ এর মত না হয়ে যায় অর্থাৎ এমন না হয় যে শুধু বাবা মা এক তরফা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। প্রথম প্রথম হয়ত বাচ্চা অনেক কিছুই বলতে চাইবে বা। সেক্ষেত্রে বাবা-মা নিজের সারাদিন কিভাবে গেল সেটা গল্পের ছলে, মজা করে বাচ্চাকে বলবে। বাবা তার অফিসের কিছু গল্প করতে পারে। পুরো গল্প কথা এমন ভাবে বাচ্চাকে বলা যেন বাচ্চা বুঝে নেয়, বাবা বা মা তার নিজের কথা অনেক গুরুত্ব দিয়ে বাচ্চাকে বলছে। শুধু বাচ্চাকে এক তরফা প্রশ্ন করে যাওয়া নয়। বরং নিজের কথাগুলো বাচ্চার সাথে শেয়ার করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর দেখা যাবে, বাচ্চা নিজে থেকেই তার স্কুলের কথা, বন্ধুদের কথা বাবা-মা কে বলা শুরু করেছে জড়তা ছাড়াই। ইন্ট্রোভার্ট বা মুখচোরা বাচ্চাদের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া উচিত। বাবা-মা কে যেন সে অন্তত বন্ধু মনে করতে পারে।

 

৩। বিকাল বেলাঃ


এই সময় বাচ্চাকে একটু গুরুত্বের সাথে সময় দেয়া দরকার। বাচ্চাকে নিয়ে ছাদে হাঁটতে যাওয়া যেতে পারে। বাসার নিচে কিছুক্ষণ ঘোরা যেতে পারে, যদি বাইরে যাওয়া সম্ভব না হয়। বাচ্চার সাথে টুকটাক খেলাধুলা করা, বাচ্চাকে নানা রকমের হাতের কাজ শেখানো যেতে পারে। হাতে কলমে শিখানো যাকে বলে। যে সব বাচ্চারা খেলতে পছন্দ করে, তাদের খেলার সুযোগ করে দেয়া। কিন্তু সেটা অবশ্যই বাবা মায়ের নজরের আড়ালে নয়। খেয়াল রাখতে হবে আমরা উঠতি বয়সের বাচ্চাদের নিয়ে আলাপ করছি। বাচ্চাদের বাইরে থেকে খেলনা কিনে তো দেয়া যেতেই পারে। কিন্তু আমরা যদি বাসায় থাকা নানা রকম অকেজো জিনিস দিয়ে খেলার সামগ্রী বানানো শেখাতে পারি, এই ব্যাপারে যদি উৎসাহিত করতে পারি, এটা বাচ্চাদের মেধা বিকাশে অনেক সহায়ক ভুমিকা রাখতে পারে। এই কাজগুলো ওদের কে প্র্যাকটিক্যাল ভাবে কিছু করার জন্য অনুপ্রেরণা যোগাবে।

 

৪। ঘুমের সময়ঃ


এই সময় বাচ্চার সাথে কিছুটা আদর করে, মাথার চুলে হাত বুলিয়ে নানা রকমের গল্প করা যেতে পারে। বাচ্চাদের মধ্যে ধর্মীয় উদ্দীপনা জাগানোর জন্য ওদের সাথে ধর্মীয় কিছু আলাপ, স্রষ্টার মহাত্ম্য, নানা রকম দোয়া কালাম, এগুলো শেখানো যেতে পারে। রেগুলার এই কাজটা করলে দেখা যাবে, শুধু ঘুমের এই সময়টাকে উপজীব্য করে বাচ্চারা অনেক কিছু শুখে ফেলেছে। আর শিখতে শিখতে আপনার হাতের উপরেই বাচ্চা আপনার সম্পর্কে ভাল ধারণা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে।

 

এগুলো অতি সাধারণ কথা মনে হলেও এর গুরুত্ব কিন্তু সাধারণ নয়, বরং অসাধারণ। এই কাজগুলো আমরা নিয়মিত করতে বাচ্চাদের মনে আমাদের সম্পর্কে সুন্দর ধারণা তৈরী হবে বলে আশা করা যায়। বাবা মা দুইজনকেই গুরুত্ব দিয়ে কাজগুলো করে যেতে হবে। এসব কথা বলে, সাইকোলজিস্ট আমাকেই সরাসরি প্রশ্নটা করলেন, আপনি আপনার নিজের জীবনের কথা স্মরণ করে দেখুন তো, এমন কোন সুখের স্মৃতি মনে করতে পারেন কিনা? আপনার স্কুলের দিনগুলোতে? আমি কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে নেতিবাচক উত্তর দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় দেখলাম না। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা কে আর নিয়মের আওতায় ফেলা যায় না। তখন উনি বললেন, তাহলে চিন্তা করে দেখুন, আপরানা কি চান না, বড় হয়ে আপনাদের বাচ্চারা বলুক, আমাকে আমার মা এভাবে ঘুম পাড়াতো, আমার বাবা আমার সাথে এভাবে খেলতো? আমি বললাম, অবশ্যই চাই। আমাদের বাচ্চারা সুন্দর স্মৃতি নিয়ে বড় হোক, আর নিজের মন থেকেই বাবা মা কে শ্রদ্ধা করতে শিখুক, ভালবাসতে শিখুক, এটাই চাই। 

Author's Notes/Comments: 

১০ জুন ২০২১ 

View shawon1982's Full Portfolio