জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা ভালভাবে হচ্ছে টিকে থাকা। জীবন একটা প্রবাহিত নদীর মত। নদী যেমন বয়ে চলে একটা নির্দিষ্ট গন্তব্যে, ঠিক তেমনি আমদের জীবনও কিন্তু বয়ে চলে যাচ্ছে। শেষ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক অধ্যায়ের। Rheological Science এ একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে, Everything Flows অর্থাৎ সবকিছু হয়ে চলে। আমার যতদূর মনে পড়ে আমি একটা সেমিনারে শুনেছিলাম এই কথা। সবকিছু যেমন বয়ে চলে, তাহলে জীবন কেন নয়? জীবনও বয়ে চলে। আমি কিছু করলেও চলে যাবে, কিছু না করলেও চলে যাবে। এখানে জীবনকে সময়ের সাথে রুপকার্থে তুলনা করা যেতেই পারে।
জীবনে কঠিন সময় আসে। আসবেই। এটাই নিয়ম। এখন যেমন আমরা সবাই এক কঠিন সময় অতিক্রম করছি। এখন এই আবদ্ধ অবস্থায় আমাদের অনেক রকম পরীক্ষার মধ্যে দিয়েই যেতে হচ্ছে। তার মধ্যে সর্বাধিক যে পরীক্ষা চলেছে, তা মনে হয় ধৈর্যের পরীক্ষা। গরম ঠান্ডা আবহাওয়া এগুলো তো সাময়িক। আসে যায়। কিন্তু ধৈর্যের পরীক্ষা যখন আসে, তখন তো আবহাওয়া দেখে আসবে না। যে কোন সময়, যে কোন পরিস্থিতে চলে আসতে পারে। সকালের ভাল পরিস্থিতি সন্ধ্যাতে আমূল পালটে যেতে পারে। আমরা আমাদের অদূর ভবিষ্যৎ পরিণতিই কিছু জানি না। তবুও মানুষ ভাবে। ভাবতে হয়। জীবনের প্রয়োজনে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে আমাদের ভাবতে হয়। আর ভাবতে পারি বলেই মনে হয় আমরা মানুষ! নানা রকম প্রতিকূলতার মধ্যেই আমাদের বাঁচতে হবে, বাঁচতে শিখতে হবে। যদি এই লড়াইয়ে আমরা হেরে যাই, তাহলে জীবনের প্রয়োজনে যেসব স্বপ্ন আমরা বুনে রেখেছি, সেগুলো তো নিস্ফল হয়ে যাবে। সেগুলোকে ধৈর্য ধরে সাকার করাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
কিছু কিছু গাছ লতিয়ে লতিয়ে চলে। লাউ, কুমড়া, করলা, পুঁইশাক এগুলো আমরা সবাই চিনি। গাছগুলো আমাদের এতটাই উপকারী যে এদের পাতা, কান্ড, ফল সহ সবটাই আমরা খেয়ে ফেলতে পারি। এরা বেয়ে বেয়ে চলে। এদের চলার পথে এরা অবলম্বন খোঁজে। আমরা অনেকেই মাচা তৈরী করে দেই। মাচা বেয়ে এরা ওঠে। ওদের বিস্তার ঘটে। গ্রামেও দেখেছি, শহরেও দেখেছি অনেকে বারান্দাতেও শখ করে এসব গাছ লাগায়। অনেক বেশী যত্ন এদের লাগে না। কিছুতা অনাদর অবহেলাতেও বেড়ে উঠতে পারে এরা। হাতের ধারে শক্ত যা কিছু পায়, তাই অবলম্বন করে উপরের দিকে উঠতে চায়। এসব গাছকে বাড়তে দিলে এরা এদের জিবনের সর্বস্ব দিয়ে হলেও আমাদের উপকার করেই যায়। ওদের কাছ থেকেও শেখার অনেক কিছু আছে বৈকি! মাচা তুলে দিতে না পারলেও অনেক সময় শুকনা ডাল মাটিতে পুতে দেই আমরা। যেন ওরা একটু অবলম্বন পায়। বেড়ে উঠতে পারে। গাছগুলো যখন বেড়ে ওঠে, তখন কি ওরা সেই চিন্তা করে বেড়ে ওঠে, যে ডাল বেয়ে বেড়ে উঠছে, সেটা আসলে মৃত? মৃত জিনিজের মূল্য তো জীবিতর চেয়ে বেশী হতে পারে না। গাছটা কিন্তু সেটা বোঝে না। সে বোঝে শুধু একটু অবলম্বন। কারণ তাকে এগিয়ে যেতে হবে।
ইতিহাস আমাদের অবলম্বনের মত। সব ইতিহাস আমাদের ইতিবাচক জিনিষের ইঙ্গিত দেয় না। নেতিবাচক অনেক ইতিহাসও আমাদের জানতে হয়, শিখতে হয়, পরীক্ষার খাতায় লিখতে হয়। সেই নেতিবাচক ইতিহাসও আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়। নেতিবাচক ইতিহাস তুলে ধরার অর্থ ঋণাত্মক মন মানসিকতার বিকাশ নয়। বরং এই নেতিবাচক দিকগুলো যেন আমাদের সামনে আর না আসে। নেতিবাচক ইতিহাসের পুনরাবৃত্ত যেন আমাদের সামনে না হয়। আমাদের ইতিহাস জানতে হয়। কারণ ইতিহাসের সাথে আমাদের শেকড়ের সম্পর্ক। আমাদের বাঁচার অবলম্বন। আমাদের পুর্বসূরীদের নেতিবাচক উপাখ্যানও আমাদের জানতে হয়, শিখতে হয়, যেন ভবিষ্যতে সেগুলো থেকে বেঁচে থাকা যায়। একজন মানুষ যে তার কথায় নেতিবাচক দিক তুলে ধরেছে, তার মানে কিন্তু এটা নয় যে নেতিবাচকতা ছড়াতে চাইছে। বরং সে চাইছে তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে যেন সে এবং তার আশে পাশের মানুষ ভাল থাকে। আমি কোন রাস্তায় চলে এসে যদি বিপদে পড়ি, তাহলে আমি যদি আগে ভাগেই আমার শুভার্থীদের জানিয়ে দেই, ভাই ও পথে চলো না, বিপদ হতে পারে! তাহলে কিন্তু তার উপকারই হলো। একজনের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা অন্যজনের জন্য ইতিবাচক হয়। সুবিবেচক মানুষ কখনও নেতিবাচকতার মধ্যে নতুন করে নেতিবাচকতা খুঁজবে না। যদি সেটাই হয়, তাহলে আর শিক্ষা দীক্ষার মূল্য রইলো কোথায়?