লেখার ক্যাপশনটা দিতে গিয়ে আমাকে অনেক্ষণ চিন্তা করতে হয়েছে। ক্যাপশনটা কি ঠিক লিখলাম কি না? এ যুগের ছেলে মেয়েরা নানা রকম ‘সুপার হিরো’র সাথে পরিচিত। টিভিতে, মুভিতে, কার্টুনে, মার্ভেল কমিক্সে এরা এসব হিরোদের নানা কর্মকান্ড দেখে। স্পাইডারম্যাম, আয়রনম্যান, ক্যাপ্টেন অ্যামেরিকা এমন আরও কত কি, বলে শেষ করা যায় না! আমি নিজেও জানি না এমন আরও কত কিছু আছে! কিন্তু আমার ছয় বছরের মেয়েটা আর দেড় বছরের ছেলেটা যখন কোন কিছুর দরকায় হয়, তখন যখন ছুটে এসে বলতে থাকে, ‘বাবা! বাবা’, এটা দাও ওটা দাও, তখন আমি মুচকি হেসে ওদের কথা শুনি। বুঝি, সারাদিন মায়ের কাছে থাকলেও বিশেষ কিছু আবদার ওরা ওদের বাবা’র জন্যই জমিয়ে রাখে। কারণ বাবা হচ্ছে ওদের সেই ‘সুপার হিরো’ যার কাছে সেসব বায়না করা চলে যেগুলো মা কে বলে খুব একটা লাভ হয় না!
কিছুদিন আগেই আমার শ্রদ্ধেয় এক আঙ্কেল আমাকে শিখিয়েন এক চরম সত্য কথা। বাচ্চারা ছোটবেলা থেকেই ওদের বাবাকে অনুসরণ করতে শেখে। বাবা কি বলে, বাবা কিভাবে চলে, বাবা কি খায় সবকিছু! এজন্য একজন বাবা’কেই এত সতর্ক ভাবে সন্তানের সাথে কথা বলা উচিত যেন সন্তান সেখান থেকে সুশিক্ষা পায়। বাচ্চাদের মন একদম সাদা কাগজের মতই থাকে। আর আমাদের করা প্রতিটা আচরণ কলমের আঁচড়ের মত। খেয়াল করে দেখেছেন আমি কিন্তু পেন্সিল বলিনি! পেন্সিলের দাগ তো ছোট একটা রাবারের টুকরা বা ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলা যায়। কলমের দাগ মুছে ফেলার চেষ্টা করলেও কাগজের উপরে স্থায়ী ক্ষত তৈরী হয়ে যায়। বাচ্চাদের সাথে আমাদের করা প্রতিটা আচরণ কিন্তু এমনই। আমরা যা করবো বা বলবো, ওদের মনের মধ্যে বসে যাবে। আর বসে যায় বলেই, এখনও আমরা স্মৃতিচারণ করতে বসলে নিজেদের শৈশবের ‘নেচিবাচক’ কথাগুলো কিন্তু প্রায় হুবহুই মনে করতে পারি। ইতি বাচক জিনিসের চেয়ে মানুষের অবচেতন মন কিন্তু ‘নেতিবাচক’ কথাগুলোই বেশী মনে রাখে। এজন্য একজন বাবা হিসেবে, আমাকে সবচেয়ে বেশী সতর্ক থাকতে হবে, আমি আমার সন্তানের সামনে কিভাবে নিজেকে উপস্থাপন করছি সেটা। আমার সেই শ্রদ্ধেও আঙ্কেল আমাকে এটাও বলেছেন, সন্তানকে যতই অন্য মানুষের ভাল কাজের উদাহরণ দেয়া হোক না কেন, প্রথমে সে বাবা হিসেবে আমাকেই অনুসরণ করবে। এজন্য আমার নিজের চরিত্র এবং ব্যবহার এমনটাই হওয়া চাই, যেমনটা স্বয়ং বাবা হিসেবে আমি আমার সন্তানের কাছ থেকে আশা করি। আমি আমার বাচ্চার সাথে শৈশবে যেমন আচরণ করবো, ওরা কিন্তু সেগুলোই শিখে নিবে। আমি যদি আমার সন্তানকে ‘সন্তান’ হিসেবেই আদর সোহাগ করি, শুধু ভাল ছাত্র নয় বরং ভাল মানুষ তৈরী করার চেষ্টা করি, তাহলে আশা করা যায় আমাদের পরবর্তী জীবনে ওরাও আমাদের সাথে সুন্দর আচরণ করবে।
রমাপদ চৌধুরীর লেখা ‘ছাদ’ উপন্যাসটা’র অডিও শুনেছিলাম। আপনারা ইচ্ছা করলে পড়েও দেখতে পারেন। ওখানে লেখা একটা উক্তি কানে ভেসে আসে প্রায়শই। কথাটা অনেকটা এমন,-‘আমি আমার সন্তানকে ইন্সুরেন্স মনে করি না’! কথাটার মর্মার্থ অনেক গভীরে। আমাদের সন্তান আসলে আমাদের সন্তানই! ইন্সুরেন্স, ডিপোজিট কিংবা ভবিষ্যতের এ.টি.এম ম্যাশিন না। আমরা এখন যারা বাবা মা হয়েছি, তারা যদি আমাদের শৈশবের কথা একটু চিন্তা করে দেখি, অনেকেই হয়ত একমত হবেন যে, আমাদের সাথে আমাদের পিতা’র দূরত্ব কতখানিক ছিল। আদৌ আমাদের পিতারা কি আমাদের সাথে বন্ধুর মত আচরণ করতেন? পিতা’র শাসন নিঃসন্দেহে থাকতেই হবে। পিতাকে সন্তান কিছুটা ভয়মাখা সমীহ করবে সেটাও স্বাভাবিক। কিন্তু মানসিক দূরত্ব? সেটা কি আমাদের সময়কার পিতারা কমাতে পেরেছিলেন?
আমার শৈশবেতো মনে পড়ে, গল্পের বই পড়তে থাকলে কিংবা গান শুনতে থাকলে, বাবা আসার শব্দ টের পেলেই টপাটপ সব লুকিয়ে ফেলতাম কিংবা বন্ধ করে দিতাম। বাবা ঘরে আসলে অনেকটাই নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছি কেউ কেউ! কিন্তু এখন আমার নিজের জীবনের পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা! আমি ঘরে আসলে আমার বাচ্চাদুইটা ‘বাবা’ ‘বাবা’ বলতে বলতে শোরগোল করতে আমার কাছে ছুটে আসে। কে প্রথমে আমাকে দেখবে সেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। মাঝে মাঝে আমি আমরা বাচ্চার সাথে ‘টানগ্রাম’ নিয়ে খেলতে বসি! কালার কম্বিনেশন গেম খেলার সময় আমার মেয়ে আমাকে বলে দিতে থাকে, বাবা এটার সাথে ওটা মিলবে! আমি আমার মেয়েকে নিয়ে, ওর উপযোগী অ্যানিমেশন কার্টুন দেখতে বসি। কিছুদিন আগেই নেটফ্লিক্স এ দেখলাম Klaus মুভিটা! সিনেমাটার আবেগঘন দৃশ্য দেখে আমার মেয়েটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছিলো। আমার সাথে পরে সে আলাপ করেছে মুভির নানা রকম ভাল লাগার দিক নিয়ে! আর আমাদের সময়, ‘পড়তে বস’, ‘পরীক্ষায় কত নাম্বার পেয়েছো’, ‘লেখাপড়া সব লাটে উঠে গেছে’, ‘পরীক্ষায় ভাল না করলে রিক্সা চালাতে হবে’, ‘ওমুক এত ভাল করেছে, তুমি পারো না কেন’ এসবই বেশী শুনতে হতো! বাবার সাথে বসে সিনেমার আলাপ? মনে করে দেখুন কয়জন করতে পারতাম?
আমার মেয়ে তো মাঝে মাঝে আমাকে সাজাতে বসে! মেয়ে বাচ্চা, সাজুগুজু করতে পছন্দ করে। মাঝে মাঝে ওর এক্সপেরিমেন্ট এর গিনিপিগ আমাকেই হতে হয়। মাঝে মাঝে হাতে করে লিপস্টিক নিয়ে আসে। ‘বাবা তোমাকে একটু লিপস্টিক লাগিয়ে দেই, দেখো কত সুন্দর লাগে’! মেয়ে এমন আবদার করতো কিছুদিন আগেও। প্রথমে অনুনয় বিনয় করে বলেছি, মা আমিতো ছেলে মানুষ! ছেলেরা তো এসব দেয় না। কে শোনে কার কথা! আমাকে নাকি লিপস্টিক দিলেই সুন্দর লাগবে। অতগ্যা নাছোড়বান্দা মেয়ের কাছে পরাজয় স্বীকার করে বসে পড়ি বা শুয়ে থাকি। মেয়ে মনের সাধ মিটিয়ে বাবা’কে সাজায়। মেয়ে আত্মতৃপ্তি নিয়ে তার বাবা’র মুখের উপরে নিজের শিল্পকর্ম দেখতে থাকে। হাসে! আমাকেও আয়নায় দেখতে হয় সেসব সাজগোজের মুখ! মেয়েকে জিজ্ঞসা করি, সাজলে কাকে বেশি সুন্দর লাগে? তোমার আম্মুকে নাকি আমাকে? মেয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলে, আম্মুকে! তখন আমি বলি, তাই? এবার তাহলে আমি মেকাপ উঠিয়ে ফেলি? মেয়ে অনুমতি দেয়! আমি গিয়ে মুখ ধুয়ে আসি! মেয়েটা অনাবিল তৃপ্তি নিয়ে দেখতে থাকে বাবার কর্মকান্ড! ওর সামান্য একটু রঙ ঘষে দেয়ায়, আমার তো কোন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু উপকার কি হল জানেন? মেয়েটা তার বাবাকে বন্ধু মনে করেছে। এরপর থেকে মেয়েটা তার মনের জমানো দুঃখ কথা সবই তার বাবাকে এসে বলবে। বলেও।
শিশুদের প্রতি যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে, বাচ্চাদের সাথে পিতা মাতার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। বাচ্চাদের এমন ভাবে গড়ে তোলা দরকার যেন ওদের সাথে ঘটা যে কোন কিছু অনায়াসে বাবা মাকে এসে বলে দিতে পারে। একটা ছোট বাচ্চা মেয়ের জীবনের প্রথম নায়ক বলেন আর হিরো বলেন, সেটা কিন্তু তার বাবা’ই! বাবা-ই সন্তানের জীবনের উত্তম রোল মডেল। সেটা মেয়ে বাচ্চা হোক, আর ছেলে বাচ্চা হোক। যে মেয়ে তার বাবার কাছে পরম আশ্রয় পেয়েছে, পরবর্তী জীবনে যদি সে তার নিজের জীবন সঙ্গী নিজেও বেছে নেয়, আমার বিশ্বাস এক্ষেত্রে সে তেমন সঙ্গী বেছে নিতে চাইবে যার ভেতরে সে তার বাবা’র অনুরুপ আচরণের সাদৃশ্য বেশী পেয়েছে। এ কথাগুলো যখন নিজে নিজে ভাবি, তখন মনের থেকে ওই কথাটাই আসে। বাবা-ই হলেন প্রতিটা সন্তানের কাছে তাদের জীবনের প্রথম সুপার-হিরো!