২৭ অক্টোবর ২০২০

বাচ্চাদের কি পানির প্রতি একটা আকর্ষণ থাকে সবসময়? আমার ছেলেটা এখনও হাঁটা শেখেনি, হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায় সারা বাসা, অথচ পানির ফিল্টারের প্রতি তাঁর সে কি আকর্ষণ! সুযোগ পেলেই সেদিকে দৌড় দিয়ে চলে যাবে। ফিল্টারের সাপোর্ট ধরে দাঁড়িয়ে অবধারিত ভাবে ট্যাপ চালু করে দিবে। এরপর পানি পড়তে থাকে, সে হাত দিতে পানি ছানাছানি করবে, মেঝেতে বসে হাত দিয়ে পানি ছড়াবে আর খিলখিল করে হাসতে থাকবে। কি আনন্দ! কি আনন্দ! আমরা যেই হা হা করে ছুটে আসি, সেটা দেখে সে অন্যদিলে হামাগুড়ি দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে। ততক্ষণে পানির ফিল্টারের নিচে ছোট খাটো প্লাবন হয়ে যায়। এখন ফিল্টারের সামনে দুইটা চেয়ার দিয়ে আটকে রাখা লাগে। মহাত্মন সেটা বুঝে গেছেন। এজন্য আগে গিয়ে সে চেয়ারটা সরানোর চেষ্টা করে!

 

এগুলো যখন বড় হলে ওকে বলা হবে, তখন সে বিশ্বাসই করবে না, সে এগুলো করতো। কারণ শৈশবের কথা, এত আগের কথা কারো মনে থাকে না। আমাদের জীবনেও সেটাই হয়। আমার জীবনের একান্ত কথাগুলো আমার নিজের মনে থাকে না। সেগুলো অন্যের কাছ থেকে শুনে শুনে নিজেকে শুধরে নিতে হয়। কারণ পৃথিবীতে আমরা মনে হয় নিজে বেঁচে থাকতে জন্মাই না। আমরা জন্মাই অন্যের চোখে বেঁচে থাকতে। আমাদের নিজের বলে কিছু নেই। যা করি, সবকিছুর পেছনেই মনে মনে চিন্তা থাকে, অন্যে কি ভাববে! জবাবদিহিতার সূত্রপাত সেখানে থেকেই। আর ওখানেই আমার যত ঘোর আপত্তি। আমার সাথে অন্যদের বিবাদ মূলত সেখান থেকেই।

 

আজ আর কোন বিবাদের ফিরিস্তি নিয়ে বসবো না। আজ এক বছর পূর্ণ হল আমার ‘বৃশ্চিক অভিধান’ লেখার। গত বছর ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু করেছিলাম লেখা। সেই হিসেবে আজকেই পূর্ণ হয়ে গেল ৩৬৬ টা দিন। এই বছর তো লিপ ইয়ার ছিল। সেজন্য একদিন বাড়িয়ে বলেছি। কোয়ারেন্টাইনের আগে অনেক লিখতাম। কিন্তু কোয়ারেন্টাইনের মধ্যে লেখালিখি কমে গেল। লিখতে ইচ্ছা করতো না। মাঝে মাঝে মনে হতো বই পড়ি। কিন্তু সেটাও একসময় ভাল লাগলো না। তবুও সময় যেন কিভাবে চলে যেতেই লাগলো। কোন কারণ ছাড়াই, বা কোন গুরুত্বপুর্ণ কাজ করা ছাড়াই সময় চলে যেতে লাগলো এবং যাচ্ছেও। কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে বৃশ্চিক অভিধান লেখা শুরু করেছিলাম এমন নয়। মাঝে মাঝে মনে হত, মনে তো অনেক কথাই আসে, অনেক স্মৃতি জমা হয়ে থাকে, এগুলো টুকটাক লিখলে কেমন হয়? সেই ইচ্ছা থেকেই লেখা শুরু করেছিলাম। সেই লেখা লিখির আজ এক বছর হয়ে গেল। যেখানে শুরু করেছিলাম, সেখানেই শেষ করে দিচ্ছি। আজকের পর থেকে আর এই জাতীয় লেখার ইচ্ছা আর পোষণ করছি না। সবকিছুর শুরু থাকলে শেষও থাকা উচিত। আমি আপাতত এই লেখার এখানেই যবনিকা টানছি। যবনিকা টানছি, শোস্যাল মিডিয়াতে লেখা নিয়েও।

 

তাহলে কি আমি লিখবো না? অবশ্যই লিখবো। কারণ লেখালিখি করাটা অনেকটা আমার বেঁচে থাকার জন্য সহায়ক কিছু। দৈনন্দিন অক্সিজেন নেয়ার মত কিছু। লিখতে আমাকে হবেই। সেটা অবশ্যই নিজের মত করে। আমি লেখালিখি করার জন্য আমার একটা নিজস্ব ভুবন বানিয়ে নিয়েছি। আজ কয়েকদিন ধরে, অনেক চিন্তা ভাবনা করছি সেটা নিয়ে, কিভাবে শুরু করবো, কি করবো না করবো। সেটার মধ্যে ডুবে না গেলে সেটাকে আলোর মুখ দেখানো কিছুটা কষ্টকর হয়ে যাবে। শোস্যাল মিডিয়ার সাথে আমরা এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছি, যে চাইলেও অনেক সময় এর থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারি না। কারণ আমার অফিসের কিছু কাজ, ছাত্র ছাত্রীদের সাথে যোগাযোগের কিছু ব্যাপার এখন এই কোয়ারেন্টাইনে বসে করতেই হচ্ছে। অনেকটাই নিরুপায়। সেজন্য অবশ্য আমাকে হাজির হতেই হতে। কিন্তু সেটা শুধু কাজের জন্যই। আর এটা তো একটা মানুষের মেলা! মেলায় এলে, ঘুরে দেখতে অসুবিধা তো নেই। কিন্তু সামর্থ্য যদি না থাকে, তাহলে হয়ত বেচা কেনায় অংশ নিতে পারবো না, এইটুকুই পার্থক্য। দেখতে তো অসুবিধা নেই। কাজেই এখন থেকে আমি একজন শুধুই দর্শক।

 

শোস্যাল মিডিয়া কাকে কি দিয়েছে জানি না, আমাকে দিয়েছে ‘অপেক্ষা’ নামক এক রোমান্টিক যন্ত্রণা। যতই এর থেকে পরিত্রাণ চাই, ততই যেন সিন্দাবাদের ভুতের মত ঘাড়ে চেপে বসে! আরে বাবা, আমারো তো একটা ধারণ ক্ষমতা আছে, না কি? কত ভার আর গ্রহন করা যায়? শুরুতে অনিন্দ্য’র পানির ফিল্টার প্রীতির কথা বলছিলাম না? মনে আছে তো? পানির দরকার হলে আমরাও তো ফিল্টারের নীচে বোতল নিয়ে বসে যাই। তাকিয়ে থাকি, কখন ভরবে বোতল! একসময় ভরে যায়। আমরা ট্যাপ বন্ধ করে উঠে যাই। এক মুহূর্তের অসতর্কতায় নীচে বেশ খানিকটা পানি পড়ে গিয়ে অপ্রীতিকর অবস্থা তৈরী করে। কাজেই বোতলে পানির কোটাও পূর্ণ হয় এবং সেখানে সেখানেও কিছুটা ‘অপেক্ষা’ যুক্ত থাকে। তবেই না তৃষ্ণা মেটে!

 

শোস্যাল মিডিয়াতে দেখা মানুষগুলো আর বাস্তবে সেই মানুষগুলো কিছুটা আলাদা। কেউ কেউ কিছুটা না, বরং অনেকটাই আলাদা। এজন্য শোস্যাল মিডিয়া থেকে আমি যখন বাস্তবের জগতে বের হই তখন নিজেকে অপরিচিত লাগে। চেনা মানুষগুলোকেও অচেনা লাগে। শোস্যাল মিডিয়াতে যাদের সাথে কোন রাখঢাক না রেখেই কথা বলতে পারি, দেখা যায়, বাস্তবে কথা বলতে গেলে হিসেবের খাতা খুলে বসতে হয়। কিংবা হয়তো এর উল্টোটা। এখন আর তো সেই আগের মত ছাত্র নই। এত হিসেব নিকেষ করে আর কত! অনেক তো হলো। এখন থেকে আমি শুধু আমার নিজস্ব ভুবনের একাকী পরিব্রাজক হয়ে ঘুরে বেড়াবো, এক দিগন্ত থেকে অন্য দিগন্তে। সেখানেও থাকবে আমার সেই চেনা মুখগুলো। হয়তো নতুন কোন আবহে, নতুন কোন আবেগে। হয়ত আবার আমার জন্য শুরু হতে যাচ্ছে, নতুন কোন অপেক্ষা। সেই ‘অপেক্ষা’ দেখার জন্য আমিও নতুন করে অপেক্ষা করে বসে আছি।

View shawon1982's Full Portfolio