সেই বইটির জন্য দুঃখ
-
- - - - - - - - -
হঠাৎ হঠাৎ যেসব বাতিক আমার মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে সেগুলো কোনটা স্বল্পস্থায়ী হয় আবার কোন কোনটা বেশ কিছুদিন স্থায়ী হয়ে মনের ভেতর গেড়ে বসে। এখন যেমন বই এর নেশা পেয়ে বসেছে কিছুটা। আমি যেগুলো পড়ি মানে উপন্যাস জাতীয় বই, সেগুলোর বেশ বড় একটা সংগ্রহ আমার যোগাড় হয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় এই যে পাগলের মত হাজার হাজার টাকার বই সংগ্রহ করলাম, এই জীবনে পড়ে যেতে পারবো তো? যদি পড়তে না পারি? এই যদি’র কোন উত্তর খোঁজা কোন অর্বাচীনের কাজ হতে পারে না। কারণ জীবনের নিশ্চয়তা কিছুতেই নেই। সেখানে আমি কতদিন বাঁচবো সেই টার্গেট করে বই সংগ্রহ করবো বা করবো না, সেটার কোন যুক্তি আছে বলে আমি মনে করি না। যা হোক, বইয়ের নেশা আমাকে পেয়ে বসেছে। বই সংগ্রহ করে চলেছি।
বইয়ের মধ্যে আবার নতুন বাতিক মাথা চাড়া দিয়েছে। সেটা হল, সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী সাহিত্যিকগণের কমপক্ষে একটা বই (ইংলিশ) আমার সংগ্রহে রাখা। অবশ্য অন্য কোন বিষয়ে নোবেল জয়ী হলে, এবং তাদের লেখা কোন বই প্রচলিত থাকলে আমি সেগুলাও সামনে পেলে সংগ্রহ করবো এবং করেছিও ইতিমধ্যে কিছু কিছু। এই টার্গেট পূর্ণ করা অনেক মুশকিল আমি জানি কারণ আমাদের দেশে ইংলিশ বইয়ের পাঠকই বা কয়জন আছেন? আর যারা আছেন তারাও হালের কাটতি লেখকদের বইই বেশী খুঁজেন কিংবা থ্রিলার জাতীয় বই বেশী পড়েন। বাংলাদেশের কেউ ‘সুলি প্রুধম’ কিংবা ‘ইভান বুনিন’ এর বই খুঁজে পড়ে বলে তো এখন পর্যন্ত শুনিনি। যদি থাকেন তাহলে তাদের দেখা পেলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।
এই বই সংগ্রহের কথা মনে হলে একটা দুঃখের স্মৃতি আমার মনে আজও জ্বল জ্বল করে। কি একটা বোকামী যে করেছিলাম আমি সেদিন! সিঙ্গাপুরে থাকা কালীন আমাদের ভার্সিটির সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর নিচে একবার পুরানো বইয়ের মেলা হয়েছিল। বেশ কয়েকটা স্টল ছিল এবং সেখানে একদম পানির মূল্যে অনেক পুরানো পুরানো পেপারব্যাক বই বিক্রি করছিল। দুইটা বই ৫ ডলার বা তিনটা বই ৫ ডলার এমন কিছু অফারও ছিল। ইংলিশ বই এর প্রতি আমার তখনো এত আগ্রহ জন্মায়নি। তবুও দেখতে গেছিলাম ঘুরতে। তেমন কিছু পেলামনা। ৫ ডলার দিয়ে মনে হয় কিনেছিলাম ও কিছু, সেগুলো দেশে আর আনা হয়নি, এবং সেগুলা আদৌ কি বই ছিল, আমার সেটাও আর মনে নেই। বই দেখতে দেখতে একটা স্টলের সামনে গিয়ে রুগ্ন একটা বই তুলে নিলাম হাতে। পুরানো দিনের বই। বইটার নাম ‘দ্য মাদার’, লেখক ‘পার্ল বাক’। বইটা খুব অনাগ্রহের সাথে উল্টে পালটে দেখছিলাম। পুরানো হলেও সেটা ছিল একদম অরিজিনাল পাবলিকেশন প্রিন্টের বই। ‘বইটা নিতে পারো। পার্ল বাক নোবেল প্রাইজ পাওয়া লেখকা। আর এটা উনার লেখা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস’। আমার পেছন থেকে অতি পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে আমি তার দিকে ঘুরে তাকালাম। উনার হাতেও কোন একটা বই, দেখছিলেন। আমাদের সুমন ভাই! সিঙ্গাপুরের প্রবাস জীবনের সবচেয়ে বেশী ভাল লাগার মত একজন মানুষ ছিলেন সুমন ভাই! আমার ডক্টরেট সিরার্চের একোটা কাজ সম্পূর্ণ সুমন ভাইয়ের দেয়া আইডিয়ার উপরে ভিত্তি করে করা ছিল এবং পরবর্তীতে সেই কাজ আমাদের সুপারভাইজর দ্বারা বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। আমাদের অনেক সিনিওর এবং উনি তখন পোস্ট ডক করছিলেন। আমদের ল্যাব ছিল মুখোমুখি! এখনও সুমন ভাইয়ের সাথে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হয় ফেসবুকে।
তখনও নোবেল প্রাইজ সাহিত্যিকদের বইয়ের প্রতি আমার বাড়তি কোন আগ্রহ জন্মায়নি। হায় অভাগা আমি! বইটা নিলাম না। রেখে দিলাম। আরো কিছুক্ষণ ঘোরা ফেরা করে চলে আসলাম এমন কিছু বই হাতে নিয়ে যেগুলোর কোন অস্তিত্ব আমার জীবনেই নেই। এখন যখন বই সংগ্রহ করি আর আগ্রহ ভরে ফেসবুকে পোস্ট দেই আর লিখি আমার কাছে অমুক অমুক নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিকিকের বই আছে, ততবারই আমার ভেতরে খারাপ লাগা কাজ করতে থাকে। ততবারই মনে পড়তে থাকে সেইদিন পার্ল বাকের সেই বিখ্যাত উপন্যাসটাকে আমি কি অনাগ্রহে রেখে এসেছিলাম। বইটা এখনও বাংলাদেশে তন্ন তন্ন করে খুঁজে যাচ্ছি। যদি কোথাও পাই! আপনাদের কারো নজরে যদি আসে কখনও বইটা, আমাকে সন্ধান দিলে উপকৃত হব। নেট থেকে হয়তো পিডিএফ নামানো যেতে পারে। কিন্তু আমি পিডিএফ এর বই পড়ি না। কারণ আমার আরেকটা বাতিক হল হার্ড কপিতে বই না পড়লে সেই বইটা পড়েছি বলেই আমার মনে হয় না।