অঙ্গপ্রত্যঙ্গঃ
***ধৈর্য না থাকলে পড়ার দরকার নেই!
একটা ছোট গল্প দিয়ে শুরু করবো! শুনুন তাহলে।
শাতিল সকাল থেকে ঘুমানোর চেষ্টা করেও পারছে না। ওর পাশে শুয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ওর স্ত্রী নাতাশা। দুজনের মাজখানে ঘুমাচ্ছে ওদের এক মাস বয়সী ছোট ছেলে অরিত্র। ওদের একটা মেয়েও আছে। সে খাটের একপাশে গুটিশুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। শাতিল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ৬.৩০ বেজে গেছে। ধড়ফড় করে এমনভাবে উঠে বসলো যে খাট কিছুটা নড়ে উঠলো। নাতাশার ঘুম ভেঙ্গে গেল। স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললো, কি হইসে তোমার?
অফিসে যাবো। সংক্ষিপ্ত জবাব শাতিলের।
আজ শুক্রবার, যাও একা গিয়েই অফিস কর। ধুৎ! ঘুমটাই ভেঙ্গে দিলে বলে নাতাশা ছেলের কাঁথা দেখতে লাগলো পেশাব করেছে কিনা। পেশাব করেনি এটা নিশ্চিত হয়েই আবার ঘুমিয়ে গেল নাতাশা। ওর নিশ্চিত ঘুমের দিকে তাকিয়ে শাতিলের বিরক্ত হল।
ধড়মড় করে উঠে বসায় ঘুমের শেষ রেশটুকুও কেটে গেছে। পাশের ডাইনিং ঘর থেকে টেবিল চেয়ারের খুটখাট শব্দ শুনে বুঝলো, শাতিলের বাবা হাজী জাবির হোসেন সাহেব নামাজ শেষে কোরান পড়ে উঠেছেন। এখন মনে হয় ওষুধ খাচ্ছেন। শাতিলের মনে হলো এখনই কথাটা সেরে নিতে পারে। গতকাল পরীক্ষার খাতা দেখার দুশ্চিন্তায় ভাল মত কথাগুলো শুনতে পারেনি বাবার কথায়। শুধু এতটুকুই মনে আছে, জাবির হোসেন সাহেব শাতিলের ঘরে এসেছিলেন এটা জানাতে, উনি এখন উনার ছোট ছেলে সামির আর মেয়ে শান্তাকে উনার ঢাকার দুটি ফ্ল্যাট লিখে দিবেন। এই ব্যাপারে কিছু বলতে এসেছিলেন। শাতিলের মাথায় কিছুই ঢুকেনি। তাই ভাবলো এখনই কথাটা সেরে নেয়া ভাল। ওদের দুইজনকে দুটো ফ্ল্যাট লিখে দিচ্ছেন, তাহলে শাতিলের কি হবে? শাতিলের কথাতো কিছু বলে নাই। বড় হিসেবে ওরও কি পাওয়ার কথা না? কারণ ওরা এখন যে ফ্ল্যাটে আছে, সেটাও হাজী জাবির হোসেনেরই। তিনটা ফ্ল্যাট হলে হিসেবে তো শাতিলেরও পাওয়ার কথা। কিন্তু ওর বাবা তো ওর কথা কিছু বলেনি। শুধু বলেছে সামির আর শান্তার কথা! তাহলে ওর ব্যাপারে কি পরিকল্পনা করছে জাবির হোসেন? এদিকে যে ফ্ল্যাট শান্তাকে দেয়ার পায়তারা করছেন, সেটাতো ব্যাংকে মর্টগেজ দেয়া। সেটার সুদের টাকা ব্যাঙ্কে ভরার জন্য শাতিলকে বলা হয়েছে মাসে মাসে ১৫হাজার টাকা ব্যাংকে দেয়ার জন্য। শাতিল দিয়েছেও ইতিমধ্যে এক মাসের টাকা। তাহলে ঘটনা কি দাড়ালো? সামির আর শান্তা যে ফ্ল্যাট পাবে, সেটা যেন ব্যাংক নিলামে উঠাতে না পারে, সেটার সুদের টাকা দিতে হবে শাতিলকে? হিসেবটা কেমন গোলমেলে হয়ে গেল না? শাতিল এসব সাতপাঁচ কিছু বোঝে না। এজন্য ওকে নাতাশা মাঝে মাঝে খোটা দেয়। বলে তুমি জীবনে লেখাপড়া ছাড়া আর কি করলে? শাতিল এসব কথা খুব একটা গায়ে মাখে না। কথার পিঠে কথা বললে ঝগড়া লেগে যাবার সম্ভাবনাই বেশী। শাতিল অতি অল্পতেই রেগে যায়।
শাতিল বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বাবার সামনে বসে বললো, বাবা তোমার সাথে কথা আছে। জাবির সাহেব ঠোঁটের কোনের রহস্যের হাসি ঝুলিয়ে রেখে বললেন কি কথা বল। শাতিল বললো, আমি তো জানি তোমার ঐ দুইটা ফ্ল্যাট বন্দক দেয়া আছে ব্যাংক কে? উনি তখন জানালেন একটা আছে। একটা ছাড়িয়ে নিয়েছেন। শাতিল বললো কোনটা বাকী? জাবির সাহেব জানালেন দুইটার মধ্যে ছোটটা। শাতিল পালটা প্রশ্ন করলো, যেটা তুমি শান্তাকে লিখে দিতে চাইছো, সেটা? সেটা তো ব্যাংকের কাছে বন্দক দেয়া। এখনও সেটা ছাড়ানো হয়নি। সেটা জন্য সুদের টাকা দিতে হচ্ছে। তাহলে সেটা শান্তার নামে কি করে লিখে দিচ্ছো? এই প্রশ্ন শুনে জাবির হোসেন সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কথা গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। কি উত্তর দেয়া যায়। শাতিল অপেক্ষা করতে লাগলো। তখন জাবির হোসেন হাতে ধরা খালি গ্লাসটা এক হাত থেকে ও হাত দুইবার এপাশ ওপাশ করলেন। এরপর একটু মুচকি হেসে বললেন, আছে উপায় আছে। শাতিল জানতে চাইল কি উপায়? তখন হাজী জাবর হোসেন সাহেব অভিনব কায়দায় জানালেন, আইনকে পাশ কাটিয়ে করার একটা উপায় আছে। এই নিয়মকে বলে ‘আইনের বাম হাত’। আইনের বাম হাত পদ্ধতি খাটিয়ে ব্যাঙ্কের কাছে বন্দক থাকা সম্পত্তি উনি উনার মেয়ে শান্তাকে লিখে দিতে চাচ্ছিলেন’।
আমার গল্প এখানেই শেষ। শাতিলের বাবার কাছ থেকে শাতিল কিছু পেয়েছিল কিনা জানি না। তবে শাতিলের এই গল্প থেকে আমি আইনের ‘বাম’ হাত বলে যে কিছু একটা আছে সেটা প্রথম শুনেছিলাম। বিটিভিতে আগে যখন বাংলা সিনেমা দেখতাম, তখন শেষ দৃশ্যে নায়কের সাথে ভিলেনের সে কি তুখোড় এক মারামারির দৃশ্য! কি ভয়ঙ্কর এক প্রতিশোধের স্পৃহায় একদন শেষ দৃশ্যে নায়ক যখন অস্ত্র দিয়ে ভিলেনকে খুন করতে উদ্যত হয়, ঠিক তখনই অবধারিত ভাবে কোথা থেকে যেন একদম পুলিশ এসে হাজির হয়ে বলে, ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না’। যে সব সিনেমার লাস্ট দৃশ্যে মারাবারি থাকে, সেগুলোর প্রতিটার শেষেই নায়ককে পুলিশের এই ডায়লগ শুনে পরাস্ত হতে হয়। এরপর ভিলেনকে পুলিশ অ্যারেস্ট করে নিয়ে যায়। পুলিশ সিনেমাতে একটু আগে আসবে না। এবং এসেই এই ডায়লগটা দিবে! যা হোক! আবার সিনেমার ভেতর কোথাও কোথাও শুনেছি, ‘আইনের চোখ’কে ফাকি দেয়া যায় না। বাহ বেশ তো! দু’টা জিনিস শিখে গেলাম। শাতিলের বাবার কাছে থেকে শিখলাম, ‘আইনের বাম হাত’ আর সিনেমা থেকে শিখলাম ‘আইনের চোখ’। বেশ দারুণ। আইনকে তাহলে কিছুটা আমাদের মত কল্পনা করা যেতেই পারে। আইনের চোখ আছে, বাম হাত আছে। তাহলে অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থাকলে কেমন হতো আইন? ধরুন আইনের পা আছে, পুরুষাঙ্গ আছে, নাক আছে, কানে আছে ইত্যাদি। পুরুষাঙ্গ বলাতে তো স্টেরিওটাইপ কথা বলে ফেললাম। আমাকে নিরপেক্ষ ভাবে বলতে হচ্ছে। আমি নিজে পুরুষ বলে আইনকে পুরুষ ভাববো সেটা তো উচিত না। তাহলে ধরে নিলাম আইনের যোনি আছে, জরায়ু আছে। পুরুষাঙ্গ থাকলে আইনের অন্ডকোষ থাকা উচিত। সেখান থেকে বীর্যপাতও হওয়া উচিত। যোনি আর জরায়ু থাকলে রজঃস্রাব হওয়া উচিত। এটা তো আশীর্বাদ তাই না! প্রকৃতির নিয়ম তো এটাই।
আসলে কি জানেন। আইন অনেক দয়ালু। এর অনেক মায়া। আইনের কাছে সবাই সন্তানের মত। কিন্তু আইন কিছুটা শাতিলের বাবার মত। সংসারের জন্য হাজার করলেও, শাতিলের টাকা দিয়ে সামিরের, শান্তার ফ্ল্যাট বাচানোর সুদের টাকা উসুল করা যায় কিন্তু শাতিলের জন্য কোন ফ্ল্যাট বরাদ্দের নামগন্ধ মুখেও নেয়া যায় না। ঠিক তেমনি, যারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, তাদেরকেই লজ্জিত হতে হচ্ছে, মাথা নোয়াতে হচ্ছে অথচ যারা অত্যাচার করে বেড়াচ্ছে তারা কিভাবে আছে কোথায় আছে? আমি জানি না। আপনারা জানলে আমাকে উত্তরটা বলে দিয়েন।