উপহার
= = = =
দুঃসাহসই শুধু নয় বরং রীতিমত ধৃষ্টতা হয়ে যাবে আমার মত এক অধমের মুখে, যদি আমি বলি আমি একজন শিল্প বোদ্ধা! এই ঔদ্ধত্ব আমি কিছুতেই দেখাতে পারিনা। তবে বিনয়ের সাথে বলতে পারি, শিল্পকর্ম সর্বদা এই অধমের মনকে আকৃষ্ট করে। শিল্প আর সাহিত্য যদি না থাকতো তাহলে আমি নিঃশ্বাস নিতে পারতাম কিনা সন্দেহ আছে। যে কোন ধরনের নান্দনিক শিল্পকর্ম আমার ভাল লাগে। যদিও কিছু পারি না, কিন্তু শিল্পের প্রসংশা তো মনে হয় করতেই পারি! আমার মনে আছে, যখন বাসায় প্রথম ইন্টারনেটের কানেকশন নিয়েছিলাম, সেই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময়কালীন, তখন ইয়াহু সার্চ এঞ্জিন অনেক জনপ্রিয় ছিল। সেই ইয়াহু সার্চ এঞ্জিনে গিয়ে আমি Arabic Calligraphy দেখতাম। আমার খুব ভাল লাগতো। সার্চ দিলেই কত বাহারী রকমের ক্যালিগ্রাফি চলে আসতো। মুগ্ধ হয়ে ভাবতাম মানুষ এত সুন্দর করে লিখে কি করে? আর আরাবী ভাষার অক্ষরগুলোকে এমন ভাবে সাজানো যায় যে তা দিয়ে খুব সহজেই নানন্দিক চিত্র-কর্ম বা ক্যালিগ্রাফিতে পরিণত করা যায়। কিন্তু সেজন্য চাই একজন শিল্পী মন এবং অঙ্কনে তেমন দক্ষতা! অনেকের বাসাতেই দেখেছি কোরানের আয়াত সম্বলিত ক্যালিগ্রাফি শোভা পায়। বাবার বাসা থেকে সরে যখন আলাদা থাকা শুরু করলাম, তখন দেখলাম পুরনো বাসায় আমাদের পতিত কিছু জিনিসের সাথে ‘আয়াতুল কুরসী’ লেখা একটা বাধাই করা ওয়ালম্যাট পড়ে আছে। পরিত্যক্ত ভাবে পড়ে আছে। হয়ত আমাদের নিয়ে আসার জন্য রাখা হয়েছিল, কিন্তু আমিও পণ করেছিলাম, ‘বাবা’র কোন জিনিস আমি আনবো না। আমি শুধু আমার পরিত্যক্ত জিনিসগুলো নিয়েই চলে এসেছিলাম একদম শূন্য হাতেই। তাতে আমার কোন আফসোস নেই।
আমি আসলে মূল কথার আগে ভূমিকা অনেক বেশী দিয়ে ফেলি। পাঠক এইটুকুতে বিরক্ত হয়ে যাবেন না দয়া করে। ছোট বেলায় কিভাবে যেন একটা জিনিস শিখেছিলাম জানি না, যে কারো কাছ থেকে কোন জিনিস উপহার বা গিফট পেলে সেই জিনিস আর কাউকে দিতে হয় না। ছোট বেলা থেকেই গিফটের কদর বুঝতাম। আর উপহার বা গিফট পেতে কার না ভাল লাগে! মনে মনে আশা করতাম জন্মদিন কবে আসবে? জন্মদিনে তো গিফট হয়তো পাওয়া যাবে কিছু! পেতামও। বই, গানের ক্যাসেট, গ্লাসের ভেতর মোমবাতি কত কিছুই গিফট পেয়েছি একসময়। র্যাপিং পেপার খোলার মধ্যে সে কি এক উত্তেজনা কাজ করতো মনে মনে। এখনও করে। কিন্তু এখনকার উত্তেজনা প্রকাশের ভাবধারা হয়ত কিছুটা পালটে গেছে। মনে মনে পুলকিত কিন্তু ঠিকই হই। হাদীসেও কিন্তু হাদিয়া বা গিফট দেয়াকে অনেক উৎসাহিত করা হয়েছে। এক হাদীসে উল্লেখ আছে মহানবীর অমোঘ বানী “তাহাদ্দু তাহাব্বু” অর্থাৎ- তোমরা হাদিয়া বা উপহার প্রদান কর, ভালবাসা বাড়বে। কথাটা মহাসত্য। উপহার কাকে দিতে ইচ্ছা করে? আসলেই যার জন্য ভালভাসা থাকে তাই না? তবে এখন তো অনেকেই আবার উৎকোচ কেও উপহার নাম দিয়ে কাজ হাসিল করতে চায়। আজকের এই লেখায় কোন ঋণাত্মক বিষয় কেন যেন আনতে মন একেবারেই চাইছে না। আনবো না। যা বলছিলাম, কাউকে খোলামনে উপহার দেয়া মানে তার প্রতি ভাললাগার বহিঃপ্রকাশ। অন্তত আমি সেটাই ভাবি। তা সে যেমনই উপহার হোক না কেন। আমারো ইচ্ছা করে আমার প্রিয় মানুষগুলোকে উপহার দিতে! অন্তত সাধ্যের মধ্যে যদি কিছু হয় তো মন্দ কি!
গতকাল আমি একটা আরবী ক্যালিগ্রাফি বাধাই করে এনে আমার ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে দিয়েছি। বাজার থেকে কেনা কোন ক্যালিগ্রাফি না। বাজারে তো কতই পাওয়া যায়! যে ক্যালিগ্রাফি আমি ঘরে বাধাই করে ঝুলিয়েছি তা, যে আমাকে দিয়েছে তার জীবনের প্রথম করা কোন ক্যালিগ্রাফি। সে আমাকে জীবনের প্রথম ক্যালিগ্রাফিটা উপহার দিয়ে দিয়েছে। এই ক্যালিগ্রাফিটা আমাকে দেয়ার পেছনে তার কতখানি ভাললাগা কাজ করেছে খুব সহজেই অনুমেয়। ক্যালিগ্রাফিটায় লেখা আছে কোরানের সর্বাধিক পুনরাবৃত্ত আয়াত যা সূরা আর-রাহমান এ আছে, “ফাবিআয়্যি আ-লা-ই রব্বিকুমা- তুকাজ্জিবান” অর্থাৎ “অতএব তোমরা উভয় সম্প্রদায়, তোমাদের স্বীয় পালনকর্তার কোন কোন অবদান অস্বীকার করবে?”। অত্যন্ত ভাবগাম্ভীর্য পূর্ণ এই আয়াতের পুনরাবৃত্ত উপস্থাপনা সূরা আর-রাহমান কে অন্য সব সূরা থেকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে এবং সূরার ধ্বনি মাধুর্যকে অনন্য করেছে। দেয়ালে রাখা এই ক্যালিগ্রাফিটা আমাকে একে দিয়েছে আমার ছোট ভাই তাওসিফ হাসান খান। ওকে নিয়ে আমিও আগেও লিখেছি। ওকে আমার ক্লোন বলেছি। কারণ অতি বিস্ময়ের সাথে আমরা আমাদের মধ্যে এতবেশী কিছু মিল পেয়েছি যা সচারচর দুইজন মানুষের মধ্যে দেখা পাওয়া যায় কিনা, সেটা আমার দ্বিতীয়টা জানা নেই। তাওসিফের সাথে আমার সরাসরি দেখা হল মাত্র দুইদিন আগে এক ঝটিকা সফরে কিশোরগঞ্জ যাবার সুবাদে। ওদের বাসা ওখানেই। এক ঘন্টারও কিছু কম সময় ছিলাম। এর মধ্যে তাওসিফ তার আঁকা ক্যালিগ্রাফিটা এনে রোল করে আমার হাতে দিয়ে দিল। ওর সাথে যখন আমার পরিচয় হয়, তখন ফেসবুকে ওর কাভার পেজে এই ক্যালিগ্রাফিটার একটা ছবি ছিল। প্রিয় ছোট ভাইর নিজের হাতে আঁকা ক্যালিগ্রাফিটা পেয়ে আমার মনে যে অপার্থিব আনন্দ হয়েছিল সেটা কাউকে লিখে ব্যক্ত করতে আমি অপারগ। আমি ওকে ধন্যবাদও দেইনি। কারণ ওর উপহার আর ভাললাগার কাছে আমার ধন্যবাদ নেহায়েত তুচ্ছ ছিল।
তাওসিফের ছোট ভাই ওয়াসিফ মাত্র ক্লাস থ্রিতে পড়ে। প্রায় মাস দেড়েক আগে ওয়াসিফ আমার একটা ছবি পেন্সিল স্কেচ করে আমাকে বিস্ময়ের চূড়ান্তে নিয়ে গিয়েছিল। আমার ছবির স্কেচ কেউ করবে সেটা আমার কল্পনার অতীত ছিল। তাও ওয়াসিফের মত ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলে! আমার স্কেচটা করার আগে ও আমাকে মাত্র দুইবার দেখেছে ক্যামেরাতে ভিডিও কলে। কথা বলেছি টুকটাক ওর সাথে। মাত্র দুইবার কথা বলাতেই, এই অধম অন্ত্যজ, ঐটুকু বাচ্চার মনে কি জায়গা যে করে নিয়েছিলাম আল্লাহ জানেন, ও আমার স্কেচ করে ফেললো আমার একটা ছবি দেখে। ছোট্ট ওয়াসিফ তার স্কেচটা এনে আমার হাতে দিল। আমি ওকেও ধন্যবাদ দিতে ভুলে গেলাম! এই উপহারের ধন্যবাদ কোন ভাষায় দিতে হয় সেটা আমার জানা নেই। স্কেচটায় দেখলাম ওর নাম লেখা নেই। বললাম, ভাইয়া এই কোনায় তোমার নামটা পেন্সিল দিয়ে লিখে দাও! ও পেন্সিল হাতে নিয়ে বললো, ভাইয়া Cursive Letter দিয়ে লিখি নামটা? আমি বললাম লিখে দাও। ও সুন্দর করে কার্সিভ বা প্যাচানো অক্ষরে নিজের নাম, তারিখ, বার সব লিখে দিলো। আমার মনে পড়লো, ঐ বয়সে আমি তো মনে হয় মানুষের সাথে ঠিকমত গুছিয়ে কথাও বলতে পারতাম না। মন থেকে অনেক দুয়া করেছি, করে যাচ্ছি, আমার দুই ভাই তাওসিফ ওয়াসিফ অনেক বড় মাপের মানুষ হোক। ধন্যবাদ তোমাদের দিতে পারিনি ঠিক আছে, ভাষাজ্ঞান তত নেই আমার, কিন্তু আমার অন্তর্যামী সৃষ্টিকর্তা কিন্তু মনের কথা শুনেন জানেন। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস তিনি আমার দোয়া শুনেছেন। তাওসিফ ওয়াসিফ একদিন অনেক অনেক বড় মানুষ হবে। সেইদিন দেখার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে বসে আছি।