সুপ্রিয় বন্ধু,
আমি কিছুটা বিস্ময়ের সাথে তোমার পোষ্টটা দেখেছি, এবং লক্ষ্য করেছি তুমি আমার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছো। আমাকে এবং আমার মতামতকে তুমি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেছো দেখে তোমার প্রতি আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। যদিও পোষ্টটা তোমার নিজের লেখা নয়, তথাপি পোষ্টটা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে নিঃসন্দেহে। সুন্দর এবং সময়োপযোগী লেখা বটে। তোমাকে এবং লেখককে দু’জনকেই বিশেষ ধন্যবাদ।
এমন একটা লেখা তুমি দিয়েছো, এখানে কোনক্রমকেই দ্বিমত করার কোন সুযোগ নেই, এমনকি তর্কের খাতিরে তর্ক তো নয়ই। সূর্যের পূর্ব দিকে উদয় নিয়ে যেমন কোন তর্ক চলে না, তেমনি তোমার উল্লেখ্য পোষ্টটা নিয়েও কোন তর্ক চলে না। আমি শুধু নারীদের ব্যাপারে আমার কিছু বিচ্ছিন্ন ভাবনা তোমার সাথে আলোচনা করতে চাই।
কবে থেকে শুরু হয়েছে নারীর প্রতি বৈষম্য সেটা আমার জানা নেই। তুমি আমাদের কৈশোরের শেখা কিছু শব্দের দিকে একটু লক্ষ্য কর। ‘বন্ধ্যা’, ‘বাঞ্জা’, ‘পতিতা’, ‘গণিকা’ এই শব্দগুলো খেয়াল করেছো? এগুলো নিপাতনে সিদ্ধ সর্বত স্ত্রীবাচক শব্দ! এই শব্দগুলোর আড়ালে লুকানো আছে ঘর ঘরের ইতিহাস আর অনেক বর্ণহীন অশ্রুসজল হাহাকার! তাই না? আমরা, সমাজপতিরা, সমাজের কেতন উড়ানো বুদ্ধিজীবীরা কি সুকৌশলে শুধু নারীর উপরে চাপিয়ে দিয়েছি শব্দগুলো। যেন সন্তান ধারণ করতে না পারার দায়বদ্ধতা একক ভাবে শুধু নারীর উপরেই বর্তায়। পুরুষ যেন এখানে ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থাকে। কিভাবে মানুষের এই ধারণা জন্মেছিল যে, সন্তান না হওয়া শুধু নারীর কারণে? প্রাকৃতিক ভাবে একজন নারীর শরীর যেমন সন্তান ধারণে অক্ষম হতে পারে ঠিক তেমনি একজন পুরুষও একই কারণে সন্তান জন্মদানে অপারগ হতে পারে। কিন্তু পুরুষকে এমন কোন শব্দে বিশেষায়িত করা হয়নি কোথাও।
শুধু নারীই সন্তান ধারণে অক্ষম হতে পারে, এমন অসত্য এবং কদর্যপূর্ণ ধারণা মানুষের মনে জন্মেছিল বলেই শব্দগুলোর কোন পুংলিঙ্গ নেই। আমাকে ব্যাপারটা ভাবিয়ে তোলে। ধর্ম স্বীকৃত নয়, এমন যৌনাচারের মাধ্যমে উপার্জনের দায়ভার শুধু নারীকে এককভাবে দিয়েই তাকে ‘বেশ্যা’, ‘গণিকা’, ‘বারবনিতা’ এসব বলা হয়েছে। অথচ যাদের কারণে মেয়েগুলো আজ এই পথে নেমে এসেছিল, তারা কিন্তু ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে চিরকাল। তাদের কে কেউ, ‘বেশ্য’, ‘গণিক’, ‘পতিত’ এসব কিন্তু বলছে না। এসব নিয়ে কারো কোথাও মাথা ব্যথা দেখেছো? কেউ কি এগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলেছে? সময় কই আমাদের? বিদ্রোহী কবি নজরুলের ‘বারাঙ্গনা’ কবিতা নিশ্চই পড়েছো। শেষের দুই লাইন আমাকে সর্বদা তাড়িত করে-
“অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ-পুত্র হয়,
অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়!”
তোমার পোষ্টে একজন মা’এর কথা উল্লেখ করেছো। আমার কাছে ‘মা’, ‘বোন’, ‘স্ত্রী’, ‘কন্যা’ এরা কেউই কোন ‘মেয়ে’ বা ‘নারী’ নয়। আমার কাছে এরা প্রত্যেকেই ‘শক্তি’। ‘নারী-শক্তি’ও নয়। এরা আমার কাছে শুধুই শক্তি। আমি বা আমরা আজকে যা, যে অবস্থানে আছি, এর পেছনে আছে এই শক্তি। শক্তি ছাড়া যেমন আমরা চলতে পারি না, তেমনি এই উল্লেখিত শক্তিগুলো ছাড়া আমরা কিছুই না। আমাদের সমাজ, দেশ, ধর্ম, রাজনীতি, কোন কিছুরই কোন অস্তিত্ত্ব নেই এই শক্তি ছাড়া। যদি আমি আমার সহধর্মিনির কথা উল্লেখ করি, সে আমার কাছে কোন নিছক ‘রমনী’ নয় যার সাথে আমার রমন করা ধর্মত বৈধ। আমার স্ত্রী আমার যহযাত্রী। আমার ইহলৌকিক, পারলৌকিক সৌন্দর্যের যহযোগী। আমার সহধর্মিনি ছাড়া আমার কোন দর্শন নেই, আমার কোন সামাজিকতাও নেই। সমাজে টিকে থাকতে হলেও আমাদের চাই সেই শক্তি। তোমার পোষ্টে যে মা’র কথা উল্লেখ আছে, আমি সেই মাকে আমি আমার নমস্য মনে করি। শ্রদ্ধা জানাই সেই মা’কে। আমি চাই, আমার স্ত্রীও তেমন একজন মা হয়ে উঠুক। এমন মা সবার ঘরে ঘরে থাকুক।
আমাদের সমাজের কলুষতা ততদিন দূর হবে না, যতদিন আমরা নারীকে ‘রমনী’ বলা বন্ধ না করছি। আমার মতে এই শব্দ বাংলা থেকে উঠিয়ে দেয়া হোক। নারী শুধুমাত্র যোনী আর স্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ কোন খেলনা নয়। আমাদের মাথায় এই ধারণা যতদিন না আসছে ততদিন আমাদের সমাজের কোন বোধোদয় হবে না। নারী আর পুরুষ মিলেই ‘মানুষ’। একে অন্যের পরিপূরক। কাউকে বাদ দিয়ে কেউ নয়। একে ছাড়া অন্যের কোন অস্তিত্ত্ব নেই। তথাপি বিধাতা নারীকে এমন শক্তি দিয়ে গড়েছেন, যার কাছে কোন পুরুষ পৌঁছাতে পারবে না। নারীর অবস্থান সর্বদাই অলঙ্কৃত। সেই পুরুষ সন্মানিত, যে নারীকে সন্মান করতে পারে। নারীকে ‘নারী’ নয় বরং একজন মানুষ হিসেবে মূল্যায়িত করতে হবে। নারীর সন্মান প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে একজন পুরুষ। এজন্য দরকার আমাদের দর্শন আর মূল্যবোধের পরিবর্তন।
আমাদের সমাজ থেকে ধর্ষণ চিরতরে বিলুপ্ত হতে পারতো যদি একজন পুরুষ আসলেই বুঝতো তার ‘পৌরুষত্ব’ তার ‘পুরুষাঙ্গ’র ক্ষমতায় নয় বরং সেটা সংরক্ষণে। একজন পুরুষের ক্ষমতা রমনে নয় বরং নারীকে সমাজকে নিরাপত্তা দানের মাধ্যমে। একজন পুরুষ যদি আসলেই নিজেকে ‘পুরুষ’ বলে মূল্যায়িত করতে পারে, তাহলে সে কি করে ‘ধর্ষক’ হতে পারে সেটা আমার বোধগম্য নয়। আত্মশুদ্ধি আর সংযমই পারে শুধু একজন মানুষ কে ‘পুরুষ’ এ রুপান্তরিত করতে।
বন্ধু, খুব গুছিয়ে হয়ত বলতে পারলাম না আমার দুর্বল লেখনীতে। তবুও চেষ্টা করেছি আমার নিজের কথাগুলো তোমার সাথে শেয়ার করতে। আমার লেখার খাপছাড়া ভাব আশাকরি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে। সতত ভাল থেকো।
ইতি,
একজন ‘পুরুষ’ বন্ধু!