**প্রবাসীদের উপার্জন ও বৈবাহিক জীবন
এই বিদ্ঘুটে টপিকটা কেন জানি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কয়দিন থেকেই। কিভাবে কি লিখবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। সবকিছু কেমন যেন খাপছাড়া চিন্তা ভাবনা। মনের চিন্তাধারা লেখনীতে উঠে আসতে পারে। চেষ্টা করছি যথা সম্ভব গুছিয়ে লিখে। এই বিষয়ে অনেক আগে একবার কিছুটা লিখেছিলাম। এখন সেটাকে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করার প্রয়াস নিয়ে লিখতে বসা। দেখি কি হয়!
কয়েক মাস আগে একটা গানের ভিডিও এবং গানের ভাষা শুনে কিছুটা হেসেছিলাম এবং একই সাথে উপলব্ধি করেছিলাম এই গানের পেছনে লুকানো রূঢ় বাস্তবতাটাকে। গানটাকে যদিও হাস্যরসাত্মক রুপদান করা হয়েছে ভিডিওতে তথাপি গানের অন্তর্নিহিত ভাবধারাটাকে ফেলে দেয়া যাবে না। বাংলাদেশের প্রায় ঘরে ঘরের লুকানো অব্যক্ত কথা বলা হয়েছে গানের ভাষায়। একজন মেয়ের ভাষ্যে বলা হয়েছে, ‘তার স্বামী কাতার গেছে চাকরী করতে, আর সে একাকী বোধ করছে। আর একাকীত্বের সুযোগ নিয়ে অনেকেই তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং তার ভেতরকার প্রতিরোধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। সে সকরুণ ভাবে তার স্বামীকে আহ্বান করছে, সে যেন দেশে ফিরে আসে’। গানের ভাবধারাটা আমি আমার নিজের ভাষায় তুলে ধরলাম। গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে শহরের অনেক মধ্যবিত্ত ঘরের সাধারণ কাহিনি এটা। স্বামীকে পরিবারের অর্থ যোগান দিতে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর প্রবাসে দিন কাটাতে হয়, আর স্ত্রীকে এখানে সামলে যেতে হয় ঘর সংসার সবকিছুই। খুব বাস্তব কিছু ঘটনা আমি চাক্ষুষ করেছি নিজেই।
স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যেকার দীর্ঘকালীন দূরত্বের কারণে অনেক অসামাজিক ঘটনার সূত্রপাত হয় এবং এক্ষেত্রে দোষের ভাগীদার করা হয় সিংহভাগ ক্ষেত্রে মেয়েটিকেই। আমাদের সমাজে বিয়ে নামক যে সামাজক বৈধতার প্রচলম আছে, তাতে একটা মেয়ের চাওয়া পাওয়া, আনন্দ উপভোগের দিকে নজর দেয়া হয় না বললেই চলে। পরিবারের চাওয়া পাওয়ার সাধ, আর অনেক অবাস্তব স্বপ্ন পুরনের লোভে, কিছু পার্থিব প্রাপ্তির আশায় পরিবারের বিবাহিত ছেলেটিকে পাঠিয়ে দেয়া হয় প্রবাসে। সেখান থেকে রেমিটেন্স নামক সোনার হরিণ দেশে পাঠাতে থাকবে আর তা দিয়ে গ্রামে দালাম কোঠা উঠে যাবে। টাকার পরে টাকা আসবে, সবার যত অভাব অভিযোগ আছে সব একে পূরণ হয়ে যাবে।
অবিবাহিত ছেলেদের যেমন পাঠানো হয়, তেমনি বিবাহিত ছেলেদেরকেও তাদের পিতা মাতা সংসারের অভাব অভিযোগের ফিরিস্তি দিয়ে বাইরে যাওয়ার প্ররোচনা দেয়। বিবাহিত ছেলের স্ত্রীটির মতামতের কোন সুযোগ কোথাও রাখা হয় না। বৌয়ের আবার মতামত কি? স্বামী বাইরে যাবে, টাকা পাঠাবে, ভাল মন্দ খাবে এই তো! একটা মেয়ে মানুষের যেন শুধু পেট চালাতেই স্বামীর সংসারে যাওয়া। পেটে দুই লোকমা ভাত দেয়া ছাড়া যেন মেয়ে মানুষের আর কোন চাহিদা থাকতে নেই। আমাদের সমাজের আমরা সবাই বুঝি, কিন্তু একটা মেয়ের ক্ষুধা ছাড়াও যে অন্য শারীরিক চাহিদা থাকতে পারে সেটার কথা কেন যেন আমাদের মুখে উচ্চারণ করতে বাধে। জিনিসটাকে এমন একটা পর্যায়ে আমরা নিয়ে গিয়েছি যে, কোন মেয়ে যদি এগুলো নিজে থেকে বলতে চায়, তাহলে তার উপাধি হবে ‘নষ্টা মেয়েছেলে’। মেয়েদের যেন নিজেদে চাহিদার কথা বলতে নেই। তাকে যা দেয়া হবে সেটা মুখ বুজে মেনে নিতে হবে।
আর ছেলেটা? সে যদি তার জৈবিক চাহিদার কথা প্রকাশ করেও ফেলে, বা তার স্ত্রীর কাছে যেতে চায়, তাহলে তাকেও হাসির পাত্র হতে হয়। আর সে আসবে কি করে? ছেলে বিদেশে যাবার সময় বাবা মা কর্তৃক একটা বাক্য তো শুনিয়ে দেয়াই হয়, ‘তোকে খাওয়াতে পরাতে আমাদের কত খরচ গেছে না। তোর কি কোন দায় দায়িত্ব নেই আমাদের উপরে?’ জ্বী অনেক দায় দায়িত্ব আছে। আর সব দায় দায়িত্ব তো বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বিদেশে খেটে মরা ‘কলুর বলদ’টার ঘাড়ের উপরেই বর্তায়। যেন বাবা মায়ের সব খরচ বড় ছেলেটাকে মানুষ করতেই চলে যায়। পরের সন্তানগুলা যেন ভেসে আসে আর কি! বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়, তোর ছোট ভাইবোন গুলা আছে, ওদের দেখতে হবে! সন্তান কার আর দায়িত্ব নিতে হয় কাকে? আচ্ছা নিলোই বা কিছু দায়িত্ব, কিন্তু যে বিবাহিত ছেলেটা মাসের পর মাস, বছরের পর বছর দেশে আসতে পারে না, স্ত্রীর সংস্পর্শে আসতে পারে না, নিজের জন্ম দেয়া বাচ্চাদের কাছে পর হয়ে যায় তাদের কি কোন ‘হক’ বা অধিকার নেই? সব অধিকার শুধু পিতামাতার আর তাদের জন্মদেয়া ভাই বোন গুলার? যদি স্ত্রীর কাছে চলে আসে, তাহলে তো আর কথাই নেই, ছেলে পর হয়ে গেল রে, ছেলে পর হয়ে গেল। ‘বৌয়ের কথায় ওঠে আর বসে’। আমাদে সমাযে কোন বিবাহিত ছেলেকে জব্দ করতে এই বাক্যটার জুড়ি নেই।
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পার হয়ে যায়, প্রবাসী ছেলেটার ছুটি হয় না। কোম্পানী ছুটি দেয় না। অনেকের আবার পরিবারের খাই মেটাতে অনেক ধার দেনা করতে হয়। সেই ধার দেনা শোধ দিতে দিতে তার আর বাড়ি ফেরা হয় না। ছেলে প্রবাসে গেলে, ছেলে কিভাবে আছে, কি খায়, কিভাবে থাকে, সে সম্পর্কে বাবা মা যতখানি না ওয়াকেবহাল থাকে তার চেয়ে বেশী থাকে আর উপার্জন সম্পর্কে। দিন যেতে না যেতেই একের পর এক ফিরিস্তি শুরু হতে থাকে। ঘর পাকা করতে হবে, দালান তুলতে হবে, পুকুর কাটাতে হবে, টিউবওয়েল লাগাতে হবে, বোনের বিয়ে দিতে হবে, জামাইকে ঘড়ি দিতে হবে, ছোট ভাইয়ের পরীক্ষার ফিস দিতে হবে, ছোট ভাইটার একটা আইফোন লাগবে, বোনের জন্য স্বর্ণের চেন লাগবে! আর চিন্তা করিস না, বৌ ভালই আছে।
আমাদের দেশের প্রবাসীদের এসব বৌরা ভাল থাকে তাদের না বলা কথাগুলো শুন্যে উড়িয়ে দিয়ে। একজন অর্থের জোগান দিতে দিতে তার জীবন যৌবন সব শেষ করে দেয়, আরেকজন স্বামীর প্রতীক্ষায় দিন গুনতে গুনতে সংসারের ঘানি টানতে টানতে শেষ হতে থাকে। এটাই সাধারণ চিত্র। এমনও দেখেছি, ছেলে যদি বিদেশ থেকে টাকা জমিয়ে নিজে একটু জমি জমা কেনে, তাহলে বাবা মা সেখানে ওত পেতে থাকে সেই জমির ভেতরেও যেন তার ভাইকে রাখা হয়! অর্থাৎ মরে পড়ে এক ছেলে টাকা জমায়ে জমি করে সম্পদ করবে, সেখানেও বাবা মা আশা করে ভাইদের ভাগ যেন রাখা হয়। যেন এটা তার পৈত্রিক সম্পত্তির মতই!
আমি আমার গ্রামের নিজের কাছ থেকে দেখা একজন কে চিনি। গ্রাম সুন্দরী বৌ রেখে সৌদি-আরবে চাকরী করছে। বছরের পর বছর। একটা ছেলেও জন্মেছে তার। মাঝেকয়েক বছর দেখা নেই সেই লোকের সাথে। দেশেও এসেছেন। এখন দেশেই থাকছেন। আমাদের বাসায় বেড়াতে এলেন, অন্য একজন মহিলা কে নিয়ে। পরিচয়ে বুঝলাম, তার স্ত্রী, কিন্তু আমি যাকে চিনতাম সে নয়। পরে আমার মায়ের কাছে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি, তার আগের স্ত্রী বাচ্চাটাকে ফেলে রেখে আরেকজনের সাথে ভেগে(!) গিয়েছে। কাহিনী আমার কাছে স্পষ্ট হল।
আপনি কাকে দোষ দেবেন? মেয়েটিকে? আমি মেয়েটিকে কোন দোষ দেব না। সে একরকম ঠিকই করেছে। আমি দোষ দেব সেই ছেলেটিকে, যে তার যুবতী স্ত্রীকে বছরের পর বছর নিজের সংসারে ফেলে রেখে প্রবাস থেকে সোনার হরিণ রেমিটেন্স পাঠিয়েছে। একটা ছেলে মা ছাড়া হয়ে এখন সৎ মায়ের সংসারে প্রতিপালিত হচ্ছে। সেই লোকের শিক্ষা হয়েছে। এখন প্রায় বিগত যৌবনে সে তার ২য় স্ত্রী নিয়ে সংসার করছে আর গ্রামের বাজারে মুদি দোকান নিয়ে সংসার চালাচ্ছে। এখন তো আর বিদেশ যাবার নাম নিচ্ছে না! এখন না আছে সেই যৌবন আর না আছে সেই টাকার খাই! এই চিত্র কিন্তু আপনার আশে পাশেই আছে। খুঁজে দেখেন।
এক ছেলে বাইরে থাকে, তার টাকায় পুরো সংসারের সবার চাহিদা পূরণ হতে থাকে। আর প্রবাসী ধীরে ধীরে নিঃশেষ হতে থাকে। যদিও বা সে কৌশলে নিজের স্ত্রীর জন্য কিছু করে বা জমাতে চায় তাহলে তার জন্য তাকে বাবা মায়ের কাছে সারা জীবন খোটা শুনতে হয়। সারাজীবন পরিবারের ঘানি টেনেও তাকে শুনতে হয়, পোলা এখন বৌয়ের হয়ে গেছে। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার গুলোর বেশীরভাগেরই দায়ভার অনেকটা এমনই। ‘বড় ছেলে’ নামক টাইটেল যদি কারো গায়ে লেগে থাকে তাহসে সে ভাল করে বুঝবেন আমার কথা। তুমি বড় ভাই, ছোটদের দায় দায়িত্ব তোমার, বাপ মা কে দেখার দায়িত্ব তোমার। এই দায়িত্বের কথা কোনভাবেই ছোটভাইয়ের উপরে বর্তাবে না। ছোটটা যা খুশি করুক কোন সমস্যা নেই। বেড়ী পরানো থাকে বড়টার পায়ে। বড় ছেলেগুলা, আর প্রবাসীগুলা বেশীরভাগই পায়ে বেড়ী নিয়ে জন্মায়। এই বেড়ী থেকে মুক্তি নেই। আর মুক্তি মানেই হল তাকে সংসার থেকে আলাদা হয়ে যেতে হবে।
আমাদের সমাজ সংসারের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ চিত্র দেখা যায় যদি ঘরে ছোট বোন থাকে। আমি এমন চিত্রও দেখেছি, বড়ো ভাই বিয়ে করছেন না। কেন ভাই? আপনার তো বয়স হয়ে যাচ্ছে? বলে কি করবো ভাই, ঘরে তিনটা বোন আছে। ওদের বিয়ে না দিয়ে আমি কিভাবে বিয়ে করি? তার মানে? আপনার তিন বোনের আগে বিয়ে হবে এরপর আপনি? বড় ভাই হওয়া সত্ত্বেও। বলে কি করবো ভাই, বাপ মা তো কিছু বলে না, আমিও মুখ ফুটে বলতে পারি না। এই লজ্জাই শেষ করে দিচ্ছে আমাদের। নিজের জীবন যৌবন সব শেষ করে দিয়ে, আগে সবগুলা বোনের বিয়ে হবে এরপর যদি বাপ মায়ের রুচি হয় ঘরে বৌ আনার! শেষ যৌবনে বৌ এনেও রক্ষা হয় কি? মায়ের কড়া নজর থাকে, ছেলে আবার বৌকে সব দিয়ে দিচ্ছে না তো? কত ইনকাম করে আর বৌয়ের পিছে কত খরচ করছে! ছেলে তো গেছেই। বৌ ছাড়া আর কিছু বুঝে না! অপবাদের পরে অপবাদ! সব কিছুর দায়ভার দোষ মেয়েটার! কারণ সে বৌ যে! একটা ছেলে যদি ৪০-৪৫ বছরে গিয়ে বিয়ে করে তাহলে সে কি বৈবাহিক জীবন উপভোগ করার জন্য বিয়ে করে নাকি শুধু সমাজ কে সন্তুষ্ট করার জন্য, যে আমি বিবাহিত? কোনটা? সেই বাবা কিভাবে সেই প্রবাসী ছেলের কষ্ট বুঝবে যে কিনা নিজে অল্প বয়সে বিয়ে করে সন্তানের বাবা হয়ে সারাজীবন নিজের স্ত্রীর সাথে ঘরে করেছে?