৯ মে ২০২০

**প্রতিশ্রুতি দেয়া এবং সেটা রক্ষা করা

 

**শৈশব ও কৈশোর যেভাবে গিয়েছে-৪

 

আমরা নানা দরকারে মানুষের সাথে নানা রকমের প্রতিজ্ঞা করে থাকি। কেউ কেউ যেমন এসব প্রতিজ্ঞার মূল্য দিতে জানে তেমনি আবার কেউ কেউ নিছক কথার খাতিরে প্রতিজ্ঞা করে। সেটা রক্ষা করার কোন গুরুত্ব অনেকের ভেতরেই থাকে না। কমিটমেন্ট রক্ষা করা যে অনেক বড় একটা ব্যাপার সেটার গুরুত্ব অনেকেউ উপলব্ধি করতে পারে না। এতে মন ভাঙ্গার যেমন ব্যাপার চলে আসে অনেক ক্ষেত্রে তেমনি অনেকের সম্পর্কেও স্থায়ী ফাটল ধরে যেতে পারে। যদি ধর্মের কথাই বলি, তাহলে ইসলাম ধর্মে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার উপরে অনেক কড়াকড়ি আরোপিত হয়েছে। এমনকি যারা ওয়াদা বা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকরা কে ‘মুনাফিক’ বা কপটচারীতার চিহ্ন হিসেবেও আখ্যা দেয়া হয়েছে। এমন প্রতিজ্ঞা করাই উচিত না যা আমরা রাখতে পারবো না। আর যার সাথে প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে, সেটা রাখতে না পারলে তার কাছ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করাই সমীচীন বলে মনে করি। কারণ সব কিছু মিটে গেলেও মনের দাগ কিন্তু এত সহজে মেটে না।

 

আমরা বাচ্চাদের সাথেও হরহামেশা প্রতিজ্ঞা করে থাকি। তোমাকে এটা কিনে দেব, ওটা কিনে দেব, ওখানে বেড়াতে নিয়ে যাব ইত্যাদি। শিশু কিশোর মন একটা খোলা কাগজের মতই সাদা থাকে। আমাদের কথার প্রতিটি আঁচড় কিন্তু সেখানে রাখাপাত করাই থাকে। শিশুরা মিথ্যা কথা যেমন বলে না (যদি তাদের ইচ্ছাকৃত শেখানো না হয়), তেমনি তাদের সাথে করা প্রতিজ্ঞার কথাও কিন্তু ভোলে না। আমার মেয়েটা যখন একটু বড় হল, নানা রকম বায়না করা শিখলো, তখন আমি আমার স্ত্রীর সাথে এই ব্যাপারে একমত হলাম, আমরা মেয়েকে এমন কোন প্রতিজ্ঞা করবো না যা আমরা রাখতে পারবো না। কারণ মেয়েটাকে দেখেছি, সে সব কিছু মনে রাখে এবং বারংবার সেটা মনে করায়ে দিতে থাকে। সাথে সাথে কোন কিছু হাজির করে না দিলেও, হয়ত দুই একদিন পরে দিয়েছি। দিয়ে বলেছি, এই দেখো সেই জিনিস যা তোমাকে দেব বলেছিলাম। এরফলে হয় কি, বাবা মায়ের প্রতি বাচ্চাদের একটা আস্থা জন্মে। এই আস্থা জন্মানোটা সন্তানের সাথে পিতা মাতার সুন্দর সম্পর্ক তৈরী এবং দূরত্ব কমানোর জন্য অত্যাবশ্যকীয়। যদি সেটা না হয়, তাহলে অনেক গোপন কথা, দুঃখ ব্যথা হয়ত সন্তান আর পিতা মাতাকে বলবেই না, এবং এর পরিণতি পরে ভাল হবার কোন সম্ভাবনা দেখি না।

 

সন্তান যতই ছোট হোকনা কেন, সব সন্তানই চায় তার পিতা মাতা তার সাথে বন্ধুর মত হোক। জন্মগত ভাবে সব সন্তানের আচরণ এক রকম হয় না। কারো জিদ বেশী থাকে, কেই ঘরকুনো হতে পারে আবার কেউ চঞ্চল হতে পারে। পিতামাতার উচিত তাদের সন্তাদের আচরণ গভীরভাবে উপলব্ধি করে তাদের সাথে সেইভাবে সহানুভুতির সাথে মেশা। সন্তান যদি পিতা মাতার সাথে ফ্রি হয়ে কথা না বলতে পারে, বা পিতা মাতার ব্যাপারে যদি মনে অযথা কোন ভয় পোষণ করে, তবে পিতা মাতার সাথে নিশ্চিত ভাবে সন্তানের যেই স্থায়ী দুরত্ব তৈরি হয় তা আর মোচনীয় হয় না। কারণ যে দুরত্ব একবার তৈরী হয়ে যায়, তা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। পরবর্তীতে সন্তান অবাধ্য হয়ে গেছে সেটা বলে আর কোন লাভ হয় না। কারণ সন্তান যে এখন কথা শুনছে না, ‘অবাধ্য’, ‘বেয়াদব’, ‘ঘাউড়া’ হয়ে গেছে বলে আমরা মনে করছি, এটা হবার পেছনে সন্তানের শৈশবে আমরাই দায়ী ছিলাম কোন না কোনভাবে। সন্তানকে উপযুক্ত ভাবে মানুষ করার জন্য পিতা মাতার চেয়ে বড় ভূমিকা পৃথিবীর আর কোন প্রতিষ্ঠান নিতে পারে না। এজন্য পিতা মাতার চাই ধৈর্য, সহনশীলতা আর প্রতিশ্রুতি রক্ষা।

 

যদি আমি আমার শৈশবের কথা উল্লেখ করি তবে আমি আমার মায়ের কথা এখানে অত্যন্ত প্রশংসার সাথে উল্লেখ করবো। শৈশব থেকে এখন পর্যন্ত আমার আম্মুর এমন একটা প্রতিজ্ঞার কথা আমার মনে পড়ে না যা উনি করেছেন কিন্তু রাখেন নি। এই গুন আমার আম্মুর ছিল, এখনও আছে। যদি উনি কোন প্রতিজ্ঞা করতেনও তাহলে সেটা জেনে শুনে বুঝেই করতেন। এজন্য অনেক আবদার দাবি দাওয়া আম্মুর কাছেই করতাম। আব্বুর কাছে কোন জিনিস চাইতে হলেও সেটা দেখা গেছে আম্মুকে দিয়েই বলাতাম। আম্মুর এই গুনটা নিজের মধ্যে আনতে চেষ্টা করছি প্রতিনিয়ত। সবাই যেমন এক রকম হয় না তেমনি আমার বাবাও মনে হয় কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলেন। লেখাপড়ার কোন সামগ্রী কখনও চাইতেও হয়নি কখনও আমার। যদি কাগজ, খাতা, কলম কোনটা চেয়েছি, তাহলে তা প্রয়োজনের চেয়েও বেশী করে এনে দিয়েছেন। সেগুলো আমার অনেক অনেক থাকতো। কারণ আমার ঝোঁক ছিলই লেখাপড়া কেন্দ্রিক থাকা। ১৯৯৩ সালে আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন আমার বাবা আমার সাথে দুইটা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। একটা আমি করিয়েছিলাম, আরেকটা উনি নিজে থেকে করেছিলেন। দুটার পেছনেরই উদ্দেশ্য ছিল আমি যেন ভাল রেজাল্ট করি।

 

ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেলে আমি বলেছিলাম আমাকে একটা Walkman কিনে দিতে। উনি বলেছিলেন, পেয়ে দেখাও কিনে দেবো। আর এরপরে ৬ষ্ঠ শ্রেনীরে যখন স্কুল ভর্তি পরীক্ষার প্রসঙ্গ এলো, তখন বলেছিলেন, যদি তুমি গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে চান্স পাও তাহলে তোমাকে একটা Gold-Medal বানিয়ে দেব। আমি দুইটাতেই কৃতকার্য হয়েছিলাম। ১৯৯৪ সালের জানুয়ারী মাসেই ভর্তি হয়েছিলাম গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে। ভর্তি পরীক্ষায় আমার রোল ছিল ৩২৫। আর সেই বছরই মার্চ মাসে বৃত্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছিল। আমি ট্যালেন্টপুলে সেন্টার ফার্স্ট হয়ে সরকারী বৃত্তি পেয়েছিলাম আর প্রথম গ্রেডে কিন্ডারগার্টেন বৃত্তিও পেয়েছিলাম। নিশ্চই আমার বাবা অনেক আনন্দিত হয়েছিলেন আমার এই সাফল্যে। খবরের কাগজে আমার বৃত্তি প্রাপ্তির সুসংবাদ ছবি সহ ছাপিয়েও দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মন পড়ে ছিল আমার সেই কাঙ্খিত Walkman এর দিকে। দাম এমন কিছু বেশী ছিল না সেটা Gold-Medal এর তুলনায়। এগুলা কিনে দেয়ার সামর্থ্য তার নিশ্চই ছিল। কিন্তু আমার বাবা আমার কাছে করা সেই দুটো প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেন নি। Walkman এর কথা পরে মনে করায়ে দিলে, উনি আর মনেই করতে পারেন নি আমাকে এমন কোন ওয়াদা করেছিলেন। আর অন্যটা? থাক সেসব কথা বলে আর কি হবে!

View shawon1982's Full Portfolio