৩ মে ২০২০

ক্যারিয়ার কাকে বলে সেটা আমি ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত বুঝতাম না। সত্যি বলছি, আমার লেখাপড়ার সূত্রপাত আবার যখন শুরু হল, অর্থাৎ সৌদি আরব থেকে ফেরার পরে সেই ১৯৯০ সালে, তখন থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ক্যারিয়ার কি আমি বুঝতাম না। বুঝার চেষ্টাও করিনি। নিশ্চই আমার ব্যর্থতা। ১৯৯০ সালে যখন ক্লাস টু তে পড়তাম আর ২০১৩ তে যখন ডক্টরেট ডিগ্রি সম্পন্ন করে ফেললাম, এর মধ্যে আমার কাথায় ক্যারিয়ার ব্যাপারটা কোন এক অজানা কারণে কাজ কখনই করে নি। কি অদ্ভুত না? এখন চিন্তা করলেই নিজেকে একটা অকাট মূর্খ কিংবা এলিয়েনের মত লাগে। অকাট মূর্খের চেয়েও বেশী কোন টাইটেল যদি থাকে, মূর্খতার দিকে তাহলে আমি সেটা নিজের সাথে সম্পৃক্ত করে নিতাম। সেই স্কুল থেকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে আমার মাথায় একটা জিনিসই ঢোকানো হয়েছে, তা হল- ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট,............

 

কি হয়রান হয়ে গেছেন? একই কথা এতবার কপি পেস্ট করেছি দেখে কি আমাকে অনেকগুলো গালাগাল দিয়ে ফেলেছেন? যদি গালাগাল দিয়েই থাকেন, মন থেকে কৃতজ্ঞতা জানবেন। আমি একটুও অবাক হইনি। একই কথা এতবার উচ্চারণ করলে কার না খারাপ লাগে! কিন্তু বিশ্বাস করুণ, আমাকে এর চাইতেও অনেক অনেক অনেক বেশীবার শুনতে হয়েছে এই জিনিস। শুইতে, বসতে উঠতে, খাইতে, কোন সময় বাদ যায়নি। আমার জীবনের প্রতিটি ক্ষণ আবর্তিত হত লেখাপড়ার সাথে। আমার নোয়া মামা যখন মারা গেল, আমি যেতে পারিনি, কারণ আমার টেস্ট পরীক্ষা চলছিল। বড় মামা যখন মারা গেল, তখনও আমি যেতে পারিনি কারণ আমার ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা চলছিল। আমার কি মনে হয় জানেন? যখন আমি মারা যাব, তখনও মনে হয় আমার কোন না কোন একটা অদৃশ্য পরীক্ষা চলবে। যেমন এখনও আমি ঘুমের ঘোরে পরীক্ষার স্বপ্ন দেখতে থাকি! পরীক্ষার সেই ভয়াবহতা আমার মনের মধ্যে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে এখন শিক্ষক হয়েও আমার প্রায় দিনই ঘুম ভেঙ্গে যায় পরীক্ষার হলের কথা চিন্তা করে। আমার মন মস্তিষ্কের পুরোটা জুড়েই থাকতো শুধু লেখাপড়ার কথা।

 

আমার কোন ভাষা ছিল না, কোন প্রতিবাদ ছিল না। যেহেতু আমাকে শুধু পড়ালেখাই করে যেতে হবে, সেহেতু আমার আবার কথা কি? পড়তে হবে আর ভাল রেজাল্ট করতে হবে। এটাই জীবনের চরম লক্ষ্য! আর কি? এবাই চলতে হবে! চাবি দেয়া কটা পুতুলের মত! এর বেশী আমার কোন মতামত, বিচার আচার পারিপার্শ্বিকতা  কিছুই যা আমার থাকতে নেই। ইংরেজী প্রবাদের পর প্রবাদ, হাতের লেখা, শব্দ মুখস্ত করা, রেজাল্ট কার্ডের অ্যাানালাইসিস, অন্যান্য ভাল ভাল দিগ্বিজয়ী ছাত্রদের সাথে তুলনা করে আমাকে যথেচ্ছা তিরস্কার করা, ওমুক ওমুকের পা ধুইয়ে পানি খাওয়া, এগুলাও ছিল আমার পুরষ্কার মাঝে মাঝে! এগুলার মধ্যে দিয়েই একের পর এক ধাপ আমি পার করেছি। রুটিন করে পড়া, রিভিসনের পর রিভিশন দিতে থাকা, বই ভাজা ভাজা করে ফেলা, রচনা গুলো মুখস্ত করে ফেলা, স্টপ ওয়াচ ধরে ধরে লেখার প্র্যাকটিস করা, এগুলা ছিল আমার নিত্য সঙ্গী।

 

এক এর পর এক টার্গেট সেট করে দেয়া হত। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেতে হবে, গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে ভর্তি হতে হবে, অঙ্ক ইংলিশে অনেক অনেক বেশী নাম্বার পেতে হবে, সব টিচার দের থেকে ভাল ভাল রিপোর্ট আসতে হবে, মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করতে হবে (হয়নি), আরো কত কি! এভাবেই চলতে থাকে একের পর এক দিন, মাস বছর! ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালীন সময়ে ভাত খেতে খেতে খাবার টেবিলে বলেছিলাম, আহারে ১৯৯৮ সালে যখন পরের বিশ্বকাপ চলবে, তখন আমি ক্লাস টেনে পড়বো! শুনে সাথে সাথেই আমার বাবা বলেছিলেন, তাহলে তো তখন তোমার খেলা দেখা চলবে না, কারণ পরের বছর তোমার এসএসসি পরীক্ষা চলবে। আমি নিঃশব্দে ভাত খাওয়া শেষ করলাম। তাই তো, যার পরের বছর ম্যাট্রিক পরীক্ষা সে তার আগের বছর আবার টিভিতে খেলা দেখে কি করে?

 

এরপর কলেজ, তারপর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, এরপর সেটা শেষ হতে না হতেই, ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য চলে যাওয়া পাঁচ বছরের জন্য। সেটা শেষ হতে হতে ২০১৩! এরপর ধুকতে ধুকতে দেশে চলে এলাম। ক্যারিয়ার কাকে বলে? তখনও জানা হয়নি আমার। জীবনে কি করা উচিত তখনো বোঝা হয়নি। ইদানিং কালে BSC দেয়া নিয়ে ছোট ছোট ভাই বোনদের যে উৎকণ্ঠা দেখছি, সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ত্বের শপথ করে বলছি, আমার সময় আমি এই BCS শুনেছি কিনা মনেই পড়ে না। সব আমার ব্যর্থতা। আমার হীনতা, আমার দীনতা। আজকেই আমি শিখে নিলাম, BCS এর ইলাবোরেশন টা কি! এর আগে কোনদিন এটার ইলাবোরেশন জানার ইচ্ছাও আমার ছিল না। কেন? কই কোনদিন তো কেউ আমাকে এটা বলেনি! আমাকে তো শুধু সবাই বলেছে, ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট আর ভাল রেজাল্ট! কিন্তু আমার যে সীমাবদ্ধতা ছিল। আমাকে যত ভাল ছাত্র কল্পনা করা হয়েছিল, তার কিয়দংশও হয়ত আমি ছিলাম না, সেজন্য আমার মহান পিতার স্বপ্ন পূরণ করা আমার সম্ভব হয়নি। ভাল রেজাল্ট না করে করে আমি বহুবার তাকে আশাহত করেছি।

 

রেজাল্ট কখনো আকাশচুম্বী করিনি কিন্তু খুব একটা নীচুমানেরও হয়ত ছিল না। ম্যাট্রিকে তো টার্গেট ছিলই স্ট্যান্ড করতে হবে। সেজন্য স্কুলে থাকতে আমাকে আমাকে প্রতিবছর স্ট্যান্ড করা ছাত্রদের সাক্ষাৎকার তা আদ্যোপান্ত দেখতে হত। ক্ষণে ক্ষণে তার উদাহরণ শুনতে হত। এগুলা আমার কিছু মনেই হত না। মনের মধ্যে শুধু বদ্ধমূল হতেই থাকতো। ১৯৯৪ সালে গবর্নমেন্ট স্কুলে চান্স পাওয়ার আগের বছর, ঐবছর মাধ্যমিকে সেকেন্ড স্ট্যান্ড করা ছেলেটার বাবার সাথে আমার বাবার কিভাবে যেন পরিচয় ছিল। আমাকে সেই বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। ওইদিন সেই ছাত্রের সাথে দেখা হয় নাই কিন্তু তার সন্মানিত বাবা আমাকে নসিহত করলেন পুরোটা সময়! কিভাবে তার ছেলে স্ট্যান্ড করেছে। সে দৈনিক ১৪ ঘন্টা লেখাপড়া করেছে। শুরু হয়ে গেল আমার জীবনের নতুন অধ্যায়। প্রায় প্রায় আমাকে নতুন করে শোনানো হত, এত এত ঘন্টা লেখাপড়া না করলে স্ট্যান্ড করবে কিভাবে? অনেক অনেক চেষ্টা করেও ’১৪ ঘন্টায়’ আমি উন্নীত হতে পারিনি। আসলে জিনিসটা আমি কখনই নিজের মনের থেকে নেইই নি। আমার উপরে অনেকটা আরোপিত ছিল। আর যেই জিনিস মন থেকে নেয়া হয় না সেটার জন্য প্রাণান্ত বা ডেডিকেটেড কিভাবে হয় আমি জানি না? আমার বাবা-মার ধারণা ছিল মনে হয়, উনাদের বারংবার বলতে বলতে হয়ত আমার মনের মধ্যে জিনিসগুলা বসে যাবে। কিন্তু বসে নাই। হয়ত মনের অজান্তে একটা বিতৃষ্ণাই জন্মেছে।

 

এবার একটু কিঞ্চিত বর্তমানে আসি। পরে না হয় আবার অতীতে ফিরবো। এখন আমি দুই সন্তানের জনক। মেয়েটার বয়স তো দেখতে দেখতে ছয় বছর হয়ে গেল। মেয়েটার যখন জন্ম হয় তখনও আমি বেকার। জ্বী, ঠিকই পড়েছেন। শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি ডক্টরেট নিয়েই তখন আমি এক ডক্টরেট বেকার। মেয়ের বয়স যখন পাঁচ ছয়  মাস, তখন আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের একজন রাফিয়া’র কাছ থেকে তথ্য নিয়ে স্বনামধন্য এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ও-লেভেলের ম্যাথের শিক্ষক হিসেবে প্রথম চাকুরী শুরু করি। সেগুলোর বিস্তারিত পরে না হয় কখনও বলবো। এখন সেই স্মৃতিচারণ উদ্দেশ্য নয়। দেয়ালে তো পিঠ ঠেকেই গিয়েছিল। তখন থেকেই মেয়ের ব্যাপারে শুনতে হল, মেয়েকে কোথায় পড়াবা কিসে পড়াবা? ইংলিশ মিডিয়ামে পরাবা কি না? আমি বরাবরই এক উত্তর দিয়ে এসেছি, আমি যেই লেখাপড়ার ইঁদুর দৌড় দৌড়ে এসেছি, আমি আমার কোন বাচ্চাকে সেই যাতাকলে কোনদিনও ফেলবো না। লেখাপড়াকে ওদের কাছে কোনদিনও চাপিয়ে দিব না, বা অভিশাপের বস্তু বানিয়ে দেব না। যতটুকু ধরতে পারে পড়বে, নিজেদের ভবিষ্যতে যার যা খুশি হইতে চায় হবে, আমার সেটা নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই। কালও ছিল না, আজও নেই।  

 

যাই হোক, শুরু হল ‘স্কুল শিক্ষক’ জীবন! শুরু হল নতুন খেতাব। কতজনের কটাক্ষ যে আমাকে শুনতে হয়েছে, ‘এত শিক্ষিত হয়ে শেষমেশ স্কুল শিক্ষক! ফুহ’। ‘ফুহ’ টা আমার মুখের উপরে না দিলেও মনে মনে দিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কারণ যারা বলতো, তাদের কাছে, ডিগ্রি আর সেই মাপের চাকুরী হওয়াটাই বড় কথা! স্কুল শিক্ষকরা আবার মানুষ নাকি? যার কিছু করার নাই, তারাই করে মাস্টারী। মাস্টারি করতে আবার যোগ্যতা লাগে নাকি? আড়াল আবডাল থেকে এগুলা আমাকে শুনতে হল, আর হজম করতে হত! কিন্তু, সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ত্বের শপথ করে বলছি, আমি নিজে গর্বিত কারণ আমি একজন শিক্ষক। আমি আরো গর্বিত এজন্য যে আমার শিক্ষকতার আনুষ্ঠানিক জীবন স্কুল থেকে শুরু করেছিলাম আমি। যেই সব শিক্ষিত(!) লোকজন স্কুল শিক্ষকতাকে হেয় চোখে দেখেন, তাদের বলছি, আপনারা হেয় করুণ সমস্যা নেই, তার আগে এক মাস স্কুলের শিক্ষক হয়ে দেখান! দেখেন নিজের চোখে একজন শিক্ষককে কি পরিমান শ্রম দিয়ে তাঁর জায়গা করে নিতে হয়। আমি অনেক সন্মানের সাথে সাড়ে তিন বছর সেই স্কুলে শিক্ষকতা করেছি। সেই প্রতিষ্ঠানের সাথে আমার এখনও নাড়ীর সম্পর্ক। এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টার্ভিও বোর্ডে আমাকে বলা হয়েছিল, আমরা জানি তুমি কোন স্কুলে শিক্ষকতা করে এসেছ, এবং সেখানে একজন শিক্ষককে কি উন্নত মানের টেনিং দেয়া হয়। তোমার শিক্ষকতার যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমাদের আর কিছু জানার নেই! তোমাকে আমরা এজন্যই নিয়োগ দিয়েছি।

 

আমার বাবাকে আমি একবার দুইবার না বহুবার দেখেছি, যখন স্কুলে শিক্ষকতা করতাম, কাউকে যদি বলতে হত, আমি কোথায় চাকরী করি, এটা বলতে গিয়ে উনার মুখে তেমন কোন সন্তুষ্টির ভাব থাকতো না। অনেক দায়সারা ভাবে বলতেন। আমি একজন স্কুলের শিক্ষক, ডক্টরেট ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও, সেটা বলতে হয়তো তার মান সন্মান ক্ষুণ্ন হতো। আমি তাকে দোষ দেই না। রহিম-আফরোজ কম্পানীতে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম, উত্তরার এক বিদ্যুত অফিসে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। আমাকে সুন্দর ভাষায় বলে দেয়া হয়েছিল, আমার ডিগ্রি অনেক বেশী। তাই চাকরী হবে না। বিদ্যুত অফিসে থেকে ফেরত আসার সময়, হাতের ফাইলটা ময়লার মধ্যে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। ওর মধ্যে ছিল আমার জনৈক BCS cadre কর্তৃক সত্যায়িত(!) সার্টিফিকেটগুলো। একরাশ ঘৃণা নিয়ে কাগজগুলো ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলাম আমার বাবার সামনেই। পরে উনার বলায়, আবার তুলে আনিস এগুলো রাস্তা থেকে, কারণ সেগুলোতে নাকি আমার তথ্য ছিল! বিদ্যুত অফিসের জনৈক কর্মকর্তার কাছে আবার বাবাই নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে আমি সাক্ষী গোপাল হয়ে বসে রইলাম। আমাকে সামনে বসিয়ে ঘন্টাখানেক চলেছিল প্রায় উনাদের দুইজনের ফ্ল্যাট বেচাকেনার ফিরিস্তি! আমি অম্লান মুখে কত স্কয়ার ফিটের দাম কত সেগুলা শুনছিলাম, আর মনে মনে ভাবছিলাম, ক্যারিয়ার আসলে কি জিনিস? কিভাবে করতে হয় ক্যারিয়ার? আমার কাছে কতগুলো সার্টিফিকেট আছে, অথচ আমার কাছে কোন ক্যারিয়ার নেই! কেমন দেখতে সেই ক্যারিয়ার?

 

ভাল রেজাল্ট, ভাল রেজাল্ট শুনতে শুনতে একসময় আকন্ঠ,আরক্ত নিমজ্জিত আমি এইবার ভাবতে শুরু করেছিলাম ক্যারিয়ার নিয়ে। কিছু একটা তো করা করা লাগে। আমার উচ্চতর ডিগ্রি তখন আমার কাছে অভিশাপের মত মনে হয়েছিল। এই কথা আমি এখনও বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষা আর উচ্চতর ডিগ্রির মুল্যায়ন ‘মাস্টারী’ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মাস্টাররা তো মাস্টারই! এরা আবার মানুষ নাকি? যার কিছুই করার যোগ্যতা থাকে তা, তারাই তো মাস্টার হয়! এগুলাই তো সর্বজন বিদিত কথামালা। সেই সময় আমাকে বার কয়েক শুনতেও হয়েছে, তুমি কি আর BCS করবা? অ্যাডমিন ক্যাডারে কত সন্মান! আহা! আরে মূর্খ আমি! তখনও আমি জানি না বিসিএস কি জিনিস! কেমন অদ্ভুত একটা এলিয়েন না আমি? বাংলাদেশে থেকেও আমি জানি না বিসিএস কি জিনিস! সারাজীবন তো ভাল রেজাল্ট, আর ভাল ছেলে হইতে হইতে পার হয়ে গেল, ক্যারিয়ার তো শিখলাম না কি জিনিস। এখন বুঝি, বাংলাদেশ এ Power Practice টাই বড়ো কথা। এখানে ডিগ্রি আর লেখাপড়ার মূল্য খোদ শিক্ষিত(!) মানুষ গুলার কাছেই নাই। ডক্টরেট ডিগ্রিধারীরা আপামর মানুষের মানুষের কাছে, শিক্ষিত পাগল-ছাগল ছাড়া আর কিছুই না। আমিও এক ডিগ্রিধারী পাগল-ছাগল আর কি! আমার আবার ক্যারিয়ার কি? পাগল ছাগলের আবার কিসের ক্যারিয়ার? যার বিসিএস নাই তার আবার কিসের ক্যারিয়ার?

 

 লেখাটাকে চাইলে আরো বড় করতে পারি। কিন্তু দরকার কি? পাগল ছাগলের কথা শোনার সময় কই? শুধু এইটুকুই বলবো! না রে ভাই, আমার কোন BCS নাই, আমি সাধারণ একজন শিক্ষক! বিসিএস কোন বিশাল হম্বিতম্বি কোন ক্যারিয়ার হয়ত আমার নেই, আর থাকা সম্ভবও নয় কারণ বয়স নেই যে। আমার বিসিএস না থাকতে পারে, কিন্তু হয়ত আমার অগোচরেই আমি অনেক বিসিএস ক্যাডারের শিক্ষক হয়ে যাব। আমার অনেক ছাত্রছাত্রীই হয়ত সেটা করে ফেলবে। আমি শিক্ষক, আমি আমার আদর্শ নিয়েই আছি, থাকবো। এথিক্সের প্রশ্নে আমি জীবনে কখনও কারো সাথে আপোষ করিনি, করবোও না। তাতে আমার জান চলে যাক না। অসুবিধা নাই।

 

জীবনের কোন প্রান্তে, কারো কাছে আমার ‘এক পয়সার’ কোন প্রত্যাশা নেই। চরম থেকে চরমতর মুহুর্তেও আমি একাকী নিঃশেষ হয়ে যেতে অনেক অনেক বেশী ভালবাসবো। নিজের সন্তান থেকে শুরু করে, বাবা-মা আত্মীয় স্বজন, চেনা জানা, কারো কাছে আমার কোন প্রত্যাশা নেই। আমার নিজের যেটুকু আত্মসন্মান আছে, সেটুকুই আমার পুঁজি। ওটাকে সম্বল করেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চাই। কেন আমি BSC ক্যাডার বলাম না, সরকারী চাকরী করলাম না, সেটা নিয়ে আগেও কোন আফসোস ছিল না, এখনও নেই, ভবিষ্যতেও কোনদিন থাকবে না। যারা আমার লেখা পড়ে ভেবেছিলেন, বিসিএস নাই বলে আমি হতাশায় ভুগছি, আমি দুঃখিত আমি সেটা বলতে চাইনি। আমি যা আছি, যেভাবে আছি, ভাল আছি। এই সন্মানের সাথেই থাকতে চাই। কোন পাওয়ার প্র্যাকটিস করে আমার কিছুই অর্জন করতে হবে না। চাই না। এক জীবনে মানুষের সব চাওয়া পাওয়া পুরণ যখন হয় না, তখন শুধু শুধু অলীক এক মরীচিকার পেছনে ছুটে জীবনের বাকী দিনগুলোকে নিরানন্দ করে দেয়ার কি দরকার? এই তো, যা আছি ভাল আছি।   

View shawon1982's Full Portfolio