‘অ্যালকোহল’ Alcohol শব্দটা শুনলেই অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমান আঁতকে ওঠেন। সেটা দোষের নয় বরং আমি এটা প্রসংশাই করবো। আঁতকে ওঠার কারণটাও সবাই জানেন, ইসলাম ধর্মের বিধি অনুসারে ‘অ্যালকোহল’ সংমিশ্রিত দ্রব্যাদি, যা নেশার বস্তু তা সর্বোতভাবে ‘হারাম’ অর্থাৎ পরিত্যাজ্য। যে সমস্ত জিনিস সেবনে মাদকতা তৈরি করে এবং মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যকারিতা ব্যহত করে, সেগুলোকেও এই আওতায় আনা হয়েছে এবং সর্বতোভাবেই সেটা নিষিদ্ধ। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু অ্যালকোহল সম্পর্কে অনেকে না জেনেই নানা রকম বাড়াবাড়ির আশ্রয় নিয়ে ফেলেন যেগুলো ঠিক নয়।
জৈব রসায়ন তথা Organic Chemistry এর অনেক বড় একটা আলোচ্য বিষয় এই অ্যালকোহল। রসায়নের বিষদ আলোচনা আমার উদ্দেশ্য না। জৈব যৌগের মধ্যে যদি –OH গ্রুপ কার্যকর ভাবে উপস্থিত থাকে, তবে সাধারণ ভাবে তাদের কে ‘অ্যালকোহল’ বলা হয়। এই অ্যালকোহল শুধু এক দুই রকম না বরং হাজার হাজার লাখ লাখ প্রজাতির আছে। মানুষ যে অ্যালকোহল খেয়ে নেশা করে বা সাধারণ ভাষায় যা মদের ভেতর সাথে সেটা হল ইথাইল অ্যালকোহল Ethyl Alcohol (CH3CH2OH) বা ইথানল। এটার বিভিন্ন শতাংশের সাথে অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে বাজারের নামী দামী ব্র্যান্ডের মদ তৈরী করা হয়। ফার্মেন্টেশন বা গাঁজন প্রক্রিয়াতেও শর্করা থেকে এই অ্যালকোহল তৈরী করা যায়। ইসলামের রীতি অনুসারে এগুলা হারাম কেননা এগুলা খেলে মানুষ মাতাল হতে পারে তথা স্বাভাবিক বুদ্ধি লোপ পেতে পারে।
কথা থেকে যায়। এই ইথালন ছাড়াও তো আরো হাজার লাখ ধরনের অ্যালকোহল আছে। সেগুলো খাবার উপাদান থেকে শুরু করে, কস্মেটিক্স সহ, ওষুদের মধ্যে নানা মাত্রায় বিদ্যমান। অ্যালকোহল মানেই হারাম, সেটা ব্যবহার করা যাবে না, ব্যাপারটা এমন কি? অ্যালকোহল খেয়ে নেশা করা হারাম, কিন্তু অ্যালকোহলের যে অন্যান্য অপরিহার্য ব্যবহার আছে সেগুলো তে নাক সিটকানোর কি আছে? অনেককেই আমি দেখেছি বডি-স্প্রে বা পারফিউম ব্যবহার করেন না। কারণ সেখানে সুগন্ধির ধারক হল অ্যালকোহল। এটা কেমন কথা? আমরা গায়ে যে সমস্ত স্প্রে দেয়া পারফিউম লাগাই, সেখানে অ্যালকোহলটা শুধু সুগন্ধি উপাদানকে ধারণ করে। অ্যালকোহল উদ্বায়ী পদার্থ বলে, কাপড়ে লাগার অতি অল্প সময়ের মধ্যে এটি বাষ্পীভুত হয়ে উড়ে চলে যায় কোন চিহ্ন ছাড়াই। কেউ কি এমন আছে, গায়ে সেন্ট বা বডি স্প্রে লাগিয়ে সেটার কারনে মাতলামি করছে? সেই অ্যালকোহলের সামান্য অংশও তো কাপড়ে বাকী থাকে না। কাপড়ে লেগে থাকে শুধু সুগন্ধি উপাদানটুকু। তাহলে সেই সুগন্ধির ভেতরে যে অ্যালকোহল থাকে, সেটা কি হারাম হল? অনেকেই এ কারনে আতর ব্যবহার করেণ। আপনি আতর ব্যবহার করেন, তাতে কারো কোন সমস্যা নেই। শুধু শুধু নির্দোষ সুগন্ধিকে দোষারোপ করার কি আছে?
আপনি কি পান্তা ভাত খান? পান্তা খেতে পছন্দ করেন? পহেলা বৈশাখে শখ করে পান্তা ভাত খান? কখনও শুনেছেন পান্তা ভাত খেতে আলেমরা হারাম ফতওয়া দিয়েছে? শোনেন নাই তো! এটা কি খেয়াল করেছেন, পেট ভরে ভাত খাওয়ার কিছুক্ষণ পরে এবং বিশেষ করে পান্তা ভাত খেলে যে ঘুম পায়? কেন পায় জানেন? পান্তা ভাতের ভেতরে গাঁজন প্রক্রিয়ায় সেই অ্যালকোহলটাই খানিকটা তৈরী হয়, যেটা পান করা ইসলামে হারাম অর্থাৎ ইথানল। ভাত পেটের ভেতর গেলেও পরিপাক ক্রিয়ার জন্য সেখানেও অ্যালকোহল তৈরী হয়। হ্যা, তবে অবশ্যই সেটা অনেক নিম্নমাত্রায়। তাতে আমাদের বুদ্ধি লোপ পায় না, বা পান্তা ভাত খেয়ে আমরা মাতলামিও শুরু করিনা ঠিক আছে, কিন্তু তথাপিও এর ভেতর কিন্তু সেই অ্যালকোহলটাই থাকে যেটা নেশার দ্রব্য হিসেবে পান করা ইসলামে নিষিদ্ধ।
এখন এই করোনার আতঙ্কের মধ্যে hand sanitizer তো এখন আর পাওয়াই যাচ্ছে না। মানুষ, ডাক্তার সবাই দেদারসে ব্যবহার করছে। এই হ্যান্ড স্যানিটাইজারের মূল উপাদান কি একটু দেখুন তো! IPA বা আইসো প্রোপাইল অ্যালকোহল। এটাকে বিভিন্ন মাত্রায় পানিতে মিশিয়ে তৈরী করা হয় জীবানুনাশক তথা হ্যান্ড স্যানিটাইজার। এটা কিন্তু দুই ডিগ্রী অ্যালকোহল! তো সেই কারণে কি আপনি এটার ব্যবহার ছেড়ে দিবেন? এটা কি হারাম হল, শুধু ওই অ্যালকোহল নামটার জন্য? স্পিরিট নামধারী যে সমস্ত জিনিস আমরা ব্যবহার করি, সেগুলা কি? সেগুলা কি অ্যালকোহল নয়? সেদিন লিফট দিয়ে নামার সময় একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলা আমাদের বলছিলেন, উনি অ্যালকোহলের কারণে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করেন না, উনি বরং বাসায় গিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিবেন! আমি পাশে দাঁড়িয়ে একটু হাসলাম। কারন আমি জানি সব জায়গায় জ্ঞায় বিলিয়ে লাভ নেই। আমার বলতে ইচ্ছা করছিল, ম্যাডাম আপনি কি গ্লিসারিন ব্যবহার করেন না? গ্লিসারিন কি জানেন? সেটাও কিন্তু এক ধরণের অ্যালকোহল! কাজেই আমি বলবো, আমাদের ধর্মীয় অনুশাসন যেমন সুন্দর করে মেনে চলা উচিত উদার মনে, ঠিক তেমনি ভাবে কঠোর ভাবে সমস্ত ধরণের অজ্ঞতা এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি পরিহার করা উচিত। এজন্য ধর্ম সম্পর্কে উত্তমরুপে জানা সবার জন্যই আবশ্যক এবং এর সাথে কিঞ্চিত বিজ্ঞানের জ্ঞান থাকাও আবশ্যক। কারণ, অল্পবিদ্যা সেটা যে বিষয়ের উপরেই হোক না কেন, সেটা মানুষের বিপদ ডেকে আনতে পারে।