‘প্রতিশোধ’ যে সবসময় নিজেকে নিতে হবে এমন কোন কথা নেই। আমাদের মধ্যে বা বলতে হয় অনেকের মধ্যেই প্রতিশোধ গ্রহন করার প্রবনতা থাকে। থাকতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু এই প্রতিশোধ গ্রহনে বাড়াবাড়ির পরিণাম ভাল হয় না। অনেক সময় মন অক্ষম আক্রোশে ফুঁসতে থাকে প্রতিশোধ গ্রহন করার জন্য কিন্তু হয়ে ওঠে না। আর এই প্রতিশোধ গ্রহন করার চিন্তা তখনই হয় যখন মানুষ মনে করে তার সাথে অন্যায় করা হল। বিশেষ করে ইচ্ছাকৃত অন্যায়। ক্ষমতার অভাবে মানুষ অনেক সময় প্রতিশোধ নিতে পারে না। তখন সেই প্রতিশোধ যখন সৃষ্টিকর্তা তাঁর পক্ষ থেকে নিয়ে নেন, সেটা যারা বুঝতে পারে, তারা তখনও অনেকেই চুপ থাকে। আমি কিছুটা এই দলে পড়ি। আমি আমার সাথে ঘটে যাওয়া অনেক কিছুই নির্বিবাদে মেনেই নেই। নিজের অক্ষম আক্রোশে নিজেই চুপ থাকি আর যা বলার তা প্রার্থনা করে শুধু সেই মহান সত্ত্বার কাছেই বলতে থাকি। কিছুদিন আগে আমার এক খুব কাছের এক বন্ধু আমাকে শিখিয়েছে Revenge is best taken when served cold. একথা বলার পরে বলেছে, তুই চুপ থাকবি। এমন ভাবে চুপ থাকবি যেন অন্যপক্ষ তোর নৈঃশব্দ্যের আগুনে নিত্য দাহিত হতে থাকে। আমি এখন সেটাই করি আর সৃষ্টিকর্তার খেলা দেখি। আমি আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা সংক্ষেপে শেয়ার করবো।
বিদেশ থেকে আসার পরে একাদিক্রকে যখন আমার বেকার জীবন চলছিল প্রায় টানা দুই বছর, তখন কিছুটা সময় কাটাতে আর কিছুটা হাত খরচ ওঠাতে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে একটা কোচিং সেন্টারে পদার্থবিদ্যার ক্লাস নিতাম। এক ঘন্টার ক্লাস। এক একটা ক্লাসের জন্য পেতাম ৭০টাকা করে। হাসবেন না! সেই সময়, উচ্চশিক্ষিত একজন বেকারের কাছে মানুষের ঠোকর খাওয়া আর কথা শোনার চেয়ে ৭০টাকা ক্লাস প্রতি নেয়া আমার কাছে অনেক অনেক ভাল ছিল। জীবনে কখনই ভুলবো না, সেই কোচিং সেন্টারটাই ছিল আমার শিক্ষক জীবনের হাতেখড়ি। সেখানে থেকে আমি এমন এমন কিছু ছাত্র ছাত্রী পেয়েছি যাদের সাথে আজও আমার সুসম্পর্ক বিদ্যমান আছে।
এক বছর পরের কথা। ২০১৪ সালের এপ্রিল মাস। আমার প্রথম সন্তান আসার ঠিক এক মাস আগের সঙ্গীন মূহুর্তের কথা। ডাক্তার বলে দিয়েছে স্ত্রীর নরমাল হবার সম্ভাবনা প্রাকৃতিক ভাবেই কম। মাথায় অনেকটা আকাশ ভেঙ্গে পড়ার যোগাড়, কোথায় পাব এতগুলো টাকা? এমন সময় একটা ফোন এল। খুব সন্মানের সাথে কথা বলছে আমার সাথে। ঠিক চিনতে পারলাম না, কে। নাম বললো, মতিউর (ছদ্মনাম)। আমাকে আরেকটা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেবার অফার দিল। সেই কোচিংটা হল, মিরপুরের এক স্বনামধন্য গার্লস স্কুলের এক ততোধিক স্বনামধন্য(!) ইংরেজী শিক্ষক জনাব আব্দুল মান্নানের (ছদ্মনাম)। সেই কোচিং সেন্টারের নামও আমার এখন আর মনে পড়ে না। কারণ সেটা বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক আগেই। সেই কোচিং এ মতিউর নিজে অ্যাকাউন্টিং এর ক্লাস নেয়। আমাকে নিতে বলে হল, পদার্থবিদ্যার ক্লাস। আমি সরল ভাবেই জিজ্ঞাসা করলাম, আমাকে কত করে দেয়া হবে? মতিউর অমায়িক ভাবে আমাকে প্রতিজ্ঞা করে বললো, আপনি একদমই চিন্তা করবেন না ভাই, আপনি আসেন তো আগে। এখন যা পান আমি প্রতিজ্ঞা করছি তার চেয়ে বেশী করে দেয়া হবে, এই ব্যাপারে নিশ্চিত থাকেন।
অভাবের সময় সব প্রলোভনই বিশ্বাস হয়ে যায় সহজে। আমারো সেটাই হল। খুব সহজেই পটে গেলাম মতিউরের কোথায়। আমার চেয়ে অনেক ছোট হওয়া সত্ত্বেত আমি তাকে সন্মান জানিয়ে ‘ভাই’ সম্বোধন করতাম। গিয়ে মাত্র দুইটা ক্লাসে কিছু ছাত্র ছাত্রী পেয়েছিলাম। ওদের শিক্ষার মান অনেক নিচুমানের ছিল। দুই তিনটা ক্লাস নেয়ার পরে দেখি সায়েন্স এর আর কেউ নেই, শুধু একটা মাত্র মেয়ে আছে। আমি বললাম, আমি কি করবো? মতিউর আমাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বললো, আপনি চিন্তা করবেন না, আপনি এরই ক্লাস নিতে থাকেন, আপনাকে ঐ কোচিং সেন্টারের চেয়ে বেশীই দেয়া হবে। সর্বসাকুল্যে ১৮ টার মত মনে হয় ক্লাস নিতে পেরেছিলাম।
এর মধ্যে আমার মেয়েটার জন্ম হলো। ১৮টা ক্লাস নেয়ার পরে যখন আমার পেমেন্ট দেয়ার সময় হল, তখন এই মতিউর আমাকে ঘুরাতে লাগলো। এখন আসেন, তখন আসেন, ঐ সময় আসেন। এভাবে চলতে লাগলো দিনের পর দিন। আমি হাল ছাড়িনি, কারণ এটা যে আমার পারিশ্রমিক! এভাবে প্রায় ৫ মাস হয়ে গেল। মতিউর আমার টাকার কোন ব্যবস্থা করে না। এর মধ্যে কোচিং প্রায় উঠে যায় যায় অবস্থা। এমন একটা সময় আসলো, মতিউর আমার ফোন ধরা বাদ দিয়ে দিল। ফোনের পর ফোন দিতাম আমার ফোন ধরতো না। হয়ত অনেক পরে ফোন ধরে নির্বিবাদে কথা ঘুরিয়ে দিত। বস নেই। বস আসুক, এরপর আপনার টাকাটা সেটল করে দিব। এমন চলতে লাগলো দিনের পর দিন।
আমি ধৈর্য হারালাম না। চেয়েই যেতে থাকলাম। মতিউর আমাদের বাসার দুই বাসা পরেই ভাড়া থাকতো। আমি কোনদিনও ওর বাসায় যাইনি বা টাকার জন্য তাগাদা দেই নি। ধৈর্য ধরে অনেক টাকা মোবাইলে খুইয়ে মতিউরের কাছেই টাকার কথা বলতে থাকলাম। মনে আছে, একদিন কোন একটা সুপারিশের জন্য আমি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছিলাম। যার সাথে দেখা হবার কথা তার আসার দেরী ছিল দেখে আমি রেজিস্ট্রার বিল্ডিঙের মাসজিদে বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। সেই মাসজিদে বসেও আমি মনে হয় ৩০টার উপরে কল দিয়েছিলাম মতিউর কে। মতিউর ফোন ধরে নাই। আমি মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বাসায় এসে আমার স্ত্রীর কাছে বলতাম। ও আমাকে বলতো ধৈর্য ধর। যা হোক, প্রায় ৫ মাস পরে, মতিউর জানালো (সেটাও আমি বারংবার ফোন দেয়ার পরে), ওমুক সময় আসেন। আপনার পেমেন্ট করে দিব। আমি সবকিছু ভুলে সময়মত গিয়ে হাজির হলাম আপাদমস্তক ঘামে ভিজে। ওইদিনই সেই কোচিং সেন্টারের মহান পরিচালকের(!) দেখা পেলাম।
লুঙ্গি আর শার্ট পরে হাজির হলেন শিক্ষক আব্দুল মান্নান। মতিউর তার সামনে নির্বিকার ভাবে দাঁড়ানো। ঐ শিক্ষক, আমার প্রতি ন্যুনতম সৌজন্যবোধ দেখানোর দরকার মনে করলেন না। শিক্ষাগত যোগ্যতায় আমি যে তার থেকেও উপরের ডিগ্রি অর্জিত ছিলাম, সেটা একজন শিক্ষক হয়েও ভ্রুক্ষেপ করলেন না। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কয়টা ক্লাস নিসেন? আমি বললাম। উনি মতিউর কে ডেকে নিয়ে তার হাতে আমার ‘মজুরি’ ধরিয়ে দিলেন। যেই টাকার পরিমান আমার প্রথম কোচিং সেন্টার থেকেও অনেক কম ছিল। আমি টাকা গুনে মতিউর কে বললাম, মতিউর ভাই এ কি? আপনি না বলেছিলেন, আমাকে সেই কোচিং থেকে আরো বেশী টাকা দেয়া হবে। মতিউর অনেকটা ভাবলেশহীন হয়ে আরেকদিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি তখন যদি কিছুটা অর্থনৈতিক দৈন্যতার মধ্যে না থাকতাম, তাহলে সেই টাকা তৎক্ষণাৎ ছুঁড়ে ফেলে দিতাম মতিউরের মুখের উপরে। বলতে পারেন, অভাবের কারণে পারিনি। কারণ তখন সেই ১৮টা ক্লাস নেয়ার জন্য আমাকে সামান্য কটা টাকা দেয়া হয়েছিল, সেটাই আমি পকেটে ভরে, নিজের সব রাগ ক্ষোভ হজম করে বের হয়ে এসেছিলাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বার কয়েক পেছন ফিরে তাকিয়েছিলাম ঘৃণার সাথে।
এর অল্প কিছুদিন পরেই আমি একটা স্বনামধন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চাকরী পেয়ে যাই যেখানে আমি একাধারে সাড়ে তিন বছর সন্মানের সাথে শিক্ষকতা করেছি। সেই সাড়ে তিন বছরে স্কুল থেকে আসা যাওয়ার পথে বেশ কয়েকবার মতিউরের সাথে দেখা হয়েছে। আমি অমায়িক হাসি দিয়ে মতিউরের খোঁজ খবর নিতাম! সেই সাড়ে তিন বছরেও মতিউরের কোন চাকরী হয় নাই। আমাকে দেখেই মুখ কালো করে ফেলতো। আমি অমায়িক হাসি দিয়ে চলে আসতাম। ঘটনার এখানেই শেষ নয়।
আমার দ্বিতীয় চাকরীর মেয়াদ প্রায় বছর খানেক হয়ে গেছে তখন। আমার পোষ্ট তখন আরো উপরের দিকে সৃষ্টিকর্তার কৃপায়। একদিন আমার আর আমার এক ছাত্র ভার্সিটি থেকে বের হয়ে রাস্তার এক দোকানে বসে আছি বেঞ্চের উপরে বাসের অপেক্ষায়। বাস আসলে আমি আর ও উঠে যাবো। আমি চোখে সানগ্লাস পরা। এমন সময় দেখি মতিউর আসছে হেঁটে হেঁটে। আমার সামনে এসে যখন মুখোমুখি হয়ে গেল, তখন আমি আবার অমায়িক হাসি দিয়ে বললাম, আরে মতিউর ভাই যে! কেমন আছেন ভাই? কোথায় আছেন? কই জব করছেন? ইত্যাদি। সে জানাল, তার এখনও জব হয় নাই। মুখটা কালো হয়ে গেল। আমাকে বললো আপনি কি করছেন? আমি পেছনের বিল্ডিঙে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে ওখানে আমার বর্তমান শিক্ষকতার কথা জানালাম। মতিউর বললো, ও আপনি এই ভার্সিটির লেকচারার? আমি আরো অমায়িক হাসি দিয়ে বললাম, না ভাই লেকচারার না, আমি এই ভার্সিটির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। আমার গলায় ঝুলানো আইডি কার্ড নিজেই টেনে নিয়ে মতিউর পড়ে দেখলো। মনে হয় নিশ্চিতই হতে চাইলো কিনা? আমি অমায়িক হাসিটা ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখলাম।
এরপর মতিউর বিদায় নিয়ে সামনে হেঁটে যেতে লাগলো। আমি তার গন্তব্য পথের দিয়ে সানগ্লাস পরা চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে নিচ্ছিলাম। আচমকা আমার ধ্যান ভেঙ্গে গেল যখন আমার পাশে বসা ছাত্রটা বলে উঠলো, স্যার আসেন, বাস চলে আসছে।