সেই তো বন্ধই হয়ে গেল সরকারী ঘোষনার মাধ্যমে। তবে আমদের শিক্ষকদের কি হবে, আমাদের যেতে হবে কিনা, সেটা এখনও জানি না। সবকিছু কেমন যেন আগোছালো লাগছে। অনেকগুলো পরীক্ষার খাতা জমে ছিল। সব বাসায় নিয়ে আসছি। ঘর থেকে বের হতে বারণ করা হচ্ছে। এককথায় গৃহবন্দী টাইপ। কিন্তু কতক্ষণ? সৃষ্টিকর্তাই শুধু জানেন এর শেষ কোথায়। ছোটবেলায় শুনেছি, নাটকে দেখেছি, বইতে পড়েছি মহামারীর কথা। এখন সেই জিনিষ ঘরে বাইরে দেখতে হবে সেটা কিন্তু আসলেই কখনও চিন্তা করে দেখিনি। আর চিন্তা করেই বা কি করতে পারি? যতটুকু সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার সেটুকু না হয় করলাম, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে কি হতে যাচ্ছে সেই বিষয়ের উপরে আমাদের না কোন জ্ঞান আছে, না কোন ক্ষমতা আছে।
আমরা যে আসলেই কত অসহায় সেটা মনে হয় উপলব্ধি করার সময় এসেছে। মানুষ যত বেশী জ্ঞান অর্জন করতে থাকে, তত বেশীই উপলব্ধি করতে থাকে আসলে যে সে কিছুই জানে না। যেই বিজ্ঞান নিয়ে সারাজীবন পড়ালেখা করে আসলাম, এখন আমি বুঝি, আমি এর কিচ্ছু জানি না! একদমই কিচ্ছু না! সেদিন ছাত্রদের বলেছিলাম, তোমরা ভেব না আমি তোমাদের চেয়ে অনেক বেশী কিছু জানি। আসলে তা নয়। বরং তোমরা যা জানো সেটুকুর সাথে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার নির্যাস মিশিয়ে দেই।
ছাত্র-ছাত্রীদের মন কতটা সরল! আগামী পরশু ওদের ক্লাস টেস্ট নেয়ার কথা ছিল আমার। ওরা আমাকে অনেকেই এসে জিজ্ঞাসা করেছে, স্যার ক্লাস টেস্ট কি হবে? আমরা কি আসবো? কি উত্তর দেব আমি এর? মানুষ যেখানে মৃত্যুভয় নিয়ে অস্থির সেখানে আমার বাচ্চাগুলা, সরল মন নিয়ে চিন্তা করছে কি পরীক্ষা দেবে! ওদের কত নাম্বার উঠবে। ওদের ভবিষ্যৎ কি! ওদের দোষ কেন দেব? ওদের এই মানসিকতা তো আমরাই তৈরী করে দিয়েছি দিনের পর দিন। ওদের সরল মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার ভীষণ খারাপ লেগেছে। বলেছি, চিন্তা করো না। আমরা সময় মত জানিয়ে দেব। ছাত্র ছাত্রীদের প্রতিষ্ঠানে আসা বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। আমাদের মুখে এই কথা শুনে ওরা শুকনা মুখে বিদায় নিয়েছে। তখন আমার নিজেকে সেই মায়ের মত মনে হয়েছে, যার কাছে তার সন্তানরা এসে খাবার চেয়েছে, কিন্তু ঘরে এক দানা খাবারও নেই। দারিদ্র্য ছেয়ে গেছে সবখানে।
নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক Gabriel García Márquez লিখেছিলেন বিখ্যাত উপন্যাস “Love is in the time of Cholera”। এটার উপরে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। আর আমাদের অবস্থা হল এখন Locked in the time of Corona। দিন দিন অবস্থা যা শুনছি, তাতে তো চিন্তিত না হয়ে উপায় নেই। আমরা বাংলাদেশীরা, যাদের এক অনেক বড় অংশ এই ভাইরাস সম্পর্কে কিছুই জানে না, কি নিয়ে আমরা এগিয়ে যাব? সৃষ্টিকর্তার অপার করুনা রাশির দিকে তাকিয়ে, আমাদের প্রতীক্ষা করা ছাড়া আর কিই বা করতে পারি? আমদানি বন্ধ আছে অনেক দেশ থেকেই। আমার বাচ্চার জন্য যে দুধ কিনতাম, সেটিও স্টক আউট হয়ে গেছে। ওকে এখন অন্য কিছু খাওয়ানোর কথা চিন্তা করতে হচ্ছে। এমন তো শুধু আমি না, নিশ্চই আমার মত আরো অনেক পিতা মাতাই অনিশ্চিতের দিকে চাতক পাখির মত তাকিয়ে আছে। সবার এখন একটাই ঐকান্তিক প্রার্থণা, এই অবস্থা কবে শেষ কবে?
সবাই শুধু হাত ধুয়ে ফেলার কথা বলছে। আমি তার কোন বিরুদ্ধাচরণ করছি না। শুধু আপনাদের সবার কাছে আমি এই অধমের সনির্বন্ধ মিনতি, হাত ধুয়ে নিন ভাল করে আর আপনাদের সেই পরিষ্কার হাতগুলো, সেই মহান সত্ত্বার সামনে তুলে ধরুণ, আর কায়মনোবাক্যে সবাই বলুন, ‘প্রভু! আমাদের এই মহাবিপদ থেকে নিষ্কৃতি দাও। আমরা সর্বত ভাবে অসহায়’।