স্ট্রবেরী (Strawberry) এর বাংলা কি, বা আদৌ কোন বাংলা হয় কিনা আমি জানি না। খেতে টক স্বাদের এই ফলটা খেতে যতটা না ভাল আমার কাছে দেখতে তার চাইতে অনেক বেশী সুন্দর। সেই আশির দশক থেকে, আমার চোখে দেখা সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত যে ফলের ফ্লেভার ব্যবহার সবচেয়ে বেশী দেখেছি সেটা এই স্ট্রবেরীরই। সৌদি আরবে যখন স্ট্রবেরী দেখতাম টিভিতে, তখন আমার কাছে স্বপ্নের মত লাগতো। এই ফল কি আদৌ পৃথিবীর কোন ফল! এত সুন্দর! কি টুকটুকা লাল! এটা কি জীবনে কোনদিন খেতে পারবো? না জানি কত মিষ্টি হবে! কত কিছু ছিল কল্পনায়। স্ট্রবেরী তো পেতাম না সেই ১৯৯৮ সালে সৌদিতেও, অগত্যা স্ট্রবেরী ফ্লেভারের আইসক্রিম কিনে কিনে খেতাম। আইসক্রিম যেহেতু খুব মিষ্টি মিষ্টি লাগতো, তাই তখন ধরেই নিয়েছিলাম আহারে, স্ট্রবেরী না জানি কত মিষ্টি! এই জীবনে কি কোনদিন খাওয়া হবে?
প্রথম কবে স্ট্রবেরী খেয়েছিলাম সেটা একটু পরে বলছি। গত বছর আমার স্ত্রী আর বোন যাবে গাউসিয়া মার্কেটে কিছু কিনতে। গাড়ী পার্ক করা হল ঢাকা কলেজের উল্টা দিকের পেট্রোল পাম্পের ভেতরে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে। আমি বের হয়েই দেখলাম, এক ফেরিওয়ালা ভাই, এক ঝুড়ি স্ট্রবেরী কেটে কাসুন্দি দিয়ে মাখিয়ে বিক্রি করছে। যেহেতু টক ফল আমার খুব প্রিয়, তাই দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। বিশ টাকার স্ট্রবেরী ‘মাখা’ অর্ডার করে ফেললাম। উনি কাসুন্দি, মরিচ, লবন দিয়ে অনেকটা বেত-ফল ঝামানোর মতে করে ছোট একটা বয়ামে আমাকে কয়েকটা স্ট্রবেরী কেটে টুকরো করে মাখিয়ে কাগজে দিলেন। সাথে দিলেন একটা দাঁত-খিলাল অর্থাৎ টুথ-পিক যা দিয়ে টুকরো গুলা খেতে পারবো। ইদানিং রাস্তা ঘাটে আমড়া, পেয়ারা, আনারস এসব খেতে টুথ-পিকের ব্যবহার চোখে পড়ার মত। আমি একটা একটা টুকরা মুখে দিয়ে স্ট্রবেরী মাখা খেতে লাগলাম। সেই ফল! যা ছিল আমাদের কাছে স্বপ্নের কাছাকাছি একটা অন্যভুবনের ফল, সেই ফল এখন রাস্তাঘাটে মেখে খাওয়া হচ্ছে।
আমার মেয়ে কিছুদিন ধরে বায়না করছে, তার স্ট্রবেরী খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। বললাম কিনে দেব। যখন ও খেতে চেয়েছিল, তখনও বাজারে ওঠেনি। ওকে বললাম, চোখে পড়লেই কিনে দেব। কাল যখন অফিস থেকে বাসায় ফিরছিলাম, তখন বাস থেকে নেমেই দশ নাম্বার ফলপট্টীর দিকে চোখ যেতেই দেখলাম ঝুড়ি ভরে ভরে ফল ব্যবসায়ীরা স্ট্রবেরী বিক্রি করছে। মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল। কিনে নিলাম ওর জন্য খানিকটা। আমার শৈশবের সেই স্বপ্নের ফল এখন দেদারসে ঝুড়িতে করে বিক্রি হচ্ছে এবং বাংলাদেশে রীতিমত চাষাবাস শুরু হয়ে গেছে আরো কয়বছর আগে থেকেই।
২০০৬ সালে আমার বাবা প্রথম যখন ইংল্যান্ডে বেড়াতে গেলেন, তখন আমি টেলিফোনে বলেছিলাম, যদি সম্ভব হয় তাহলে আমার জন্য একটু ‘স্ট্রবেরী’ আর ‘চেরী’ নিয়ে এস। নিশ্চই বুঝে গেছেন, ২০০৬ সাল অর্থাৎ যখন আমি প্রকৌশন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র, তখন পর্যন্ত আমার স্ট্রবেরী খাওয়া হয় নি। মনের মধ্যে সুপ্ত বাসনা থেকেই গিয়েছিল। আব্বু এনে দিয়েছিলেন দুই ফল এক এক ছোট বক্স করে। এখন যেমন সুপার শপ গুলাতে বিক্রি হয় তেমন। সেই প্রথম আমার স্ট্রবেরী মুখে দেয়া। টক টক! সেই প্রথম জানলাম স্ট্রবেরী আসলে পেকে গেলেও মিষ্টি হয় না। আব্বু জানালো, ইংল্যান্ডের বাংলাদেশীরা স্ট্রবেরী দিয়ে চাটনি বানায়ে খায়। আমরা যেমন টমেটো দিয়ে করে থাকি। ঐ আমার প্রথম স্ট্রবেরী খাওয়া। তখন এক প্রতিবেশী ছোটভাই অসুস্থ ছিল। ওকে দেখতে গিয়েছিলাম, তখন ওর জন্য হাতে করে স্ট্রবেরী আর চেরী নিয়ে গিয়েছিলাম।
এখন যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটি আর ঝুড়ি ভরা স্ট্রবেরী দেখি, তখন শৈশবের সেই স্মৃতি মনে পড়ে। আগে যেটা স্বপ্নের মত ছিল, এখন সেটা হাত বাড়ালেই কিনতে পারি বা খেতে পারি। কিন্তু ইচ্ছেটা আর সেই আগের মত নেই। সবকিছুই বদলে গেছে। বদলে গেছে স্ট্রবেরী খাওয়ার সেই অদম্য ইচ্ছেটাও।