৫ মার্চ ২০২০

পরিবর্তন জীবনের একটা স্বাভাবিক রীতি। তারপরেও কেমন যেন সেটা মানতে মন চায় না। অনেক সময় মনের উপর অনেক জোর করেই পরিবর্তন মানতে হয়। দীর্ঘদিন কারো সাথে থাকতে থাকতে অথবা, কোন জিনিস দেখতে দেখতে কেমন যেন একটা মায়া পড়ে যায়। সবকিছুর সাথে কেমন যেন স্মৃতি জড়িয়ে যায়। নিজেকে সেটার একটা অংশ বলে মনে হয়। কিন্তু এরপর সময় যখন অতিবাহিত হয়ে যায় তখন সেটাকে ছেড়ে অন্য কোথাও যখন চলে যেতে হয়, তখন মনের ভেতর থেকে কেমন যেন একটা কষ্ট গুমরে ওঠে। এটা কাউকে বলে বোঝানো যায় না। কেউ এটা দেখতে পায় না। শুধু যার হয় সেই সেটা বোঝে।

 

২০১৩ সালের জানুয়ারী মাসের কথা। আমার থিসিস জমা দেয়া হয়ে গেছে। সিঙ্গাপুর থেকে বিদায় নেবার চুড়ান্ত ক্ষণ যখন এসে গেল, তখন সবসময় কেমন যেন মায়া পড়ে যাচ্ছিল। আমার সেই ল্যাব, যেই ল্যাবে আমি রাতের পর রাত, মাসের পর মাস কাটিয়েছি। কাজ করেছি, মুভি দেখেছি, খেতে গিয়েছি, বেড়াতে গিয়েছি, সবকিছুই ছিল আমার সেই ল্যাব কেন্দ্রিক। ল্যাবের কাজ গুছিয়ে সবকিছুর প্ল্যান করতে থাকি। আমার ল্যাবের নাম্বার ছিল E4A-07-07। এখনো ভুলি নাই, ভোলা যায় না। আমার কাজের শেষের ভাবেই নতুন একজন সহকারী অধ্যাপক নিয়োগ পেয়ে চলে আসলেন। আমাদের সেই ল্যাব চলে যাবে এখন নতুন অধ্যাপকের অধীনে।

 

দেশে চলে আসার দুইদিন আগে ল্যাবের সব কেমিক্যাল ফেলে দিতে হবে। ল্যাব অফিসার Jamie Siew চলে আসলেন। এই জ্যামির সাথে আমাদের সবসময় অম্ল-মধুর সম্পর্ক ছিল। এখনও মনে পরে জ্যামির কাঠখোট্টা সেই চেহারাটা! আরেকজন ছিল Sylvia Wan। সিলভিয়া বেশ গল্পবাজ ছিল। কিন্তু জ্যামি ছিল কম কথার মানুষ। যা বলার তা বলতোই। জ্যামি ল্যাবে এসে হাতে গ্লাভস পরে আমাকে নির্দেশ দিচ্ছিল, এটা ফেলে দাও, ওটা ফেলে দাও! একের পর এক কেমিক্যাল গুলা যখন Disposal Bottle এ ফেলে দিচ্ছিলাম তখন আমার কলিজার মধ্যে ছ্যাত ছ্যাত করে উঠছিল। সেই ফেরাস ক্লোরাইড, ফেরিক ক্লোরাইড যেগুলো ছিল আমাদের সমস্ত গবেষণার প্রাণ, সেগুল যখন বোতল ধরে ধরে ফেলে দিচ্ছিলাম, আমার রীতিমত কান্না পাচ্ছিল। Standard Solution গুলা যখন বোতল ধরে ধরে ফেলে দিচ্ছিলাম, তখন জ্যামিকে রিতিমত অনুনয় করে বলেছিলাম, জ্যামি এগুলা থাকুক না প্লিজ? এগুলো রেখে দেই? আমার করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে জ্যামি হেসে ফেলেছিল। আমাকে বলেছিল, Zayed, I understand, you love your chemicals very much and they are like your children. I know what you are feeling now, but you have to understand. You have to adjust. জ্যামির সেই সুন্দর কথাগুলো এখনও মর্মে মর্মে অনুধাবন করি। আসলেই, we have to understand, we have to adjust but sometimes this understanding and adjusting is difficult than anything.

 

এবার চলে আসি আমার বর্মানে। আজকেই অফিসে গিয়ে প্রথম নতুন কামরায় বসলাম। বইগুলো সাজালাম আবার নতুন করে। ওরা যেন নতুন রুপে আমার কাছে ধরা দিল। টেবিল গোছালাম। কিছুক্ষণ পরে সেই আপা আসলেন, যিনি বিগত ১৫ বছর ধরে এই রুমে আমার সিটের জায়গায় কাটিয়ে এখন অন্য ফ্লোরে চলে গেলেন। দেয়ালে কিছু ছবি আর শো-পিস টাঙ্গানো ছিল। আপা যেই চোখে সেগুলো দেখছিলেন, সেই দৃশ্য ভোলার না। বললেন, আমি এগুলো নিয়ে যাব। আমি ঠাট্টা করে বললাম, আপা আমাকে কিছু দিয়ে যান, এগুলো তো আমিও পছন্দ করি। আপা খুব দুঃখ করে বললেন, ‘আমাকে ক্ষমা করে দিও ভাই। আমি পারবো না’। আমি আর কথা বাড়ালাম না। বললাম, আপা আপনার যেভাবে সুবিধা হয় আপনি নিয়ে যেয়েন। মাঝে মাঝে আইসেন আপা। উনি আক্ষেপ করে বললেন, নাহ আমি আর এই তালায় আসবো না! কথাগুলা আমার মনের ভেতরে গিয়ে আঘাত করলো। আমি আমার কামরাটা মাত্র দেড় বছর ব্যবহার করে ছেড়ে আসতে গিয়ে আমার খারাপ লেগেছে, তাহলে উনার কেমন লেগেছে? ১৫ বছরের সম্পর্ক এক মুহুর্তে শেষ?

 

আমরা মানুষ! আমরা আসলে অনেক কিছুই পারি কারণ আমাদের অনেক কিছুই পারতে হয়। এখানে আমরা নিজেদের দরকারে যেমন নানা রকম সম্পর্কের অন্তর্জালে জড়িয়ে পড়ি তেমনি আবার সেইসব সম্পর্ক মুহুর্তের মধ্যে পরিবর্তন করতে কিংবা নষ্ট করতে আমরা অনেকেই দ্বিধান্বিত হই না। সম্পর্ক! আসলেই কি সম্পর্ক বলে কিছু আছে? আমার এখন সন্দেহ হয়। সম্পর্ক আসলে কি? কয়েকদিন থেকেই আমি ভাবিত হচ্ছি। ইদানিং মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে, সম্পর্ক বলে আসলে কিছুই নেই। অলীক একটা ধারণা যার পেছনে আমরা ছুটে ছুটে নিজেদের ভুলে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমাদের মধ্যে ভর করে হতাশা। সবছেয়ে ঠুনকো মনে হয় আমাদের পারস্পারিক সম্পর্ক! আর খুব সহজেই মনে হয় ভেঙ্গে দেয়া যায় মানুষের মন। আর কিছু না। মন ভেঙ্গে ফেলার চেয়ে কোন কিছুই আর মনে হয় এত বেশী সহজ না। মন ভেঙ্গে ফেলাই সবচেয়ে সহজ।   

View shawon1982's Full Portfolio