৩ মার্চ ২০২০

‘শতপদী’ যেটাকে ইংলিশে Centepede বলে, দেখেছেন নিশ্চই? আপনি যদি পতঙ্গ প্রেমিক না হয়ে থাকেন, তাহলে শতপদী দেখে আহ্লাদিত হবেন না নিশ্চই। আমিও হই না। শতপদী কে আমাদের বাসায় অথবা আঞ্চলিকতায় ‘চ্যালা’ বলা হয়। দেখলেই আমার সারা গা শিউরায়ে ওঠে। এতগুলো পা দিয়ে কিভাবে কিলবিল করতে করতে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ছুটে চলে যায় কোন গোপন কোনায়। আমাদের বাসাবাড়িতেই হঠাৎ হঠাৎ এদের উদ্ভব হয়। এটাকে দেখামাত্রই মেরে ফেলার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে সবাই। এটি কি বিষাক্ত? হয়ে হয়ত। আমি জানি না। কিন্তু ঘরে হঠাৎ করে সাপ দেখে ফেললে মানুষের যে প্রতিক্রিয়া হয়, শতপদী বা চ্যালার ক্ষেত্রেও আমি অনেকটাই সেটাই দেখেছি।

 

দুই তিনদিন আগেই, আমি আমার শ্বশুরালয়ের দোতলায় অবস্থান করছিলাম কিছুটা বিশ্রাম নেব বলে। দুপুরের খাবারের পরে শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ করে নিচে থেকে আমার স্ত্রী আর শালিকার তীক্ষ্ম চিৎকার শুনে আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। নীচে নিশ্চই ভয়ঙ্কর কিছু হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এসে দেখলাম, আমার শালিকা ছিটকে আরেক রুমে চলে গেল ভীষণ ভয়ার্ত মুখে, ভাতের থালা টেবিলে রেখেই। ও ভাত খাচ্ছিলো। আমার স্ত্রী তখনো, বাসার ছোট মেয়েটাকে হম্বিতম্বি করে চলেছে, ঐদিকে দেখ, এদিকে দেখ, গেল কই? এই জাতীয় কথাবার্তা। কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই শুনলাম, বড়ো একটা চ্যালা আমার শালিকার ভাতের থালার সামনে দিয়ে দৌড়ে চলে গেছে। এখন আর সেটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

 

লে! আমি ত হতবাক! কই গেল সেটা? ওটাকে না মারতে পারলে তো সবার ঘুম হারাম হয়ে যাবে! চলছে খোঁজাখুঁজি। আর কি সহজে পাওয়া যায়? কোথা থেকে কোথায় দৌড়ে পালিয়ে গেছে ওটার শত-পা দিয়ে। আমরা কিছুটা হতাশ। আমার স্ত্রী বলেই চলেছে, ঘরে এতগুলা বাচ্চা আছে, ওদের কামড় দিলে কি হবে না হবে এইসব! এমন সময় আমার মেয়ে চিৎকার করে উঠলো, ঐযে ঐযে! টেবিলের নিচ থেকে বের হয়ে দৌড়ায়ে রান্নাঘরের দিলে যাচ্ছিল। আমিও দৌড় দিলাম। আমার শাশুড়ীর সাহায্যকারী খালাকে বললাম, দেখেন দেখেন কই যায়। আমিও রান্নাঘরে দেখলাম একটা টুলের পায়ার কাছে স্থির হয়ে আছে। বললাম, কিছু বইলেন না। গরম পানি দেন। খালা চুলা থেকে এক বাটি গরম পানি নিয়ে ছুঁড়ে দিল চ্যালা বরাবর! ব্যাস! সেকেন্ডের মধ্যেই চ্যালার ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে গেল। আমার স্ত্রী তখনো তারস্বরে চেচিয়ে চলেছে, আরো পানি মারেন! এগুলা সহজে মরে না। আবার বেঁচে উঠবে! অগত্যা আরো পানি দিয়ে ‘মরাকে মারা’ হল! এরপর বেলচায় করে সোজা বাইরে! শেষ হয়ে গেল আমাদের সেদিনের ভয়াবহ চ্যালা উপাখ্যান।

 

এটা একটা বিশেষ ধরণের পতঙ্গ ছিল। স্রষ্টারই এক সৃষ্টি। কতগুলো পা! আমরা মানুষরা এর চেয়ে কম কিসে? পার্থক্য শুধু আমাদের দুটা পা এই যা। আমরা মানুষরা কি চ্যালার চেয়ে কম ভয়ঙ্কর? কম বিষাক্ত? এই চ্যালাগুলো কখনও জানবে না, ওদের আমরা যতখানি ঘৃণা করি, তার চেয়ে আরো বেশী ঘৃণা আমরা মানুষরা একে অন্যকে করি। যে ঘৃণার কোন চৌহদ্দি হয় না। শুধুই নিরবিচ্ছিন্ন ঘৃণা। শতপদীর থাকে শত-পদ বা পা! আর আমাদের থাকে শত-রূপ, শত-স্বার্থ, আর শত-দ্বেষ! স্বার্থের বাইরে আমরা যেন কিছুই বুঝতে চাই না। স্বার্থে ঘা পড়লো তো সব শেষ। মুহুর্তের ভেতরেই শেষ। আপনার আগের সব কর্মকান্ড, ভালোবাসা সব ধূলিসাৎ হয়ে যাবে স্বার্থের কাছে এক লহমায়। আপনার করা ভালোবাসা পদানত করতে অন্যপক্ষ এক সেকেন্ড ও ভাববে না।

 

সবাই অন্যকে নিজের দিক থেকে বিচার করে ফেলে কিছুমাত্র তাকে না জেনেই। সবাই নিজের মত করে বুঝে। আমিও এখন সেটাই ভাবি, ভুল বোঝাবুঝি বলে আসলে কিছু নাই। আপনার যতই অবদান থাকুক না কেন, এক মুহুর্তে আপনাকে পর করে দিতে কেউ ডানে বায়ে তাকিয়ে দেখবে না। যে সম্পর্কের জন্য আপনি এতদিন অনেক আকাশ কুসুম ভেবে রেখেছেন, আসলে সেটা আদতে কিছুই না। কোন কিছুরই মূল্য নাই। সময় এসে গেছে শুধু নিজেকে নিয়ে চিন্তা করার। অন্যের স্বার্থের কাছে নিজেকে বলি দেয়া যাবে না আর। অন্যের জন্য নিজেকে বলি দিয়ে আর বিলিয়ে দিয়ে আপনি জীবনে কিছুই পাবেন না। বঞ্চনা আর গঞ্জনা ছাড়া কিছুই না। অন্যকে নয়, নিজেকে নিয়ে ভাবুন।  

View shawon1982's Full Portfolio