ডায়রী (Diary) লেখার অভ্যাস আমি অনেকবার করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। সেই স্কুল জীবন থেকেই। স্কুল জীবনে আমি সেবা প্রকাশনীর বইয়ের খুব ভক্ত ছিলাম। সেই তখনই আমি পড়েছিলাম সেবা প্রকাশনী থেকে বের করা অনুবাদ ‘অ্যানি ফ্রাঙ্কের ডায়রী’। বইটি পড়ে তখনই আমার কিশোর মনে খুব প্রভাব বিস্তার করেছিল। বইটি পড়ে আমি এতটাই প্রভাবান্বিত ছিলাম যে তখন থেকেই আমিও ডায়রী লেখার কথা চিন্তা করতাম। অ্যানি ফ্রাঙ্ক তার ডায়রীর নাম দিয়েছিল ‘কিটি’। ডায়রীকেই সে একটা বান্ধবীর মত কল্পনা করে, চিঠি লেখার মত করে লিখেছিল তার বিশ্ববিখ্যাত ডায়রীটা। আমারো ইচ্ছা হয়েছিল আমিও এমন একটা নাম নির্বাচন করে লেখা শুরু করবো। কিন্তু হয়ে ওঠে নি। এরপরেও বার কয়েক চেষ্টা করেছি। প্রতিবারই কিছু না কিছু লিখেছি। এরপর আবার যেই সেই! অর্থাৎ লেখা ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু এবার আমি অনেকটা নিশ্চিত সিধান্তে চলে এসেছি। ঠিক প্রচলিত ডায়রীর মত না হলেও প্রতিদিনের তারিখ দিয়ে দিয়ে লিখে যাব কিছু না কিছু। আমার এই লেখাটাও সেই ধারাবাহিক প্রচেষ্টারই অংশ বলতে পারেন।
এখন সেবা’র বই খুব একটা পড়া না হলেও ভালবাসাটা কিন্তু কমে যায় নি। এখনও সেবা প্রকাশনীর বই পেলে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। আমার স্ত্রী সারারাত হসপিটাল এ লেবার অবজারভেশনে। প্রেসার বেশী ছিল বলে ছাড়লো না। ডাক্তার আপা জানালেন সকালে সি-সেকশন (সিজার) অপারেশন করাতে হবে। এটা আমার দ্বিতীয় সন্তান জন্মানোর আগের রাতের ঘটনা। সারারাত হসপিটালে থাকতে হয়নি কারণ লেবার রুমে তো আমাকে যেতে দিবে না। আমার শ্যালিকা এসে আমাকে উদ্ধার করলো। আমি বাসায় চলে গেলাম কিন্তু পরদিন আবার খুব ভোরে আমাকে যেতে হবে কারণ হসপিটালের যাবতীয় লেনদেন আমাকে সমাধা করতে হবে। আমি ভোরে আবার হাজির হলাম। ডাক্তার আপার আসতে আরো বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগবে। আমার স্ত্রী চিন্তিত মুখে বের হয়ে আসলো। আমার ততধিক শুকনা মুখ দেখে বুঝতে পারছিল আমার আসলে বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নাই।
সময় কাটছে না। বাসার মানুষ আরো পরে আসবে। আমি কি করি? কি করবো? ওই আমাকে বললো, যাও বাইরে থেকে কোন একটা বই কিনে নিয়ে আসো। বসে বসে বই পড়। সময় কাটবে তোমার। আমি যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলাম! ফিসফিস বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তা পার হয়ে গিয়ে বাসস্ট্যান্ড এর একটা বইয়ের দোকান থেকে সেবা প্রকাশনীর একটা অনুবাদ কিনে আনলাম। এককালে যেই লেখকের লেখা মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়েছি। হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড এর বই ‘দ্য পিপল অফ দ্য মিস্ট’। ফিরে এসে পড়তে বসলাম। এটা এজন্য বললাম, যে সেবা প্রকাশনীর বইয়ের উপর আমার মোহ এখনও কমে নি। বইটা সেবা প্রকাশনীর ছিল। দেখুন, আমি কোথায় থেকে কোথায় চলে গিয়েছি। শুরু করেছিলাম ডায়রী লেখার প্রসঙ্গে। সেখান থেকে আমার স্ত্রীর লেবার রুমের সুত্র ধরে সেবা প্রকারশনীর অনুবাদে! মন আসলেই বিক্ষিপ্ত। কি বলতে চাই আর কোথায় চলে গেলাম! আচ্ছা বলছি কিছু একটা!
কিছুদিন আগে বিতর্কিত লেখক তসলিমা নাসরিনের একটা উক্তির অনুলিপি করেছিলাম আমার নিজের একটা লেখা। উনার সেই কথাটা আমার ভীষণ প্রিয়। সেটা হল, ‘আমার শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকেই আছেন, নিন্দুকও কম নন। সকলের জন্যি আমার শুভেচ্ছা’। তেমন করেই আমার আবার বলতে ইচ্ছে করছে, যারা আমার নিন্দা করতে ভালবাসো, তোমাদের জন্য আমার ভালোবাসা! আহারে! সামনা সামনি আমার লেখা পড়ার মন মানসিকতা তো দেখাতে পারো না সাহস করে, তাই লুকায়ে ছাপায়ে পড়তে হয় আমার লেখা। কারণ সেখান থেকে নিজেদের দরকারী খোরাক জোগাড় করতে হবেতো তাই না? বেশ! সাধুবাদ জানাই! আমি সত্যিই সাধুবাদ জানাই এবং সৃষ্টিকর্তাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। উনি আমার লেখার মধ্যে সবার জন্য না হোক, কতিপয় মুখোশধারী মানুষের জন্য আমার নিজের অজ্ঞাতসারে অনেক লেখার প্রয়াস দিচ্ছেন! আমার লেখা মানুষ গোপনে গোপনে লোক লাগায়ে হলেও পড়ব, সত্যিই আমার সৌভাগ্য। গোপনে প্রকাশ্যে যারা আমার লেখা পড়ে আনন্দ নিচ্ছেন অথবা রাগ হচ্ছে, সকলের জন্য আমার শুভেচ্ছা। আপনি রাগ হলে আমি দুঃখিত। আমার লিখতে ভালও লাগে। আপনার যেমন গোপনে পড়তে ভালও লাগে এবং সেটা হয়তো গোপনে মানুষের কাছা চালাচালি করতে ভালও লাগে, ঠিক তেমনি আমার ভালও লাগে আমার মনের কথাগুলো লিখে যেতে। কারণ আমার মনের মুক্তির তো আর কোন জায়গা নেই। আর যেহেতু আমি দেশদ্রোহী, সমাজদ্রোহী কিংবা ধর্মদ্রোহী কিছু লিখছিনা, সেহেতু আমার এই লেখার জন্য আমি কারো কাছে দায়বদ্ধ নেই। শুধু, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি যারা অজ্ঞাতসারে কষ্ট করে হলেও আমার লেখাগুলা ধারাবাহিক ভাবে পড়ে যাচ্ছেন!
যা বলছিলাম। বেশ কয়েক দফা ডায়রী লেখার চেষ্টা করেছি স্কুল জীবনে। হয়নি। আলসেমি ধরেছে। সুন্দর সুন্দর ডায়রী পেতাম। লিখিনি তেমন একটা। ২০১০ এ সিঙ্গাপুরে আমার জন্মদিনে আবার বাতিক উঠলো, ডায়রী লিখবো। লেখা শুরু করলাম। কিছুদিন পরে সেটাও বাতিল! ডায়রী লেখা প্রসঙ্গে আমার একটা কথা মনে পড়ে গেল। ডায়রীতে কি লিখবো না লিখবো এটা নিয়ে আমার আব্বু আমাকে ক্লাস সেভেনে থাকতে অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে কিছু বলেছিলেন। আর এই ২০১৯ এ এসে আবার সেই কথার পুনরাবৃত্তি শুনেছি উনার মুখেই। ডায়রীতে কি লিখতে হয় না লিখতে হয়। আব্বুর কাছ থেকে ছোটবেলা থেকেই অনেক কিছু শুনেছি, শিখেছি। তার ভেতর ডায়রী লেখাও অন্যতম। আমার মনে আছে উনার কথা কারণ ১৯৯৫ থেকে ২০১৯ লম্বা সময়ের ব্যবধান হলেও ডায়রী লেখার বিষয়বস্তু সম্পর্কে উনি যা যা বলেছিলেন, তার মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। আমার আব্বুর প্রভাব বিস্তার করে ফেলার একটা দুর্লভ ক্ষমতা আছে। কথা দিয়ে উনি খুব সহজেই মানুষের মন ভোলাতে পারেন। তার এই গুনের প্রসংশা তো করতেই হয়। (অসমাপ্ত)